চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

চেক রিপাবলিকের নির্বাচন ও গণমাধ্যমে মুসলিম একটি ‘হট টপিক’

চেক রিপাবলিক থেকে: শরীরের কোন অংশে চুলকানোর কোন কারণ না থাকার পরেও শুধুমাত্র চুলকাতে পারি, এই অহমিকা দেখাতে সকাল বিকাল চুলকালে সেখানে ক্ষত সৃষ্টির সম্ভবনা নিরঙ্কুশ। বলছিলাম চেক রিপাবলিকের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে।

আগামী শনিবার ২১ অক্টোবর এই সাধারন নির্বাচন। তথ্য প্রবাহের এই অবাধ যুগে নির্বাচন নিয়ে কথা বলার আগে দেখে নেই আসলে চেকের সাধারন মানুষ কী উপায়ে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে নিজেদেরকে রাজনীতিতে শাণিত রাখেন।

প্রথমত আসি চেক প্রজাতন্ত্রের টেলিভিশনের কথায়। পৃথিবীতে খুব কম দেশই আছে যারা টেলিভিশন দেখায় চেক জাতিকে হারাতে পারবে। চেকের জনগণের তথ্য সংগ্রহের প্রধান মাধ্যম এই টেলিভিশন। অবাধ তথ্য প্রবাহের সুযোগ আছে। যে কোন দেশের বা যে কোন ভাষার টেলিভিশন দেখার সুযোগও উন্মুক্ত।


সমস্যা হল, চেকদের অন্য ভাষায় কিছু দেখার ইচ্ছা বা বিদেশি ভাষা শেখার আগ্রহ প্রায় শুণ্যের কোঠায়। যার ফলে দেখার সুযোগ থাকলেও প্রায় কেউই চেক টিভি ছাড়া অন্য কোন সূত্র থেকে খবর বা তথ্য সংগ্রহ করে না।

টেলিভিশন ওয়ালারা এই দেশের সব চাইতে বড় মনোবিজ্ঞানী বলে আমার ধারণা। তারা এই দেশের নাড়ির গতি বুঝেন। তারা জানেন তাদের দর্শকেরা কী নিউজ খেতে পছন্দ করেন। টেলিভিশন ওয়ালারা দর্শকের চাহিদা মতোই নিউজ পরিবেশন করেন। উদাহরণ দেই-

চেকে বিপুল সংখ্যক লোক ইহুদি ধর্মানুসারী। ইসরায়েলের প্রতি চেকের ভালোবাসা প্রায় শর্তহীন। সেই ইসরায়েল যখন কারণে-অকারণে ফিলিস্তিনিদের অত্যাচার নির্যাতন বা হত্যা করে তখন এখানকার মিডিয়ায় তার কোন প্রকাশ থাকে না বললেই চলে। উল্টো দিক হচ্ছে,যদি কোন ফিলিস্তিনি কিশোর একটি সামান্য পাথরও ছুড়ে মারে ইহুদিদের প্রতি, পরক্ষনেই তা চলে আসে টেলিভিশনের গুরুত্বপুর্ন শিরোনামে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে।

জনগণের চাহিদা অনুযায়ী কতটুকু খবর কিভাবে প্রকাশ করা উচিত বা কোন সত্য খবরকে মিথ্যা না বানিয়ে কৌশলে কিভাবে মিথ্যা বুঝিয়ে জনগণকে বোঝাবে, সেই আর্ট কেউ যদি শিখতে চায় তবে যেন চেক টিভি চ্যানেলগুলো দেখে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সমস্যার উপর চেকের কয়েকটি টিভি নিউজ করেছে। রোহিঙ্গারা আসছে, বাংলাদেশের সমস্যা তৈরি করছে, পরিবেশ নষ্ট করছে, মিয়ানমার অনৈতিক আচরণ করছে, সব ঠিক আছে। সমস্যা হয় যখন নিউজটার উপসংহার শুরু হয়। এমন কৌশলে তখন বর্ণনা করা হয় যে, এই মুসলিম গোষ্ঠী নিরীহ বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে কী নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছে!

