আওয়ামী লীগের সদস্য ও প্রধানমন্ত্রী তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় দলটিকে এক ‘সুখবর’ দিয়েছেন। এই সুখবর হলো একাদশ সংসদ নির্বাচনে জয়ের। জয়ের ভাষায়, একাদশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নবম জাতীয় নির্বাচনের চাইতে বেশি ভোট ও আসন পাবে। তিনি নিজেদের এক প্রতিষ্ঠানের জরিপের আলোকে একথা বলেছেন। দাবি করেছেন, তার এই জরিপ ‘একিউরেট’ এবং ‘বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত’।
গত সোমবার আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকে জয় এ সুখবর দেন। জয়ের এই তথ্য ক্ষমতাসীন দলটিকে উব্ধুদ্ধ করবে, করেছেও। আত্মবিশ্বাস যোগাচ্ছে। এই আত্মবিশ্বাসের দুইটা রূপ আছে, ফলও একইভাবে দুই। আত্মবিশ্বাস যেমন কাউকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়, বিপরীতে এই আত্মবিশ্বাসও একটা জায়গায় থামিয়ে দেয়, থমকে যায় অগ্রযাত্রা। এখন দেখার বিষয়, আত্মবিশ্বাসটাকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কীভাবে গ্রহণ ও ব্যবহার করে।
২০১৩-২০১৪ সালে হরতাল অবরোধের নামে জ্বালাও-পোড়াও, পেট্রোল বোমার রাজনীতির বাইরে রাস্তার রাজনীতির মুখোমুখি হয়নি আওয়ামী লীগ। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামি জোট দেশব্যাপী নাশকতা চালিয়েছে। বাসে আগুন ও পেট্রোল বোমার আঘাতে মারা গেছে কয়েকশ লোক, আহত হয়েছেন হাজারও লোক। ওই আন্দোলনের সময়ে কোণঠাসা আওয়ামী লীগ রাস্তায় বেরুতে পারেনি, মন্ত্রী-এমপিরা থেকেছেন ঢাকার মধ্যে পুলিশি প্রহরায়; নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় যাওয়ার সাহস হয়নি তাদের। এই নাশকতার সময়ে কেবল পুলিশ প্রতিরোধ গড়েছিল। পুলিশ-নির্ভর হয়ে পড়ে সরকার; আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতার প্রকাশ পায় ওই সময়ে।
বিএনপি-জামায়াতের নাশকতার সময়ে পুলিশের ভূমিকার কারণে সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। এর আগে নির্বাচন ছাড়াই জিতে যান ১৫৩ জন এমপি। অনেক জায়গায় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না, আবার কিছু জায়গায় প্রতিদ্বন্দ্বিদের আপসরফায় বসিয়ে দেওয়া হয়। ১৪৭ আসনে নির্বাচন হয়, এবং সরকার গঠন হয় ফের। অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত এমপিদের নিয়ে গঠিত এই সংসদও পুরো পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষের অপেক্ষায়। নিয়ম অনুযায়ি আগামী বছরের শেষের দিকে নির্বাচনের কথা, এবং সেভাবেই এগুচ্ছে সরকার।
আওয়ামী লীগের এই ৯ বছরের শাসনামলে বিএনপি প্রথম থেকেই আন্দোলনের হুমকি দিয়ে আসছে। কিন্তু দলটির দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থা, রাস্তার রাজনীতিতে সরকারের বিভিন্ন বিধিনিষেধের কারণে রাজনীতি নেই রাজনীতির মাঠে। ফলে অনেকটা ফাঁকা মাঠেই সরকারি প্রটোকলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ। এতে করে দলটির নেতাকর্মীদের ধারণা এই দেশে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ও জনভিত্তি প্রশ্নাতীত মজবুত। অথচ বাস্তবতা যে এই অনুমিত ধারণা থেকে ভিন্ন সে খবর কজন রাখে। ধারণা করছি সজীব ওয়াজেদ জয়ের সেই জরিপ, জরিপের ফল ও বক্তব্য সে ধারণা থেকেই উদ্ভূত।
সজীব ওয়াজেদ জয় বলছেন, আওয়ামী লীগ আগের চাইতে বেশি ভোট পাবে, বেশি আসনও পাবে। এই বেশি ভোট পাওয়ার বিষয়ে যুক্তি থাকতে পারে, কারণ গত দশ বছরে দেশে ভোটার বেড়েছে। সেই হিসেবে নতুন ভোটারদের ভোটকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ দলের ভোট বেড়ে যাওয়াটাই অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এই ভোট বেড়ে যাওয়াকে একমাত্র হিসাবের মধ্যে নিয়ে আসন বেড়ে যাওয়ার ধারণা করা বাস্তবতা অনেকটাই অস্বীকার করা।
পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয় পায়। ওই নির্বাচনে বিএনপির ১৪০ আসনের বিপরিতে আওয়ামী লীগ পায় ৮৮ আসন। শতাংশের হিসাবে আওয়ামী লীগের ভোট ৩০.১% আর বিএনপির ৩০.৮%। অর্থাৎ মাত্র ০.৭ শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে বিএনপি ৫২টি আসন বেশি পায়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনে মোট ভোটের ৩৭.৪% পেয়ে আওয়ামী লীগ পায় ১৪৬ আসন, অন্যদিকে ৩৩.৬% ভোট পেয়ে বিএনপি পায় ১১৬ আসন। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ভোটের ৪১.০৪% পেয়ে আসন পায় ১৯৩, আর আওয়ামী লীগ ৪০.০২% ভোট পেয়েও আসন পায় মাত্র ৬২।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন চৌদ্দদলীয় জোটের মধ্যে কেবল আওয়ামী লীগ পায় ২৩০ আসন, বিএনপি ৩০ আসন। ৬.৯২ কোটি ভোটারের মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ৩.৩৬ কোটি ভোট; শতাংশের হিসাবে যা ৪৮.৪। অপরদিকে বিএনপি পায় ২.৩ কোটি ভোট, শতাংশের হিসাবে যা ৩৩.২। মাত্র ১৫ শতাংশের ভোটের ব্যবধানে আসনের ব্যবধান গিয়ে দাঁড়ায় ঠিক ২০০। স্বভাবত শতাংশের ব্যবধানটা আসন সংখ্যার ব্যবধানকে সমর্থন করে না। এর কারণ মূলত নির্বাচনী এলাকার সীমা সংক্রান্ত। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ জিতে যাওয়া আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিদের তুলনায় দলটি ভোট পেয়েছে যে সংখ্যার সে সংখ্যার ধারেকাছেও কেউ ছিল না। সাদামাটা একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী এলাকা গোপালগঞ্জ, যেখানে তিনি জেতেন লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে। এই লক্ষ ভোট তাদের দলের মোট ভোট বাড়িয়ে দেয় অনেকখানি, শতাংশের হিসাবও উলটপালট করে দেয়। একইভাবে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াও জেতেন প্রতিদ্বন্দ্বির তুলনায় বিশাল ব্যবধানে, এটাও তাঁর দলের প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা ও শতাংশকে বাড়িয়ে দেয়। দুই দলে বড় ব্যবধানে বিজয়ি হওয়া এমন কিছু নেতাও রয়েছেন।
শুনে আসছি, দেশে আওয়ামী লীগের রিজার্ভ ভোট ৩৫ শতাংশ। এটা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা দাবি করে থাকেন। কয়েকটা নির্বাচনের ফলাফল এবং বিভিন্ন জরিপের ফল শতাংশের এই হিসাবকে অনেকটাই সমর্থন করে। এই হিসাবকে নিয়ে উল্লাস ও আত্মবিশ্বাস দেখা যায় তাদের মধ্যে। অথচ বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে কেউ হিসাব করে দেখে না মোট ভোটের মধ্যে ৩৫ শতাংশ বাদ দিলে যে ৬৫ শতাংশ থেকে যায়। বাকি ৬৫ শতাংশের মধ্যে বলা হয়ে থাকে বিএনপির ৩০ শতাংশ; আর বাদবাকি ভাসমান ভোটার সহ অন্যান্যদের। এবং এরাই কিন্তু নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের নির্ণায়ক।
একটা সময়ে দেশে শতাধিক রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিত, সে সুযোগ ছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন যখন রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধনের প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসল তখন চল্লিশটি দল বাদে কেউ নিবন্ধনের শর্ত পূরণ করতে পারেনি। অর্থাৎ দলের প্রতীকে এই মুহূর্তে ৪০ দল নির্বাচন করতে পারবে। তবে এই দলগুলোর অনেকগুলোই আবার এখনও প্যাড-সর্বস্ব; নির্বাচন করার মত জনভিত্তি ও সামর্থ্য নেই। ফলে ক্রমে বাংলাদেশে দুই দলের নির্বাচনি রাজনীতির আবর্তে চলে যাচ্ছে। এতে করে ৩৫ কিংবা ৩০ শতাংশ জনভিত্তি দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার দিন অনেকটাই গত হয়ে গেছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিশাল জয় পেয়েছিল মূলত তৎকালীন শাসক দল বিএনপি-জামায়াতের স্বেচ্ছাচার, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতার দিকে দেশকে ঠেলে দেওয়া, জঙ্গিবাদ আর অপশাসনের কারণে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার তরুণ সমাজ দুঃসহ ও দমবন্ধ পরিস্থিতি থেকে দেশকে মুক্ত করার মানসিকতায় আওয়ামী লীগকে বেছে নিয়েছিল। বিএনপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে, ধানের শীষ ঠেকাও- এমন এক পরিস্থিতি ছিল। বিএনপির বিপক্ষে ওই নেগেটিভ ভোট আওয়ামী লীগের পক্ষে গেছে। সুতরাং ওই ভোটারদের সকলেই যে আওয়ামী লীগের স্থায়ী ভোটার তা ভাবার কোনো কারণ নাই।
