বহু পথ হেঁটেছেন তিনি। হাজার বছর ধরে, সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে। আলো-অন্ধকারময় পৃথীবির এই দীর্ঘ পথচলায় গ্লানিময় আক্ষেপে দিশেহারা হয়েছেন, প্রেমিকার বিরহ, দাম্পত্য অস্থিরতা-অশান্তির মাঝে কাতরভাবে খুঁজেছেন ভালোবাসা, স্বীকৃতি, সম্মান। গভীর তন্দ্রাময়, মূঢ়, আঁধারময় এই সমাজ, সভ্যতাকে অবলোকন করেছেন বিপণ্ন বিস্ময়ে। সীমাহীন বঞ্চনায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। কালজয়ী সৃষ্টিগুলো গুপ্তধনের মতো লুকিয়ে রেখেছেন কালো ট্রাঙ্কে। প্রকৃতির অপুরূপ সুধাময় এই বাংলায় ‘শংখচিল শালিখ বা ভোরের কাক হয়ে’ আবার ফিরে আসতে তার ব্যাকুলতা পাঠকরা জানতে পারেনি তার জীবদ্দশায়।
৫৫ বছরের অদীর্ঘ জীবনের শেষ দিকে একটি চাকরি পেয়ে কিছুটা থীত হয়েছিলেন। কাব্যের প্রতি, সাহিত্যের প্রতি তীব্র প্রেম তার জীবনকে রেখেছে অস্থির। বিয়ের পরপরেই চাকরির হারিয়েছেন। দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন সামান্য চাকরির আশায়। কি সীমাহিন গ্লানি হে কবি, বাংলাভাষার ‘শুদ্ধতম কবি’, জীবনানন্দ দাশ!
১৮৯৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন জীবনানন্দ দাশ। তার বাবা সত্যানন্দ দাশ বরিশাল ব্রজমোহন ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও বরিশাল ব্রাহ্মসভার আচার্য ছিলেন। তার মা কুসুমকুমারী দেবী ছিলেন অবলীলায় কাব্য রচনার বিরল প্রতিভার অধিকারী। মায়ের কাব্যের সেই ‘আদর্শ ছেলে’ ছিলেন তিনি। মুখচোরা স্বভাবের, সামাজিকতার ক্ষেত্রে বিবরবাসী, নিভৃতচারী জীবননান্দ মৃত্যু পরবর্তীকালে অভিহিত হয়েছেন রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসেবে।
জীবনানন্দের মৃত্যু আজও এক রহস্য, তা দুর্ঘটনা না আত্মহত্যা তা নিয়ে সংশয় কাটেনি। জীবনের কর্কশ বাস্তবতায় বিপর্যস্ত কবির ডায়েরিতে আত্মহত্যার আকাঙ্ক্ষা পাওয়া গিয়েছিলো। ১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর কলকাতার ট্রামলাইনে দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন তিনি, চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮ দিন পর জীবনাবসান ঘটে তার।
ট্রামের ক্যাচারে আটকে যাওয়ার মতো সেই দুর্ঘটনা এর আগে কখনো হয়নি, পরেও নয়। এই ট্রামলাইন নিয়ে তিনি লিখেছিলেন,
“কলকাতার ফুটপাত থেকে ফুটপাতে- ফুটপাত থেকে ফুটপাতে-
কয়েকটি আদিম সর্পিণী সহোদরার মতো এই যে ট্রামের লাইন ছড়িয়ে আছে
পায়ের তলে, সমস্ত শরীরের রক্তে এদের বিষাক্ত বিস্বাদ স্পর্শ অনুভব করে হাঁটছি আমি।”
রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে ডাক্তার জীবনানন্দকে মৃত ঘোষণা করলে সঞ্জয় ভট্টাচার্য লিখেন, ‘একটি জাহাজ ছেড়ে গেল…।’ সঞ্জয়ের পূর্বাশা প্রকাশনা বের করেছিলো ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থ। নিরুক্ত নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করার সময় তীব্র ব্যঙ্গ বিদ্রুপে আক্রান্ত জীবনানন্দের পক্ষে কলম ধরেছিলেন তিনি। জীবনানন্দকে সঞ্জয় বলেছিলেন, এখন যারা কবিতা লিখছে এরা কেউ কবি নয়। কবি একমাত্র আপনি।.. হুইটম্যান থেকে শুরু করে ইয়েটস, এলিয়ট, ডিলান টমাসের সাথে আপনার আত্মীয়তা। আপনি এদের বংশধর, অন্যরা কেউ না..”