বাংলাদেশ মুসলিম দেশ তাই সে মুসলিম রোহিঙ্গাদের পক্ষে থেকে বৌদ্ধ নিধনে সহায়তা করে এই সমস্যা সৃষ্টি করেছে এবং বার্মা নিজেদের জনগণকে নিরাপদ রাখতেই এইসব সন্ত্রাসী মুসলিম রোহিঙ্গাদের উপর ডিফেন্সিভ কিছু আইন প্রয়োগ করেছে।

আরো সুক্ষ্মভাবে নিউজে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, দরিদ্র বাংলাদেশ কীভাবে এই রোহিঙ্গা সমস্যা দেখিয়ে বহির্বিশ্ব থেকে বিপুল অর্থ সাহায্য পাবে। সূক্ষ্মতরভাবে ভিউয়ার্সদের এটাও জানিয়ে দেয়া হয় যে, বাংলাদেশের লাগোয়া সীমান্ত বন সংকুল হওয়ায় এখানে রোহিঙ্গা গেরিলাদের প্রশিক্ষণের পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে। যেহেতু চেকের অতি সামান্য কিছু লোক ভিনদেশী টেলিভিশন দেখেন তাই রোহিঙ্গা বিষয়ে চেকের টিভির জাজমেন্টই এখানকার জনগণের অবস্থান।

চেকের পত্রিকার অবস্থা আরো খারাপ। এটা সত্য প্রতিদিন পত্রিকা কেনার লোক এদের প্রচুর কিন্ত কি পত্রিকা কিনছেন তারা, সেটা একটা বিস্ময়। চেকের সর্বাধিক প্রকাশিত এবং প্রচারিত পত্রিকার নাম “ব্লেস্ক”। গসিপ বা উড়ো কথাই হচ্ছে এই পত্রিকার প্রধান সংবাদ। প্রথম পাতা জুড়ে থাকে চেক অথবা বহির্বিশ্বের রগরগে গসিপ, সচিত্র।

ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত মারা যাওয়ার পর দিন ব্লেস্ক পত্রিকা তাদের প্রথম পাতায় নিউজ করেছিলো যে আরাফাত ছিলেন সমকামী, এইডসের কারণে তার মৃত্যু হয়। কোন এক পোলিশ জেনারেলের বিশাল ছবি প্রথম পাতাতেই তাতে বড় করে হেড লাইন, “আমিই ছিলাম আরাফাতের নিয়মিত বিছানা সঙ্গী”।

যে দেশের বেশির ভাগ লোক নিয়মিত ব্লেস্ক পড়েন সেই দেশের বেশির ভাগ লোকের ধারণা যদি হয়, আরাফাত একজন নোবেল বিজয়ী সন্ত্রাসী, সমকামী এবং ইহুদি হত্যাকারী মুসলিম, তবে সেই দেশের জনগনের সাথে সাথে অবশ্যই আমি তাদের পত্রিকা বা মিডিয়াকেই দোষ দেব।

এবার আসি আগামী সপ্তাহের নির্বাচনে। ছয়টা দল প্রার্থী দিয়েছেন। সবার প্রায় একই উচ্চারণ, অভিবাসী রুখবো, সন্ত্রাস রুখবো, মুসলিমদের ঠাঁই নাই চেকে, মুসলিমদের হঠাও ইত্যাদি। চেকদের নিজস্ব বা অভ্যন্তরীণ তেমন কোন বড় ধরনের সমস্যা নাই, তাই এবারের নির্বাচনে বিদেশ, অভিবাসী, সন্ত্রাস এবং মুসলিম একটি ‘হট টপিক’।

মজার ব্যাপার হলো, চেক রিপাবলিকে কোন সন্ত্রাসী হামলা হয় নাই, এখানে মুসলমানের সংখ্যা এতোই কম যে তা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া দৃষ্টিগোচর হয় না। সারা ইউরোপে যখন অভিবাসীর ঢল, তখন চেক জিরো টলারেন্স দেখিয়ে পারতপক্ষে কোন একজনকেও এসাইলাম দিয়েছে এমন জানা নেই।

তাই এবারের চেক সাধারণ নির্বাচন যেন দেহের সুস্থ অংশ চুলকিয়ে ঘা তৈরির চেষ্টার মতোই।