১৯৯৬ সালের শুরুতে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান, ১৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করার ফলে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস এবং সেনাপ্রধান লে. জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মাদ নাসিমের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তৈরী হয়েছিল তার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৮ মে রাষ্ট্রপতির আদেশে সেনাপ্রধান অনুগত দুজন শীর্ষস্থানীয় সেনাকর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর মধ্য দিয়ে।
রাষ্ট্রপতির আদেশে বাধ্যতামূলক অবসর পাওয়া দুজন সেনাকর্মকর্তা ছিলেন বগুড়া ডিভিশনেরর জিওসি মেজর জেনারেল হেলাল মোর্শেদ খান এবং তৎকালীন বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) উপ-মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মিরন হামিদুর রহমান।
সেই সময়ের ওপর রচিত বইপত্রে উল্লেখ আছে: বাধ্যতামূলক অবসর দিতে মে মাসের ৪/৫ তারিখে ১২ জন অফিসারের একটি তালিকা তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তৈরি করতে বলা হয়। তালিকায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় যারা এর আগে পেশাদার এবং সেনাপ্রধানের অনুগত কর্মকর্তা হিসেবে চিহ্নিত হন। এই ১২ কর্মকর্তার মধ্যে হেলাল মোর্শেদ খান এবং মিরন হামিদুর রহমানের পেশাগত দক্ষতা নিয়ে কোন প্রশ্ন না থাকলেও ব্যক্তিগত কিছু বিষয় নিয়ে সেনাবাহিনীতে তাদের নিয়ে আলোচনা ছিল। তাই এই দুজনকে রাষ্ট্রপতি টেস্টকেস হিসেবে নেন। তার ধারণা ছিল যেহেতু তাদের বিরুদ্ধে স্ক্যান্ডাল রয়েছে তাই তাদের অবসরে পাঠানো হলে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে না।
বিশ্লেষকদের মতে, রাষ্ট্রপতির ধারণা ছিল এই দুজনকে অবসর দিলে এর প্রতিবাদে নাসিম পদত্যাগ করবেন। ফলে পছন্দের কর্মকর্তাকে সেনাপ্রধান করতে সুবিধা হবে। দ্বিতীয়ত: নাসিম হয়তো পুরো বিষয়টি নীরবে মেনে নিবেন। নীরবে মেনে নিলে তালিকায় থাকা সব কর্মকর্তাকে অবসর দেওয়া যাবে। তখন তার প্রতিবাদ করার নৈতিক বল থাকবে না সেনাপ্রধানের। তৃতীয়ত: সেনাপ্রধান এর সরব প্রতিবাদ করে তার অনুগতদের সংগঠিত করার চেষ্টা করবেন। তাতে তার বিরুদ্ধে যেকোন অভিযোগ দাঁড় করানো সুবিধা হবে।
অভিযোগ রয়েছে, রাষ্ট্রপতি তাদের অবসরদানের পত্র সেনাপ্রধানের কাছে পাঠানোর পর তা সেনাপ্রধান দ্বারা বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই জাতীয় প্রচার মাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয় যাতে সেনাপ্রধানের কিছু করার সুযোগ না থাকে।
১৮ মে বিকেলে সেনাপ্রধান নাসিম টাঙ্গাইল ঘূর্ণিঝড় দুর্গত এলাকা পরিদর্শন শেষে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় পৌঁছলে তার হাতে ওই দুই কর্মকর্মার অবসরের কাগজ ধরিয়ে দেওয়া হয়। পত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেনাপ্রধান রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ওই রাতে তাকে সময় না দিয়ে সময় দেন পরদিন সকাল ১০টায়। নির্ধারিত সময়ে দেখা করে দুই কর্মকর্তাকে এমন শাস্তি দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে রাষ্ট্রপতি বলেন, তাদের বিরুদ্ধে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র এবং একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের কথাবার্তার রেকর্ডও আছে বলে তিনি সেনাপ্রধানকে জানান।
ঘটনাটির বর্ণনা দিয়ে জেনারেল নাসিম তার বইয়ে লিখেছেন: রাষ্ট্রপতিকে আমি বলি সরকার উৎখাতের চেষ্টা গুরুতর অপরাধ। এর বিস্তারিত তদন্তের প্রয়োজন, যাতে উক্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করা যায় এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কিন্তু তার শাস্তি কখনই বাধ্যতামূলক অবসর হতে পারে না।
