অন্য জল, অন্য অন্ন, অন্য অগ্নির মতো আমাদের ভেতর বাস করে আরেক মানুষ।
আর জনমে ছ্যাইলা কইরহে
আর জনমে মাইয়া কইরহে! জনম ঘুরাইয়া লও হে জনম ঘুরাইয়া লও হেএএএ
ছ্যাইল্যা ছ্যাইল্যা ছ্যাইলা, মাইয়া মাইয়া মাইয়া
আর জনমে কইর হে।।
শরীর বিদ্যা পঠনে স্বর্গীয় কৌতুকীর প্রতি বিশ্বাসী হয়ে উঠবে মানুষ। তাই শরীর বিদ্যা কখনও ধর্মগ্রন্থ হয়ে ওঠে। যে পড়বে সে নত হবে লুকানো শক্তির বিস্ময় থেকে তপস্যায়। শারীরবিদ্যা যা অনুসরণ ও ধারণ করে আয়োজিত, মানবদেহকে ব্যাখ্যা ও শিক্ষার জন্য আধারিত, তা সৃষ্টির জন্য স্রষ্টার প্রতি চমকিত ও শ্রদ্ধাকাতর অবনত করবে। ধর্মগ্রন্থ ও মানব শরীরের পাঠ স্রষ্টাকে আবিষ্কারের উপলক্ষ। ফিজিওলজি ও পবিত্রগ্রন্থ এক সতর্ক সমন্বয় হিসেবে দেখা যায়।
ব্যাখ্যায়িত করবার দাবি থেকে কথা হবে, বলব এবং গভীরতর এষণায় যুক্ত হব।
গল্প দীর্ঘ হয়, ইতিবৃত্ত থামবার নয়।
শোভা, লর্ণা একেকটি নাম
‘বাহ- হিজড়াদের নামের বাহার আছে দেখছি’! এদের সহজে মরণ হয় না, দাবড়ালে, প্রহারে ব্যবহারে পশ্চাৎদেশ রক্তাক্ত করলেও ‘এইগুলান হইল স্যাঁতস্যাঁইতা তেলাপোকার মতো। সহজে দম বের হয় না!’
পাজামার ফিতা ধরে টানাটানি ও চেক করলে আসল হিজড়ার দেখা মেলে।
মৌলি আজাদ, তার দীর্ঘ গল্প বিশিষ্ট বইতে, সব দিল কিন্তু শরীর দিল না …. কষ্ট হয়, কষ্ট হয় এভাবেই তৃতীয় চিহ্নের জবাকে নিয়ে মানবিক কথকতা ঘ্রাণহীন অথচ উত্তাপময় শব্দাক্ষরিত করে রেখেছেন।
গোলাপকে যে নামে ডাকো, জবাফুল যে নামেই সম্বোধিত হোক গন্ধে হেরফের থাকলেও রজনীতে সুধা ঢালে- কীর্তি, কৃতিতে রীতিতে; এই যুদ্ধে তুমি আমার মিত্র হও, তখন তুমি দেবী আমার। আমাকে কাঁপতে বাধ্য করে তুমি অপ্রতিরোধ্য: আড়াই হাজার বছর আগে গ্রীক কবি স্যাফো ঠিক জানত এই গান। তুমি আমাকে পোড়াও।
বাৎসায়নের কামসূত্রে চার রকম নারী স্বাদের বর্ণনার পর এক ভিন্ন প্রকৃতির পঞ্চম জনের উল্লেখে নপুংসক সত্তার হদিস রয়েছে, জীবিকাধারণের উপলক্ষ বেশ্যাবৃত্তি। বাৎসায়ন দুভাগে তাদের দেখেন, স্ত্রী ও পুরুষ রূপিনী। প্রথম দল বেশ্যাবৃত্তি ও দ্বিতীয় দল পুরুষকে লাভ করার সম্বাহক হিসেবে অঙ্গ মর্দন দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করবে। রাষ্ট্র তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করত না। শিক্ষার আলো, ফুলের মতন। শুভকাজে ব্যবহার করা যায় না।
শিক্ষা ও প্রেমে, উন্নয়নবাদী উগ্র জাতীয়তাবাদীতায়ও উপেক্ষিত এরা তৃতীয়া প্রকৃতি: বৃহন্নলা, অবমানব, সন্ধিমানব, কিম্পুরুষ, ক্লীব যথা হিজড়া।
বিপ্লব দাশের কিম্পুরুষ উপন্যাসটি পেয়েছি। কমল চক্রবর্তীর ব্রহ্মাভার্গব পুরাণ, আরেক উপন্যাসে ছিল মানুষকে অতিক্রম করে- যৌনতাকে অতিক্রম করে- অযোনিসম্ভব প্রেম।
তৃতীয় চিহ্নের মানুষের মানচিত্র ভিন্ন। ইশ্বরকোটির রঙ্গকৌতুক মনে হলেও প্রকৃতির বিভ্রান্তি এইসব মানুষ উন্নয়নের মূলধারার বাইরে অবস্থান করে।
মৌলি আজাদ রক্তজবাদের কেউ ভালবাসেনি- হিজড়া সমাজের মানবিক অনুসন্ধান।