এটা স্বতঃসিদ্ধ যে নেগেটিভ ভোট সদাসর্বদাই ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে যায়। ৯৬-এ নেগেটিভ ভোট গেছে আওয়ামী লীগের বাক্সে, ২০০১-এ গেছে বিএনপির পক্ষে আবার ২০০৮-এ সেটা গেছে আওয়ামী লীগের পক্ষে। এই ধারার ভোটের সংখ্যা নেহায়েত কম না; বলা যায় অনেক জায়গায় জয়-পরাজয়ের নির্ণায়ক।
বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ও ভোটের রাজনীতির ইতিহাস সুদীর্ঘ নয়। সংসদীয় গণতন্ত্রের যুগে প্রবেশ করার পর দেখা গেছে এখানে যখনই সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে তখন ক্ষমতাসীন দল ধরাশায়ী হয়েছে। এক দলকে পাঁচ বছরের বেশি শাসনে রাখতে আগ্রহি না দেশের মানুষ। এর পেছনে কোন যুক্তি নাই হয়ত, কিন্তু বাস্তবতা সেটাই বলে।
এমন এক পরিস্থিতিতে টানা দুই মেয়াদের শাসন শেষে ফের আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে এবং আগের চেয়ে বেশি আসন পাবে- এমন ঘোষণা সত্যিকার অর্থে উচ্চাভিলাষি। এই উচ্চাভিলাষ প্রকাশে যুক্তি হিসেবে দেশের মধ্যে বড় কিছু প্রকল্পকে সামনে নিয়ে সফল শাসনামল হিসেবে দাবি করা যায়, কিন্তু সেই দাবি কতটা বাস্তবসম্মত সে প্রশ্নও থেকে যায়।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে অর্থনীতি শক্ত ভিত্তি পেয়েছে, রাজধানীতে কিছু ফ্লাইওভার হয়েছে, পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হয়েছে, প্রান্তিক পর্যায়ে মানুষজন ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে অনেক সেবা ও সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছেন সহ আরও অনেক কিছু বলা হবে হয়ত, কিন্তু এসবের ফল আওয়ামী লীগ দল হিসেবে কতটা ঘরে তুলতে পেরেছে বা পারছে সেটাই প্রশ্ন।
এ প্রসঙ্গে বলা যায়- আমি নিজে বিভিন্ন এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে সাহায্য পাওয়া মানুষদের সঙ্গে কথা বলেছি, এবং জেনেছি সরকারি ওই সাহায্য সহযোগিতা আদতে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের ক্রেডিট হিসেবে যাচ্ছে। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের কাছে সরকারি এই উদ্যোগ প্রচার পায় নি।
আওয়ামী লীগের মূল শক্তি তৃণমূল সংগঠন। দলটি ক্ষমতায় থাকুক কিংবা নাই থাকুক দলটি প্রান্তিক পর্যায়ে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী ছিল। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে নারকীয়ভাবে হত্যার পরের দুই দশক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে দলটিকে টিকিয়ে রেখেছিল কর্মী ও আর সমর্থকেরা। ওই সময়ে দলের কর্মী-সমর্থকদের সংখ্যা ছিল অগণন। তবে টানা নয় বছরের শাসনে দলের প্রান্তিক পর্যায়ের এই অবস্থায় পরিবর্তন হয়েছে। অধিকাংশ জায়গায় কর্মীর চাইতে নেতার সংখ্যা বেশি। আর খোলস বদলে আওয়ামী লীগ সাজা নেতারা ত আছেনই!
এমন অবস্থায় সজীব ওয়াজেদ জয়ের সুখবরের বার্তা কতখানি বাস্তবসম্মত এনিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। তাঁর প্রতিষ্ঠান মাঝেমাঝে বিভিন্ন বিষয়ে জরিপ করে, কিন্তু কোন একটা জরিপকে শেষ কথা বলার সুযোগ নেই। সজীব ওয়াজেদ জয় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তার জরিপের ফলাফল সম্পর্কে বলেছেন। তার এই আত্মবিশ্বাসে দলীয় নেতাকর্মীরা আশাবাদী হবে। এই আশাবাদের মধ্যে অতি-আশাবাদের যে স্বাভাবিক ঢঙ সেটা নেতিবাচক হয়েও ধরা দিতে পারে।
ভোট সংখ্যা বাড়া মানে অধিকাংশ সংসদীয় আসনে জয়লাভ নয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে যাত্রা শুরুর পরের কয়েকটি নির্বাচন থেকে এচিত্র পরিষ্কার। এক্ষেত্রে দলীয় মনোনয়নের ব্যাপারটিই মুখ্য। অভিজ্ঞতা বলে, ক্ষমতাসীনদের প্রবল প্রতিপক্ষ নেগেটিভ ভোট আর দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল। ওসব গুরুত্ব না দিলে সুখবরের পূর্বাভাস কিংবা আত্মবিশ্বাস স্রেফ একটা শব্দ হিসেবেই থেকে যাবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)।