রাষ্ট্রপতি তার কথার গুরুত্ব না দিয়ে তাকে লিখিতভাবে আবেদন করতে বলেন।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাত শেষে সেনাপ্রধান নাসিম প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে তাকে সব ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করলে প্রধান উপদেষ্টা তাকে ধৈর্য ধরে সকল সিনিয়র কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন শেষ করার কাজ করতে আহ্বান জানান।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে নিজ দপ্তরে ফিরে তিনি পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে হেলাল মোর্শেদ খান ও মিরন হামিদুর রহমানের বাধ্যতামূলক অবসরের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে অনুরোধ জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি লেখেন। একই সঙ্গে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি রাষ্ট্রপতির অনুগত চারজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে সংযুক্ত (অ্যাটাচমেন্ট) করেন। তারা হলেন: তৎকালীন ডিজিএফআই মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আব্দুল মতিন, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের পিএসও মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভূঁইয়া, ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম এবং বিডিআর সদর দপ্তরের ডিরেক্টর অপারেশন কর্নেল সালাম।
ওই চার কর্মকর্তাকে সংযুক্ত করার ব্যাখ্যায় জেনারেল নাসিম তার বইয়ে বলেছেন: আমার মূল্যায়নে ওই চার কর্মকর্তা ষড়যন্ত্রমূলক কাজে জড়িত ছিল।
কিন্তু রাষ্ট্রপতির আদেশে দুজনকে বাধ্যতামূলক অবসর বা সেনাপ্রধানের আদেশে চারজনকে সংযুক্তির আদেশ আসলে মেনে নেয়নি কোন পক্ষই। তারা বরং অনুগতদের নিয়ে শক্তি প্রদর্শনের মহড়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে।
২০ মে সকালে রাষ্ট্রপতি অনুগত মেজর জেনারেল আব্দুল মতিন এবং মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভূঁইয়া সেনানিবাস ত্যাগ করে বঙ্গভবনে চলে যান। বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম এর আগেই ঢাকা সেনানিবাসের ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেড এলাকায় প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তোলেন। সাভারের জিওসি মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামান ২০ মে সকালেই জয়দেবপুর ও আরিচা অভিমুখে দুটি সৈন্যদল পাঠান। বেলা ১২টার পর ট্যাংকসহ আরেকটি সৈন্যদল পাঠান ঢাকার উদ্দেশে।
জেনারেল নাসিমের দাবি: এর কোন কিছুই সেনাপ্রধান হিসেবে তার অনুমতি নিয়ে করা হয়নি, করা হয়েছে রাষ্ট্রপতি বিশ্বাসের নির্দেশে। যদিও আইনগতভাবে সেনাবাহিনী প্রধানকে উপেক্ষা করে এসব করা বিদ্রোহের শামিল।
সাভার থেকে আসা সৈন্যদল ঢাকায় এসে বঙ্গভবন, রেডিও ও টিভি স্টেশন, সেনাভবন ও সেনাসদরের বাইরে অবস্থান নেয়। কারণ সেনাবাহিনীর এই অংশের জানা ছিল যে সেনাপ্রধান নাসিম অনুগত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ডিভিশন হলো বগুড়া, ময়মনসিংহ এবং যশোর। সেখান থেকে সৈন্যদল যাতে ঢাকায় প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য তাদের প্রতিহত করার জন্য সাভারের জিওসি ইমামুজ্জামান ওই জায়গাগুলোতে সৈন্য পাঠান।
অন্যদিকে ২০ মে সকাল আনুমানিক ১১টার দিকে জেনারেল নাসিম ময়মনসিংহের জিওসি মেজর জেনারেল আয়েনুদ্দিন ও বগুড়ার জিওসি মেজর জেনারেল হেলাল মোর্শেদ খানকে তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকার উদ্দেশে সৈন্যদল পাঠানোর নির্দেশ দেন। এছাড়াও যশোরের জিওসি সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম এবং কুমিল্লার জিওসি মেজর জেনারেল আনোয়ারকে প্রয়োজনে ঢাকায় পাঠানোর জন্য সৈন্যদল প্রস্তুত রাখতে বলেন।
বগুড়া ও ময়মনসিংহ থেকে নাসিমের নির্দেশে একটি করে সেনাদল ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। বগুড়ার দলটি আনুমানিক রাত ৯টার দিকে নগরবাড়ী ফেরি ঘাটে পৌঁছে এবং ময়মনসিংহ থেকে আসা দলটি বিকেল ৫টার দিকে জয়দেবপুর থেকে ৭ মাইল দুরে রাজেন্দ্রপুর এলাকায় এসে পৌঁছায়। তবে রাষ্ট্রপতির নির্দেশে আরিচা ফেরি ঘাট এবং জয়দেবপুরে আগেই অবস্থান নিয়েছিল সাভারের সেনাদল।