জীবনানন্দের শবযাত্রা শুরু হবার আগে তার স্ত্রী লাবণ্য কি নিদারুণ নির্লিপ্ততায়, বীতশ্রদ্ধতায়, হতাশায় ভূমেন্দ্রকে প্রশ্ন করেছিলেন, “তোমার দাদা তাহলে বাংলা সাহিত্যের জন্য অনেক কিছু রেখে গেলেন, আমার জন্য কী রেখে গেলেন বলো তো?”
জীবদ্দশায় গুটিকতক যে ভক্ত-গুণগ্রাহী পেয়েছিলেন তাদের সর্বশেষজন হয়তো তারই সেবায় নিয়োজিত নার্স শান্তি মুখার্জি। জীবননান্দের অন্ধ ভক্ত মেডিকেল ছাত্র ভূমেন্দ্র গুহের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থটি পড়ে অভিভূত হয়েছিলেন তিনি। এক ভোরে ভূমেন্দ্রর দ্বিমাসিক কবিতার পত্রিকা ময়ূখের অফিসে গিয়ে বলেছিলেন, “এত বড় একজন লোকের জীবন-মরণ সংকটে নার্সিং করার সুযোগ পেয়েছি, একজন নার্স এর চেয়ে বেশী আর কী কামনা করতে পারে? আপনারা আমাকে বইটা দিলেন বলেই না জানতে পেলাম। কবিতাগুলো পড়েছি, ভালো করে তো সব বুঝতে পারি না কিন্তু তবু টানে তো, এত টানে যে… অন্তত কয়েকটা কবিতা আমাকে বুঝিয়ে দেবেন?…”
কবিদের কবি, আধুনিক, অতি-আধুনিক, অস্পষ্ট, নির্জনতম, দুর্বোধ্য, পরাবাস্তব এই কবি বেঁচে থাকতে স্বীকৃতিও যে একেবারে পাননি তা নয়। মৃত্যুর এক বছর আগে ১৯৫৩ সালে বর্ধিত সংস্করণের বই বনলতা সেন এর জন্য নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার পান। লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় তাকে অভিহিত করেন ‘শুদ্ধতম কবি’ হিসেবে। কিন্তু সংগ্রাম, গ্লানিতে অসহায় জীবনানন্দের তখন খুশীতে আহ্লাদিত হওয়ার জীবনিশক্তিটিও হয়তো ছিলো না। কবিতায় লিখেছিলেন,
“মানুষটা মরে গেলে যদি তাকে ওষুধের শিশি
কেউ দেয়-বিনি দামে-তবে কার লাভ-”
কবিতায় বিষণ্ন অভিমানে বিধাতাকে স্মরণ করে লিখেছেন,
“মানুষ ঘুমায়ে থাক-এ সুন্দর পৃথীবিতে বেঁচে থাক
কাঁচপোকা মাছরাঙা পানকৌড়ি চড়াই।
একদিন হবে নাকি তাই?
