চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

জিয়া হত্যায় জড়িত না থাকলেও মুক্তিযোদ্ধা বলেই ১৩ জনের ফাঁসি

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে গঠিত কোর্ট মার্শালে যে ১৩ সেনা কর্মকর্তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল তাদের পরিবারের সদস্যরা মনে করেন ওই বিচার ছিল সম্পূর্ণ প্রহসন। সেসময় মুক্তিযোদ্ধা নিধনের যে নীল নকশা বাস্তবায়ন চলছিল তারই অংশ হিসেবে কোন ধরনের দোষ বা সম্পৃক্ততা না থাকার পরেও কেবল মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণেই অন্যায়ভাবে ওই কর্মকর্তাদের দণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

চ্যানেল আই অনলাইনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ওই কোর্ট মার্শালে ফাঁসি হওয়া তিনজন কর্মকর্তার পরিবারের সদস্য ও আত্মীয় এবং একই কোর্ট মার্শালে অভিযুক্ত হয়ে শাস্তি পাওয়া  দু’জন কর্মকর্তা ওই ঘটনার পুনঃতদন্ত দাবি করেছেন। একইসঙ্গে ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০০১ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি যে সুপারিশ করেছিল তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চেয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।

১৯৮১ সালের ২৯ ও ৩০ মে’র মধ্যবর্তী রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে জিয়া হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে একই বছরের ৪ জুলাই গঠিত কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে যে বিচার হয় ওই ঘটনার গবেষক, ইতিহাস লেখক এবং সেনা আইন বিশেষজ্ঞরাও সেটিকে প্রহসনমূলক বিচার হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

‘নীল নকশা বাস্তবায়নের এ বিচারে’ মোট ৩১ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। যাদের মধ্যে ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড, অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে জেল, তিন-চারজনকে চাকরিচ্যুত এবং বাকীদের খালাস দেওয়া হয়। যে সেনা কর্মকর্তাদের ফাঁসি দেওয়া হয় তারা সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এবং অধিকাংশই খেতাবপ্রাপ্ত।

ফাঁসিপ্রাপ্ত ১৩ জন কর্মকর্তার পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০১ সালের ১৩ জুলাই তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ‘ন্যায় বিচারের আবেদন’ বিষয়ে একটি সুপারিশ করে, যে কমিটির প্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল(অবঃ) কে এম সফিউল্লাহ বীর উত্তম।

ফাঁসিপ্রাপ্ত অফিসারদের পরিবারের আবেদনটি যাচাই বাছাই করে ওই কমিটি তাদের সুপারিশে বলেন, ফাঁসিপ্রাপ্ত অফিসারদের পরিবারবর্গকে ফাঁসির তারিখ হতে তাদের সামাজিক মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পুনর্বাসনের জন্য পারিবারিক পেনশন প্রদান এবং এককালীন বিশ লাখ টাকা প্রদান করা হোক।

১৯৮১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর যে ১২ জন অফিসারকে ফাঁসি দেওয়া হয় তারা হলেন, ব্রিগেডিয়ার মহসীন উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম, কর্নেল নওয়াজেস উদ্দিন, কর্নেল মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ বীরপ্রতীক, লে. কর্নেল এটিএম মাহফুজুর রহমান বীরবিক্রম, লে. কর্নেল মোঃ দেলোয়ার হোসেন বীরবিক্রম, মেজর এ জেড গিয়াসউদ্দিন আহমদ, মেজর রওশন ইয়াজদানী ভূঁইয়া বীরপ্রতীক, মেজর কাজী মমিনুল হক, মেজর মোঃ মুজিবুর রহমান, ক্যাপ্টেন আবদুস সাত্তার, ক্যাপ্টেন জামিল হক এবং লেফটেন্যান্ট রফিকুল হাসান খান।

৩০ সেপ্টেম্বর বিচারের জন্য শারীরিক সক্ষমতা না থাকার পরও অন্য এক কোর্ট মার্শালে ফাঁসি দেওয়া হয় লে. কর্নেল শাহ মোঃ ফজলে হোসেনকে।

কর্নেল মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ বীরপ্রতীকের ছেলে ইকবাল রশীদ খান রানা

ওই কর্মকর্তাদের ফাঁসির ৩৬ বছর পূরণের প্রাক্কালে চ্যানেল আই অনলাইন কথা বলে কর্নেল মোঃ আবদুর রশীদের ছেলে ইকবাল রশীদ খান রানা, ইয়াজদানির মামাতো ভাই এবং ভগ্নিপতি এ. হাশেম, ব্রিগেডিয়ার মহসীন উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রমের ছোট ভাই ও একই কোর্ট মার্শালের অন্যতম অভিযুক্ত লে. মোসলেহ উদ্দিন এবং মেজর রেজার সঙ্গে।

তারা সবাই মনে করেন বিচারটি ছিল সাজানো নাটক। রায় আগেই তৈরি ছিল। তাই কোন ধরনের আইন-কানুন বা নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে টার্গেট করা সেনা কর্মকর্তাদের ফাঁসি দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর থেকে সেনাবাহিনী থেকে মুক্তিযোদ্ধা নিধনের যে নীল নকশা বাস্তবায়ন চলছিল এ ঘটনা ছিল তারই অংশ।