নাসিমের দাবি: সাভারের জিওসি বিদ্রোহ করেছেন। তাই সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং নিরাপত্তার জন্য ঢাকার বাইরে থেকে সৈন্যদলগুলোকে ঢাকা ও মিরপুর সেনানিবাসে আসতে বলি।
২০ মে দুপুর ১টার দিকে সেনাসদরের প্রায় সকল অফিসারকে নিয়ে বৈঠক করেন জেনারেল নাসিম। বৈঠকের পর নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল নুরুল ইসলাম এবং বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার কমোডর শমশের আলী তার সঙ্গে দেখা করেন। তারা রাষ্ট্রপতি বিশ্বাসের নির্দেশে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেওয়া সৈন্যবাহিনীকে ফেরত পাঠাতে অনুরোধ করলেও তিনি শর্ত দেন যে ৯ম পদাতিক ডিভিশনের সৈন্যদল সাভারে ফেরত গেলে ঢাকার বাইরের সৈন্যদের ফেরত যাওয়ার নির্দেশ দেবেন।
এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যেই ওইদিন বিকেল পাঁচটায় রেডিও-টিভিতে প্রচারিত এক ভাষণে রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস সেনাপ্রধানের পদ থেকে জেনারেল নাসিমকে সরিয়ে মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমানকে দায়িত্ব দেন।
সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের অফিসে জেনারেল মাহবুব তার অস্থায়ী কার্যালয় খুলে বসেন যেখানে তিনি আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন। সেখানে বসেই তিনি ঢাকার বাইরের জিওসি ও কমান্ডারদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের সৈন্যদের সেনাসদর অবরোধ করে ফেলার নির্দেশ দেন। সৈন্যরা লে. কর্নেল ওয়াসিমের নেতৃত্বে সাভার থেকে আসা এক স্কোয়াড্রন ট্যাঙ্কের সহায়তায় পুরো সেনাসদর অবরোধ করে ফেলে এবং ভেতরে অবস্থানরত জেনারেল নাসিম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজলুর রহমান এবং ব্রিগেডিয়ার বকরকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। না হলে সেনাসদরে ঢুকে পড়ার হুমকি দেয়।
সেসময় জেনারেল নাসিমের সঙ্গে অবস্থানকারীরা প্রয়োজনে আমৃত্য লড়াইয়ের অঙ্গীকার করলেও জেনারেল নাসিম নিজেকে সংযত রাখেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমানের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এবং ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থানরত শক্তির ভারসাম্যের বাস্তব চিত্র উপলব্ধি করতে পেরে তিনি নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল মাহবুবের সঙ্গে আপোস প্রস্তাবে রাজি হন।
আপোস প্রস্তাবে রাজি হওয়ায় মেজর জেনারেল হারুনুর রশীদ এবং মেজর জেনারেল গোলাম কাদের সেনাপ্রধানের দায়িত্ব হস্তান্তরের আলোচনা শুরু করেন।
আলোচনা শেষের পর ২০ মে রাত আনুমানিক ১০টার দিকে জেনারেল নাসিম তাকে সাহায্যকারীসহ সকল জিওসিকে ফোন করে ধন্যবাদ জানান এবং সকল দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। তিনি বগুড়া ও ময়ময়সিংহের সেনাদলকে ফেরত যাওয়ার নির্দেশ দেন। এছাড়াও তিনি নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল মাহবুবকে অনুরোধ করেন যেন তার নির্দেশ পালন করার জন্য কারও বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেওয়া হয়।
এরপর জেনারেল নাসিম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজলুর রহমান এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু বকরকে সেনাসদরের কাছে ভিআইপি মেসে নিয়ে যাওয়া হয়। একই সময়ে বগুড়ার জিওসি জেনারেল হেলাল মোর্শেদ খান এবং ময়মনসিংহের জিওসি আয়েনু্দ্দিনকে বন্দি করা হয়। পরে সামরিক আদালত গঠনের মাধ্যমে মোট ১৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যার মধ্যে ৭ জনকে বরখাস্ত এবং আটজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।
সেদিন রক্তপাত বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। সংকটময় মুহূর্তে জাতির উদ্দেশে দেয়া তার ভাষণ এখনও অনেকে স্মরণ করেন। (শেষ)