বিধাতা, তোমার কাজ সাঙ্গ হয় নাই।”
প্রায় আড়াই হাজার কবিতা, পঞ্চাশটির উপর প্রবন্ধ, আর প্রায় চার হাজার পৃষ্ঠার ডায়েরি (যাকে তিনি বলেছেন লিটেরারি নোটস) রেখে গেছেন জীবনানন্দ। এর মধ্যে মাত্র ২৬২টি কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও কাব্যসংকলনে প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন। প্রবন্ধও ছাপিয়েছিলেন বিভিন্ন পত্রিকায়। কিন্তু একটিও গল্প বা উপন্যাস জীবদ্দশায় প্রকাশ করেননি। সবই রেখে গিয়েছিলেন তার কালো ট্রাঙ্কে। পরবর্তীকালে ভূমেন্দ্র গুহ জীবনানন্দের সেই সাহিত্য সৃষ্টির মহাসমুদ্রে ডুব দিয়ে তুলে এনেছিলেন এই সব অমূল্য রত্ন।
তবে নিজের সৃষ্ট সাহিত্য সম্পর্কে অত্যন্ত উচ্চধারণা রাখতেন তিনি। নোবেল বিজয়ী ফরাসি লেখক আঁদ্রে জিদের জার্নালের একটি লাইন তার প্রিয় ছিলো, ‘I do not write for the coming generation but for the following one.’ অর্থাৎ আমি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিখি না বরং তারও পরের প্রজন্মের জন্য লিখি। সমসাময়িক নয়, দ্বিতীয় নয়, লিখেন তৃতীয় প্রজন্মের জন্য। এই লাইনটি ছিলো জীবনানন্দের নিজেরই প্রস্তাব।
তার উপন্যাসগুলোও অনেকটা তারই জীবনের কথা প্রকাশ করে। তার ‘নিরুপম যাত্রা’ উপন্যাসের গোপন কবি ভাবে, “..মনে হয় আলেকজানড্রিয়ার লাইব্রেরির সমস্ত লুপ্ত ঐশ্বর্যের চেয়েও আমার কবিতাগুলোর ইঙ্গিত ও মূল্য ঢের চমৎকার ছিল, শেক্সপিয়ার যা দিতে পারেনি- তাই ত দিয়েছিলাম আমি।…”
জীবদ্দশায় কবি মাত্র ৬টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। ‘ঝরা পালক’ ১৯২৭ সালে, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ ১৯৩৬ সালে, ‘বনলতা সেন’ ১৯৪২ সালে, ‘মহাপৃথিবী’ ১৯৪৪ সালে, ‘সাতটি তারার তিমির’ ১৯৪৮ সালে, ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হয়। কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের একাধিক পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিলো।
ঝরা পালক বইটা তিনি উৎসর্গ করেছিলেন তার প্রেমিকা চাচাতো বোন শোভনা দাশকে। উৎসর্গে শুধু লিখেছিলেন, ‘কল্যাণীয়াসুকে’। যাকে না পাওয়ার বেদনা তাড়িয়ে বেরিয়েছে কবিকে আজীবন। নারীর প্রতি তীব্র আকর্ষণে তিনি লিখেছিলেন, “নারী, শুধু তোমাকে ভালোবেসে জেনেছি, নিখিল বিষ কতটা মধুর হতে পারে।”
মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ সালে যখন তার জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কবিতে পরিণত হয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধকালে অনপনেয়ভাবে বাংলা কবিতায় তাঁর প্রভাব মুদ্রিত হয়েছে।
পাখির নীড়ের মতো চোখ, উটের গ্রীবার মতো নিস্তব্ধতা, নগ্ন নির্জন হাত, শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা নামা, রোদের গন্ধ মুছে নেয়া চিলের মতো মাদকতাময়, অপার্থিব, পরাবাস্তব উপমায় আমাদের আচ্ছন্ন রাখেন তিনি।
বাংলায় মার্ক্সবাদী আন্দোলনের জোয়ারের সময় কলেজে প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলনের সাথে জড়িত এক ছাত্র তাকে প্রশ্ন করেছিলো, “আপনি জনগণের কবিতা লেখেন না কেন?” বলেছিলো, আমরা এই সমাজব্যবস্থাকে বদলাতে চাই, কায়েম করতে চাই শোষণহীন সমাজব্যবস্থা। সেখানে কবি এবং সাহিত্যিকেরাও আমাদের সঙ্গে আসবেন তাদের বুর্জুয়া, পেটি বুর্জুয়া শ্রেণী পরিত্যাগ করে- মার্ক্সবাদ যে নতুন পথ দেখিয়েছি..” কথার মাঝখানেই জীবনানন্দ হঠাৎ প্রশ্ন করেন, তুমি কার্ল মার্ক্স পড়েছো? ডস ক্যাপিটাল?”
ছাত্র কবিটি থতমত খেয়ে বলল, না।
জীবনানন্দ বাবু একটুকাল তার দিকে তাকিয়ে থেকে হাসি গোপনের চেষ্টা করেও অকস্মাৎ উচ্চহাস্যে ফেটে পড়েন। হঠাৎ সে হাসি। এমন আচম্বিতে বেরিয়ে আসা- যে অবাক হয়ে দেখতে হয় তাকে। সঙ্গে হাসা যায় না।”
নিদারুণ গ্লানিময়, বিশুদ্ধভাবে ব্যর্থ বৈষয়িক জীবনের পর বাংলা সাহিত্যে তাকে নিয়ে এতো উন্মাদনা দেখে, তার আত্মবিশ্বাস সত্য হতে দেখে, তেমনি কি হাসেন, নির্জনতম কবি?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)