কর্নেল মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ বীরপ্রতীকের ছেলে ইকবাল রশীদ খান রানা  চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আমরা মনে করি ওই ঘটনার কোন সুষ্ঠু বিচার হয়নি। কারণ সেনা বাহিনীর যে আইন আছে তা ওই বিচারে প্রয়োগ করা হয়নি। কারণ হলো, ওই কোর্ট মার্শালে অভিযুক্ত করা হয় ৩১ জন অফিসারকে। আর প্রত্যেক অভিযুক্তের জন্য একজন করে ডিফেন্ডিং অফিসার থাকার কথা। কিন্তু মাত্র তিন জন ডিফেন্ডিং কর্মকর্তা ছিলেন যার মধ্যে একজন আবার পাকিস্তান প্রত্যাগত। আমার বাবা ব্রিগেডিয়ার আমিনুল হককে চেয়েছিলেন কিন্তু দেওয়া হয়নি।

মেজর রওশন ইয়াজদানী ভূঁইয়া বীরপ্রতীক’র মামাতো ভাই এবং ভগ্নীপতি এ. হাশেম

‘যেদিন জিয়াউর রহমান মারা যান সেদিন আমার বাবা কাপ্তাইয়ে ৬৫তম পদাতিক ব্রিগেডে অবস্থান করছিলেন। সুতরাং তার বিরুদ্ধে তো জিয়া হত্যার কোন অভিযোগ আনা যায় না। তাছাড়া ওই মামলার যে প্রাথমিক এফআইআর তাতে নাম ছিল না আমার বাবার।’

নিজের বাবাকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করে তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর থেকে সেনাবাহিনী থেকে মুক্তিযোদ্ধা অফিসার হত্যার যে নীল নকশা তার অংশ হিসেবে আমার বাবাসহ ১৩ জন অফিসারকে বিচারের নামে হত্যা করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণেই তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। তাই আমি চাই ওই ঘটনার পুনঃতদন্ত হোক এবং ওই কোর্ট মার্শাল নিয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি যে সুপারিশ করেছিল তার বাস্তবায়ন হোক।

এম এ হাশেম বলেন: কোনভাবেই জিয়া হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না ইয়াজদানি। এই আত্মবিশ্বাস থেকেই তিনি ভারতে পর্যন্ত গিয়েও ফিরে এসে আবার আত্মসমর্পণ করেছিলেন।

ব্রিগেডিয়ার মহসীন উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রমের ছোট ভাই এবং একই কোর্ট মার্শালের অন্যতম অভিযুক্ত লে. মোসলেহ উদ্দিন

তিনি বলেন: ইয়াজদানি এতটাই সৎ ছিলেন যে তার বিরুদ্ধে কখনও কেউ অভিযোগ আনতে পারেনি। ওই সময়ে বিভিন্ন ঢাকায় বারবার ক্যু হচ্ছিল বলে তিনি ঢাকায় কখনও পোস্টিং নেননি। কেবল মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণেই তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়।

‘সেদিন তিনিও কাপ্তাইয়ে অবস্থান করছিলেন এবং ওই ঘটনার সঙ্গে তার জড়িত থাকার কোন প্রশ্নই ছিল না। শেষ ভরস্থাস্থল হিসেবে আমরা শেখ হাসিনার কাছেই ফরিয়াদ জানাতে চাই। ওই ঘটনায় যে ১৩ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে তারা একজনও মূলত দায়ী নয়। তাই আমরা চাই ওই ঘটনার পুনঃতদন্ত হোক, ওই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হোক।’

কর্নেল মোসলেহ উদ্দিন বলেন: আমার কাছে মনে হয়েছে বিচারটি সুষ্ঠু হয়নি। এখানে ৩১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় তাদের জন্য মাত্র তিন জন ডিফেন্ডিং অফিসার দেওয়া হয়েছিল। ৩১ জনের জন্য এটা মোটেও পর্যাপ্ত ছিল না। ঘটনাটি ঘটেছে সেনাবাহিনী কর্তৃক। কিন্তু আর কাউকে অভিযুক্ত না করে অভিযোগ আনা হয়েছে কেবল মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমি মনে করি, যেহেতু আর্মি দ্বারা এটি সংঘটিত হয়েছিল সুতরাং সেনাপ্রধান, গোয়েন্দা সংস্থাসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনা উচিত ছিল।

কোর্ট মার্শালের অন্যতম অভিযুক্ত মেজর রেজা

‘আমাদের বিরুদ্ধে যে বিচার করা হয়েছে সেটা মোটেও সুষ্ঠু হয়নি। তাই ওই ঘটনার পুন:তদন্তসহ সংসদীয় কমিটির সুপারিশের পূর্ণ বাস্তবায়ন চাই।’

মেজর রেজা বলেন: বিচার ছিল জাস্ট একটা সাজানো, দেখানো, সিদ্ধান্ত তারা আগেই নিয়েছিল। সিদ্ধান্ত তাদের বিপক্ষেই নেওয়া হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে যাদেরকে বাধা মনে করেছিল। সুতরাং তাদের টার্গেট ছিল কেবল মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা। ওই মামলায় তাদের সাক্ষী নেওয়া হয়েছিল তাদেরকে নির্যাতন করে জোর করে তা আদায় করা হয়েছিল। অনেকের পক্ষে বা বিপক্ষে কোন সাক্ষীও ছিল না তবুও তাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

জিয়া হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে এই ১৩ জন অফিসারকে ফাঁসি দেওয়া হয়