বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন বিশ্বকে এককেন্দ্রীক শাসন ব্যবস্থা থেকে সরিয়ে আনতে প্রধান অনুঘটকের ভূমিকায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে বিশ্ব যে নেতৃত্বশূণ্যতা লক্ষ্য করছে, তার হাল ধরতে অগ্রণী চীন। ‘ওয়ান বেল্ট-ওয়ান রোড’ ধারণা দিয়েও বিশ্ব অর্থনীতিতে চালকের আসনে বসতে তাদের প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। বিশ্বের বৃহত্তম কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বক্তব্যে তা উঠে এসেছে খোলাখুলিভাবেই। এমন পরিস্থিতিতে এই কংগ্রেসকে গুরুত্ব না দিয়ে কি থাকতে পারে বিশ্ব?
বুধবার চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) ১৯তম কংগ্রেস বসেছে। সারাদেশ থেকে ২ হাজার ২৮৭ জন ডেলিগেট কংগ্রেসে অংশ নিচ্ছেন। তারা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ৮ কোটি ৯৪ লাখ ৪৭ হাজার সদস্যের প্রতিনিধি হিসেবে কথা বলবেন। কংগ্রেস ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে।
এই প্রতিনিধিরা নির্বাচিত করবেন ৩৭০ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি, ২৫ সদস্যের পলিটব্যুরো এবং ৭ সদস্যের স্ট্যান্ডিং কমিটি। এই স্ট্যান্ডিং কমিটিই হলো চীনের চূড়ান্ত নীতিনির্ধারক। এর সবচেয়ে প্রভাবশালী সদস্য হিসেবে থাকবেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক। এই কংগ্রেসে কমিউনিস্ট পার্টির গঠনতন্ত্রে কিছু সংশোধনী বা সংযোজনী আসার কথা রয়েছে।
দ্বিতীয়বারের মতো শি জিনপিং যে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হতে চলেছেন তা অনেকটাই নিশ্চিত। তার দুই পূর্বসূরি জিয়াং জেমিন এবং হু জিনতাও দুই মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটিকে প্রথম স্থানধারী যুক্তরাষ্ট্রের পর্যায়ে নিয়ে যেতে শি জিনপিং-য়ের প্রচেষ্টাও সর্বজনবিদিত।
১৯তম জাতীয় কংগ্রেসের উদ্বোধনী অধিবেশনে শি জিনপিং বলেছেন: চীন একটি ‘নব যুগে’ প্রবেশ করেছে, যেখানে তার বিশ্ব মঞ্চে কেন্দ্রীয় চরিত্র নেয়া উচিত। এখন আমাদের মানবজাতির জন্য বড় ভূমিকা রাখার সময়।
১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পর চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ১৮টি সম্মেলন হলেও এর আগে সেগুলো এতটা গুরুত্ব পায়নি। ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার প্রচারমাধ্যম এবারই প্রথম একে বর্তমান বিশ্বের এক বড় রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সিসিপিকে তারা দেখছে গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক অনুঘকট হিসেবে। কোন কোন মাধ্যম আবার একে শুধু চীনের সীমানায় আবদ্ধ না রেখে অভিহিত করেছে দলটির প্রথম ‘গ্লোবাল পার্টি কনফারেন্স’।
ভৌগোলিক এবং বাণিজ্যিক বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতার শিকার হওয়া চীনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ নিরাপত্তা প্রশ্ন। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সরাসরি ‘বেল্ট এন্ড রোড’ কর্মসূচির বিরোধিতা করছে। দক্ষিণ চীন সাগর এবং সেনকাকু দ্বীপকেন্দ্রিক সংঘাতে চীনকে সামরিকভাবেও ঘিরে ফেলছে যুক্তরাষ্ট্র।
অনেকের ধারণা ও আশঙ্কা দ্বিতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদক হলে দক্ষিণ এশিয়ায় আগ্রাসী কূটনীতি চালাবেন শি জিনপিং। নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা এবং ভারত সীমান্তে যার আভাস গত এক বছরে। তাই কংগ্রেসকে ঘিরে কৌতুহল রয়েছে এই অঞ্চলের দেশগুলোরও।
২০১২ সালের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক এবং পরে দেশটির প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সি জিনপিং বিশ্ব নেতৃত্বে হাল ধরার অভিলাষ স্পষ্ট করেছেন। তার আমলেই বিদেশে প্রথম সামরিক ঘাটি স্থাপন করেছে চীন। দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক অবকাঠামো নির্মাণে ভূমিকা রেখেছে। বিশ্ব অর্থনীতির জন্যও মহাপরিকল্পনা প্রকাশ করেছে, যেখানে সামনে থেকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখবে চীন।
বিশ্বকে চীনকেন্দ্রিক বাণিজ্য নেটওয়ার্কে টেনে আনতে বিগত পাঁচ বছরে বিশ্বের ৫৬টি দেশ ঘুরেছেন জিনপিং। জি-২০ সম্মেলনের আয়োজন করেছেন চীনে। বিশ্বব্যাংকের বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)। ইতোমধ্যে দেশটি বিশ্বের প্রধান রপ্তানিকারক এবং দ্বিতীয় প্রধান আমদানিকারকে পরিণত হয়েছে। এভাবেই মূলত দেশটি বৈশ্বিক পুঁজিতন্ত্রের মূল কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
বুধবার ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে তিন ঘণ্টার বক্তব্যে জিনপিং বলেছেন, চীনা সমাজতন্ত্রের অধীনে তাদের দ্রুত অগ্রগতি অন্যান্য দেশকে নতুন পথের দিশা দিয়েছে। কমিউনিস্ট শাসনের অধীনে প্রবৃদ্ধির চীনা মডেল বিকশিত হয়েছে এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশকে নতুন পথ দেখিয়েছে।