হিজড়াদের লক্ষণ, ব্যতিক্রমী যৌনসত্তা। তারা সমাজ বিহীন নিজস্ব সমাজাধীন প্রান্তিকজন। তাদের সামাজিক শ্রেণীবিন্যাস আলাদা। ভাষা আলাদা, উল্টিভাষায় কথা বলে। তাদের বৃত্তি ও প্রবৃত্তিকে ধরতাইয়ের মধ্যে রাখা হয় না।
ওরা যে যেমন পারে সেভাবে বাঁচতে চায়। ভবিষ্যৎ তাদের প্রণোদনা দেয় না। বর্তমানের ক্ষতবিক্ষত জীবন তাদের একমাত্র বাস্তবতা। তাঁদের বাঁচার পথ নির্মাণ করে বেআইনি ও অপরাধমূলক উৎস। সামাজিক স্বীকৃতি না দিয়ে, তাদের মানবাধিকার গুড়িয়ে দিয়ে সমাজ আরো বেশি অন্যায়, অনায্য ও মানবতাবিরোধী অপকর্ম করে বসে আছে গ্লানিহীন।
সমাজ এগিয়ে আসেনি তবু ওরা ঘোষণা দেয় যে, আমি তোমাদেরই লোক।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পার্কের সেই পাগলিটাকে মনে করতে পারি। যে ল্যাম্পপোস্টে আঘাত করতে করতে বলে চলেছিল, এই শহরে একটাও মরদ নাই সব চিকা সব চিকা।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সৈয়দ ইকবাল লিখেছিলেন অসাধারণ সেই গল্প, একদিন বঙ্গবন্ধু। অচিন্তনীয় ঘটনা প্রবাহে হতচকিত মানুষ, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে যখন ব্যর্থ, অক্ষম- প্রতিবন্ধী ও অক্ষম সমাজমানস ও দস্তুর মতো সব মানুষ হয়ে পড়ে চিকা! হিজড়ার দল মানুষ সব।
ধর্মের দোহাই দিয়ে বিচারক ও জল্লাদের ভূমিকায় একদল ঘাতক যখন ঘরে ঘরে গিয়ে রক্তাক্ত করছিল আবাস সেসময়ে নিঃশব্দ প্রতিবেশী ও পরিবেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তৃতীয়া প্রকৃতির সেই কয়জনার কথা বলতে হবে, হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল পলায়নপর আততায়ীকে।
হিজরারা তখন ‘অপর’ হয়ে ধরাচূড়া মেনে থাকে না। প্রতিবাদ ও লড়াই করার অতীত থাকলেও গা বাঁচানো সামাজিক প্রাণীরা ‘অপর’ হয়ে পড়ে তাদের অতীত ও বর্তমান থাকে না। উম্মার্গ তাদের ভবিষ্যৎ নত করিয়ে রাখে মাথা।
বাংলা সাহিত্যে এক নিঃসঙ্গ চরিত্র তৃতীয় চিহ্নের মানুষজন। সাহিত্যেও ব্রাত্য আর রাষ্ট্রে সমাজে প্রান্তিকতারও প্রান্তিক।
তাদের উপজীব্য করে লেখা রক্তজবাদের কেউ ভালবাসেনি রাষ্ট্রের নিষ্ঠুরতার প্রতীক। অমানবিকতার দলিল।
অপূর্ণাঙ্গ কতক চরিত্র ও তাদের জয়-পরাজয়ের স্মৃতি, সত্তা, ও যাপনচিত্র, রুজিরোজগার, অধিকার, ক্ষরণ ও পীড়ন নিয়ে গড়ে ওঠা দীর্ঘ গল্পে তপ্তরপ্ত হিজরা সমাজের ইতিকথা স্মরিত হয়েছে।
কোন চরিত্র কেন্দ্রীয় নয়। গোটা হিজড়া জীবন আধারিত করতে লেখক তথ্য সাজিয়েছে, এসব চন্দ্রাহত মানুষদের নিয়ে গল্প বলার চেয়ে জরুরি এখানে মানবিক অনুসন্ধানের প্রতিফলন বলেই ভাষা ও আঙ্গিক, থট প্রসেস নয় বরং থট, ভাবনালিপিকে এগিয়ে রাখা যায়।
তার বিষয় নির্বাচন, বলা তথ্যের গল্পে অজস্র ভাবনার প্রতিফলন উসকে দেবে। গল্প দীর্ঘ প্রতিশ্রুতি রাখে।
অতঃপর না-পুরুষ, না-নারী বটে তবে কাপুরুষতা তাদের নাই- থাকে না, সুদূরের এই জানা থেকে এক ভাবনার ভাস্কর্য আপনার ভেতর আপন হতে থাকবে।
এইভাবে পাঠককে এই গ্রন্থ হাতে তুলে নিতে, পড়তে বারবার উদ্বুদ্ধ করব।
রক্তজবাদের কেউ ভালবাসেনি
মৌলি আজাদ
আগামী প্রকাশনী
মূল্য ১৫০ টাকা।
সৌজন্যে: বইনিউজ