জরুরি অবস্থা-কারফিউ অমান্য করে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর মিছিল। পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে মেশিনগান ফিট করা সেনাবাহিনীর টহল গাড়ি। রাস্তায় রাস্তায় মোতায়েন পুলিশ-বিডিআরও নিষ্ক্রিয়। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর ডা. শামসুল আলম খান মিলন নিহত হওয়ার পর রাতে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন এরশাদ। পরদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাজারো শিক্ষার্থীর মিছিল বের হলেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এক ধরনের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে যা থেকে স্পষ্ট হয় নাটাই এরশাদের হাতে থাকলেও পুরো নিয়ন্ত্রণ তার হাতে নেই।
সাতাশ নভেম্বর জরুরি অবস্থা জারির পর অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। রাতেই শুরু হয় মিছিল। বঙ্গবন্ধু হল থেকে জাসদ ছাত্রলীগ নেতা ওবায়দুর রহমান চুন্নু এবং আহকামউল্লাহর নেতৃত্বে মিছিল শুরু হলে অন্য হলের ছাত্ররাও তাতে যোগ দেন। উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও করে শিক্ষার্থীরা জানিয়ে দেন, তারা হল ছাড়বেন না। তবে, রাতেই সব হলের সামনে পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
পরদিন সকালে এক ভীতিকর পরিবেশের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীদের ঘুম ভাঙে। পুরো ক্যাম্পাসে তখন পুলিশ মোতায়েন হয়ে আছে। এর মধ্যেই ২৮ নভেম্বর সকালে প্রথমে মিছিল শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হল এবং রোকেয়া হলের ছাত্রীরা। শামসুন নাহার হল থেকে মিছিলটি শুরু করেছিলেন ছাত্রলীগ নেত্রী ও হলের ভিপি আইরিন পারভীন বাঁধন, জাসদ ছাত্রলীগের সাইদা এবং রোকেয়া হল থেকে ছাত্রদল নেত্রী ও হলের ভিপি শিরিন সুলতানা ও জাসদ ছাত্রলীগের শামসুন। তাদের শুরু করা মিছিলটি এ কারণে ইতিহাসে জায়গা করে থাকবে যে সেটি পরে হাজারো শিক্ষার্থীর মিছিলে পরিণত হয়। দোয়েল চত্বর, প্রেসক্লাব, দৈনিক বাংলা, মতিঝিল এবং কাকরাইল হয়ে মিছিল হাইকোর্টের সামনে দিয়ে আবারো দোয়েল চত্বর হয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে আজিমপুরের দিকে গেলে জাতীয় পার্টির গুণ্ডারা মিছিলে গুলি করে।
আমাদের মনে দুশ্চিন্তা, কি করা যায়! এরমধ্যেই আর্মিরা রাস্তায় নেমে গেছে। রোকেয়া হলের দোতলাটা ছিলো রাস্তার কাছাকাছি। কিছুক্ষণ পর দেখি আর্মিরা যাচ্ছে। সারাবাত বসে বসে পরিকল্পনা করছি, আমরা বের হবো, যেভাবেই হোক। কেউ কেউ বলে ছেলেরা যদি বের না হয়! বললাম, তাহলে আমরাই বের হবো।
চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করেছেন রোকেয়া হল ছাত্রী সংসদের তখনকার ভিপি শিরিন সুলতানা। তিনি বলেন, তখন ছাত্র-ছাত্রী এক হয়ে গিয়েছিলাম। ছাত্রী বলে আমাদের আর আলাদা করা হতো না। জাতীয় রাজনীতি ছাপিয়ে ছাত্র রাজনীতি আরো বেশি উত্তাল ছিলো তখন। ২৭ নভেম্বর সকালে আমরা টিএসসিতে জড়ো হচ্ছিলাম। এই সময়ে সাড়ে দশটার দিকে গুলির শব্দ। শুনলাম ডা. মিলন মারা গেছেন। হঠাৎ করে সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়লো খবরটা। চারদিকে শুধু মিছিল, মিছিল আর মিছিল।
এই পরিস্থিতিতে ভীত হয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেন এরশাদ। রাতেই হল খালি করতে বলা হলো। আন্দোলনকারীদের মধ্যে একটু শঙ্কা। বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। সেটা বন্ধ হলে আন্দোলন হবে কিভাবে! ছাত্ররা বাড়ি চলে গেলে আন্দোলনতো আর দানা বাঁধবে না।
এর পরের সময়ের বর্ণনা তিনি দিয়েছেন এভাবে: আমাদের মনে দুশ্চিন্তা, কি করা যায়! এরমধ্যেই আর্মিরা রাস্তায় নেমে গেছে। রোকেয়া হলের দোতলাটা ছিলো রাস্তার কাছাকাছি। কিছুক্ষণ পর দেখি আর্মিরা যাচ্ছে। সারারাত বসে বসে পরিকল্পনা করছি, আমরা বের হবো, যেভাবেই হোক। কেউ কেউ বলে ছেলেরা যদি বের না হয়! বললাম, তাহলে আমরাই বের হবো। রাতেই এরশাদের একটা কুশপুত্তলিকা বানালাম। আমাদের কাছে তো আর ছেলেদের শার্ট নাই, ওই দারোয়ান চাচাদের শার্ট নিলাম। সারারাতই নানা ধরনের শব্দ। আমরাও অধীর হয়ে কান পেতে শুনি। ভাবছি গুলি হচ্ছে কিনা, মিছিলের সহযাত্রীরা ডাকছে কিনা। পরের দিন খুব ভোরে উঠেছি। উঠেই ৫০-৬০ জন গেটের কাছে গিয়ে বলেছি, আমরা বের হবো। দারোয়ান চাচারা গেট খুলছেন না। ধীরে ধীরে আমাদের ছাত্রীদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেলো। পরে আমরা নিজেরাই চাবি নিয়ে গেট খুলে বের হলাম। বের হয়ে দেখি শামসুন নাহার হলের ওরাও বের হয়েছে। আমরা সবাই মিলে প্রায় শ পাঁচেক মেয়ে। ঘুম থেকে উঠেই চোখ কচলাতে কচলাতে সবাই চলে এসেছে। আমরা চিন্তা করছি কি করবো? ভাবলাম- ভিসির বাসার দিকে যাই। ওদিকে সূর্যসেন হল আছে, মহসিন হলটা আছে। আমরা স্লোগান শুরু করলাম। আর্মির গাড়ি ছিলো কিন্তু ওরা খুব চুপচাপ। ধীরে ধীরে কিছু কিছু ছেলে বেরিয়ে এলো। সেই মিছিল নিয়ে যখন দোয়েল চত্বরে এলাম তখন বিশাল অবস্থা।
‘বেশিরভাগই মেয়েই ছিল ম্যাক্সি পরা, পায়ে কোনো স্যান্ডেল নেই। রাজপথে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের পায়ের নখ উঠে গেছে। কিন্তু কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। এর আগেই আমাদের মিছিলে কারফিউ ব্রেক হয়ে গেছে। ছাত্ররা এসে ধীরে ধীরে মিছিলটা শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে এলো। প্রেসক্লাবের সামনে এসে দেখলাম বন্দুক তাক করে আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কাছাকাছি এসে দেখলাম, না গুলি করছে না।’
জরুরি অবস্থা এবং কারফিউয়ের মধ্যে কেন সেদিন হাজারো ছাত্র-ছাত্রীর মিছিলে পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনী গুলি করেনি? ওই সময়ের মিছিলকারীদের একজন সাংবাদিক মীর মাসরুর জামান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন: গতরাতে রাজারবাগে যে ব্রিফিং হয়েছে সেখানে পুলিশের পক্ষ থেকে রক্তপাতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তারা মিছিলকারীদেরকে জানিয়ে দেন, পুলিশ গুলি করবে না। কিন্তু, সেনাবাহিনীর বিষয়টা তারা বলতে পারছেন না।
ওই মিছিলকারীরা দৈনিক বাংলা মোড়ের কাছাকাছি মেশিনগান ফিট করা সেনাবাহিনীর গাড়ির মুখোমুখি হয়েছিলেন। সাংবাদিক মাসরুর জামান জানান: সেনা কর্মকর্তারা তাদেরকে বলেন, মিছিল যদি শান্তিপূর্ণ হয় তাহলে আর্মি কিছু বলবে না। কারফিউ এবং জরুরি অবস্থা অমান্য করে মিছিলকেই যখন ‘চরম অশান্তির’ একটি কর্মসূচি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত, তখন রাস্তায় দায়িত্ব পালন করা সেনা কর্মকর্তাদের বক্তব্য এ আস্থা দিয়েছিল যে এরশাদ সেনাবাহিনীর সেনাবাহিনীর শতভাগ সমর্থন পাচ্ছেন না।
আসলেই কি তাই? মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সপ্তাহ দুয়েক আগে সেনাবাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তারা এরশাদকে তাদের মনোভাব জানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু, সে কারণেই কি সেনাবাহিনী সেদিন নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল? এরশাদকে রক্ষায় রক্তপাতে না যাওয়ার কি সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা ছিল?
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জরুরি অবস্থার জারির সময়টায় দেশে ছিলেন না সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূর উদ্দিন খান। ডিরেক্টর (মিলিটারি অপারেশন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমসহ দেশের বাইরে ছিলেন তিনি। সেনাবাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন চিফ অব জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল আব্দুস সালাম। সেনাপ্রধানের অনুপস্থিতিতে তিনি শুধু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেভাবেই রাস্তায় মোতায়েন সেনা সদস্যদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। তাদের ঘনিষ্ঠরা বলেন, দেশ ছাড়ার আগে সেনাপ্রধান জেনারেল নূর উদ্দিন খানও তাকে তেমনই নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন। চেষ্টা করেও এ ব্যাপারে নূর উদ্দিন খানের কোন বক্তব্য জানা যায়নি।
তবে, চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে সে সময়টার কথা জানিয়েছেন সেনাবাহিনীর তখনকার পরিচালক (মিলিটারি অপারেশন্স) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম।
তিনি বলেন: ২৭ নভেম্বর সকাল ৯টায় সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্টে জেনারেল নূর উদ্দিন খান এবং আমি সৌদি আরবের উদ্দেশে রওনা হই। ওইসময় সৌদি আরবের উত্তর পশ্চিমাংশে কুয়েত সীমান্তের কাছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল মোতায়েন করা ছিলো। তাদের দেখতে যাওয়ার কথা আমাদের। তারা সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা কাজে নিয়োজিত ছিলো। আমাদের প্লেনটা যখন দুবাই এয়ারপোর্টের কাছাকাছি তখন পাইলট জানালেন, ঢাকায় কারফিউ জারি হয়েছে। ঢাকার সঙ্গে বিদেশের যোগাযোগ বন্ধ। দুবাই বিমানবন্দরে তখন আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের সৌজন্য সাক্ষাত হয়। তিনিও এ বিষয়ে বিশেষ কিছু জানতেন না।
‘আমরা সৌদি আরব গিয়ে সেখানে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। ২৮ নভেম্বর আনুমানিক সকাল ১০টার দিকে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হলো। পাঁচদিন থাকার পরিকল্পনা ছিলো আমাদের। কিন্তু, তিনদিনের মাথায় আমরা দেশে ফিরলাম। কারণ দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান ও সামরিক অপারেশন্স পরিচালকের একযোগে দেশের বাইরে থাকাটা বাস্তবসম্মত হতো না।’
মূলতঃ সেনাপ্রধানের দেশে প্রত্যাবর্তনেই এরশাদের পতন ত্বরান্বিত হয়। তার অনুপস্থিতিতে জরুরি অবস্থার মধ্যে মোটামুটি নিষ্ক্রিয় থাকলেও সেনাবাহিনী সরাসরি এরশাদের আদেশ অমান্য করতে পারছিল না। রক্তপাতে না গেলেও তাদেরকে সেনা মোতায়েন করে রাখতে হয়েছে। কিছু জায়গায় অ্যাকশনেও যেতে হয়েছে।
একইভাবে এরশাদ এবং তার মন্ত্রীদের নির্দেশে পুলিশকেও কিছু জায়গায় আন্দোলকারীদের দমন করতে নামতে হয়েছে। যেমন ২৮ নভেম্বর বিকেলে ছাত্র-ছাত্রীসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের মিছিল পুলিশ ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে রাষ্ট্রপতি হওয়া অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ এবং এখনকার সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর সেই মিছিলে ছিলেন। অনেক শিক্ষককে সেদিন রাস্তায় পুলিশ লাঠিপেটাও করে। আর রওশন এরশাদের শহর ময়মনসিংহে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ছাত্রনেতা ফিরোজ এবং জাহাঙ্গীর। আরো কয়েক জায়গায় রক্তপাতের ঘটনা ঘটে।
তবে, আন্দোলন চলতে থাকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। ২৯ নভেম্বর বিডিআর মোতায়েন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো খালি করতে বাধ্য করা হয়। তারপরও থেকে যান কেউ কেউ। তাদের একজন রোকেয়া হলের তখনকার ভিপি শিরিন সুলতানা।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, হল ভ্যাকেট হয়ে গেলো। মাত্র ১১ জনের মতো মেয়ে আমরা হলে ছিলাম। আইরিন পারভীন বাঁধন আপাও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। দুয়েকজন করে একটা রুমে থাকতাম আর বাইরে থেকে তালা দেওয়া থাকতো। বেরিয়ে বেরিয়ে একেক জায়গায় মিছিল-মিটিং করতাম। দিনে সংগঠিত করার চেষ্টা করি আর রাতে এসে হলে থাকি। খালি হলেই ৪-৫ দিন ছিলাম আমরা।
(১৯৯০ সালে ছাত্রগণঅভ্যুত্থানে জেনারেল এরশাদকে বিদায় করা রাজপথের আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছে পুরো বাংলাদেশ। যেভাবে এ আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে এবং তার কিছু নেপথ্য ঘটনাও অনেকের জানা। তবে, সেনাবাহিনী সমর্থন প্রত্যাহার করায় যেভাবে জেনারেল এরশাদ পায়ের নীচে মাটি হারিয়ে ফেলেন সেই ঘটনা জানা নেই বেশিরভাগ মানুষের। ৯০ সালের উত্তাল সময়ে রাজপথের পাশাপাশি ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে কী ঘটছিল সেই অজানা অধ্যায়গুলো তুলে ধরা হচ্ছে ধারাবাহিক এ প্রতিবেদনে।)