চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

জেল হত্যা: পরাজিত শক্তির কাপুরুষোচিত মিশন

১৯৭৫, প্রায় আড়াই মাস আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর পরম আস্থার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে জেলে বন্দি করা হয়। তখন থেকেই পাল্টা অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় ছিলো মোশতাক সরকার ও খুনি সেনারা।

খুনিদের আশঙ্কা ছিলো অভ্যুত্থান হলে আবার ক্ষমতায় আসতে পারে আওয়ামী লীগ। এই আশঙ্কা সত্যি হলে আটক এই চার নেতাই দলটির নেতৃত্বে আসবেন। বঙ্গবন্ধুর খুনি চক্র এটাই চায়নি। তাই নভেম্বরে ক্যু-পাল্টা ক্যুর নতুন অধ্যায়ের শুরুতেই বাংলাদেশ এবং আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করা মিশনের অন্যতম ধাপ হিসেবে সংঘটিত হয় জেল হত্যা।

পাকিস্তানপন্থী সেনা ও তৎকালীন সরকার কারাবন্দি চার নেতাকে নিজেদের জন্য হুমকি মনে করাতেই ওই হত্যাকাণ্ড ঘটায় বলে মনে করেন কলামিস্ট ও সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নূরুল হুদা।

চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডটি ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে সর্বপ্রথমে বিবেচনায় নিতে হবে। এই অপরাধের পেছনে খুনিদের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট। পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাস করা প্রশাসনের সরাসরি মদদে এবং ১৫ আগস্টের খুনিদের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য পূরণের ষড়যন্ত্রের ফলাফল এই হত্যাকাণ্ড।’

সেই সময়ের ওপর লেখা বিভিন্ন বই, পত্রপত্রিকা এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাতকারে জানা যায়, ১৫ আগস্ট থেকেই নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে মোশতাক সরকার। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের একটি বিরাট অংশ মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদানও করে৷ হাতে গোনা কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর এ হত্যাকাণ্ড এবং মোশতাকের নেতৃত্ব কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি৷ এই নেতাদের প্রথমে নজরবন্দি করা হয়, পরে আদর্শচ্যুত করতে বিভিন্ন প্রলোভন দেওয়া হয়।

তাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে প্রধানমন্ত্রী এবং এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে মোশতাক সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু তারা দুজনই সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন৷

ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর ছেলে আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা মোহাম্মদ নাসিমের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে নূরুল হুদা বলেন, ‘নাসিমের বক্তব্য অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার বাবাকে নানারকম প্রলোভন দেখিয়ে মোশতাক তাকে পাশে পেতে চেষ্টা করে; কিন্তু পাশে পায়নি। পরে নানারকম হুমকিও দেয়া হয়।’

মুুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে বলে মনে করেন এম মনসুর আলীর ছেলে মোহম্মদ নাসিম।

এ সম্পর্কে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে একটি নোটে নাসিম বলেন,‘ বন্দী অবস্থায় হত্যা ও শারীরিক নির্যাতন ইতিহাসে বিরল। বেইমান মোস্তাক জানতেন আসামির কাঠগড়ায় তাকে দাঁড়াতেই হবে। খুনি মোস্তাক ও জিয়া ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। যে কারণে বন্দী অবস্থায় স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।’

প্রতিশোধ এবং হীন উদ্দেশ্য পূরণ করতেই মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি এই যুদ্ধের নেতা বঙ্গবন্ধু এবং তার ঘনিষ্ঠ সহচরদের নির্মমভাবে হত্যা করে বলে আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজের একটি নোটে দলটির কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী লিখেছেন: ‘‘ ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাঁর ঘনিষ্ঠ এই চার সহকর্মীকে গ্রেফতার করে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে পাঠানো হয়েছিল। পরবর্তী অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ক্যু-পাল্টা ক্যুর রক্তাক্ত অধ্যায়ে মানবতার শত্রু ও বঙ্গবন্ধুর হন্তারক ওই একই পরাজিত শক্তির দোসর বিপথগামী কিছু সেনাসদস্য কারাগারে ঢুকে চার নেতাকে হত্যা করে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের শত্রুরা সেদিন দেশমাতৃকার সেরা সন্তান এই জাতীয় চার নেতাকে শুধু গুলি চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, কাপুরুষের মতো গুলিবিদ্ধ দেহকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে একাত্তরে পরাজয়ের জ্বালা মিটিয়েছিল। ইতিহাসের এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, স্তম্ভিত হয়েছিল সমগ্র বিশ্ব। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড ছিল একই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা। আসলে হত্যাকারীরা এবং তাদের দোসররা চেয়েছিল পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রতিশোধ নিতে, রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ ও সীমাহীন ত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশটিকে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের আবর্তে নিক্ষেপ করতে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পুনর্গঠন ও গণতান্ত্রিকতার পথ থেকে সদ্য স্বাধীন দেশটিকে বিচ্যুত করা এবং বাংলাদেশের মধ্যে থেকে একটি মিনি পাকিস্তান সৃষ্টি করা।”

১৯৭৫ সালের রক্তাক্ত আগস্টের পর অন্ধকার ঘনিয়ে আসে নভেম্বরে। ২ ও ৩ নভেম্বর মোশতাক ও খুনি সেনাদের বিরুদ্ধে খালেদ মোশাররফ, কর্নেল শাফায়াত জামিলদের পাল্টা ক্যু সংঘটিত হয়। তবে ততোক্ষণে কারাগারের ভেতরে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড হয়ে গেছে।

শাফায়াত জামিল তার বইতে এই জেল হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে লিখেছেন: “ক্ষমতা দখলকারীদের সঙ্গে আমাদের টেলিফোনে যখন বাকযুদ্ধ চলছিল, তখন ঘুণাক্ষরেও আমরা জানতে পারিনি জেলে চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ডের কথা। অথচ আগের রাতেই সংঘটিত হয়েছিল ঐ বর্বর হত্যাকাণ্ড। ওসমানী ও খলিলুর রহমান ঐ ঘটনার কথা তখন জানতেন বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু তারা আমাদের কিছুই জানাননি। জানালে এভাবে ১৫ আগস্টের খুনিদের নিরাপদে চলে যেতে দেওয়া হত না। আমাদের নেগোসিয়েশন টিমকেও এ বিষয়ে কেউ কিছু আভাস দেয়নি।”

নভেম্বরের অস্থিরতা নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত বিশ্লেষণে জানা যায়, আদৌ খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিলদের পাল্টা ক্যু আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে করা হয়েছিলো কিনা সেটা স্পষ্ট নয়। তবে ১৫ আগস্টের কুশীলবদের ভয় ছিলো শেখ মুজিবুর রহমান ও পরিবারের সবাইকে শেষ করার পরও তার এই চারজন ঘনিষ্ঠ সহচর আওয়ামী লীগের হাল ধরতে পারে। খুনিদের আশঙ্কা ছিলো এটা সত্যি হলে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বিরোধী তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে।