ইউনেস্কোর “ইহুদিবিরোধীদের প্রতি পক্ষপাত” আছে এই অযুহাতে আমেরিকা ও ইসরায়েল ইউনেস্কো ত্যাগ করার ঘোষণা দেবার পরদিনই ইউনেস্কো প্রধানের পদ পেল একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রভাবশালী ইহুদি অড্রে অ্যাজুলে। পদে বসা মাত্রই অ্যাজুলে দুই দেশকেই অনুরোধ করেছে ইউনেস্কো ছেড়ে না যেতে।
ইউনেস্কোর ৭০ ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী আমেরিকান ও ইহুদি। বছরে আয় করে কয়েক’শ মিলিয়ন করমুক্ত বেতন। দুই দেশের একটিও কিন্তু বলেনি আমাদের নাগরিকরা আর ইউনেস্কোয় চাকুরি করবে না!
এটিও ওপেন সিক্রেটই যে, মার্কিন ও ইহুদিদের ব্যাপক সংখ্যায় নোবেল পুরস্কার পাবার পেছনে ইউনেস্কো অন্যতম বড় প্রভাবক। এত সুবিধা পাবার পরও ১৯৮৪ সালে রিগ্যান সরকার ইউনেস্কোর সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক ছিন্ন করে চাঁদা দেয়া বন্ধ করে। ছুতো তোলে ইউনেস্কো রিপোর্টে কেন লেখা থাকবে ইসরায়েলি দমন নীতির কারণে প্যালেস্টাইনে শিক্ষা-জ্ঞান-বিজ্ঞান বিস্তার ব্যহত হচ্ছে। সোজা কথা মার্কিন অবস্থান ছিল এমন— যতই সত্য কথা হোক বা গবেষণালব্ধ তথ্যই হোক না কেন যুক্তরাষ্ট্রের না-পছন্দ কথা বলা যাবে না।
২০০৩ সালে বুশ-এর আমেরিকা আবার ইউনেস্কোয় যোগ দেয়। তবে বুশের মূল মনোযোগ ছিল স্ত্রী লরা বুশের নামে ইউনেস্কোয় মার্কিনীদের জন্য ইন্টার্নশিপ ও ফেলোশিপের ব্যবস্থা করা, প্রকারান্তরে ইউনেস্কোয় কমতে থাকা মার্কিন প্রভাব পূনঃপ্রতিষ্ঠা করা। ২০১১ সালে কংগ্রেস আবারো চাঁদা বন্ধ করে। এবারের ছুতা আর গোঁয়ার্তুমি— শিক্ষা-বৈষম্যমুক্তির জন্য হোক বা যে জন্যই হোক প্যালেস্টাইনকে ইউনেস্কোর পূর্ণ সদস্য মর্যাদা কেন দেয়া হল? অথচ জাতিসংঘে ১০৭ সদস্য রাষ্ট্রই প্যালেস্টাইনের পূর্ণ সদস্য মর্যাদায় অন্তর্ভূক্তির পক্ষে ভোট দেয়। বিপক্ষে ভোট পড়ে মাত্র ১৪টি।
ইউনেস্কোর একটি রুটিন কাজ ইতিহাস-ঐতিহ্যের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ‘হেরিটেইজ সাইট’ বা ঐতিহ্যমন্ডিত অঞ্চল ও স্থাপনা চিহ্নিত করা। এই প্রক্রিয়ায় প্যালেস্টাইনের অধীন হেবরনভুক্ত ইব্রাহিমি মসজিদ-মাজারকেও ইউনেস্কো ‘হেরিটেইজ সাইট’ ঘোষণা করে। ‘টোম অব দ্যা প্যাট্রিয়ার্কস’ বা ‘কেইভ অব দ্যা প্যাট্রিয়ার্ক্স’ নামে পরিচিত কবরস্থানবেস্টিত মসজিদটি দুই হাজার বছরেও অবিকৃত টিকে থাকা ঐতিহ্যের স্মারক বলেই ইউনেস্কোর বিচারে স্থাপনাটি ‘হেরিটেইজ সাইট’। সস্ত্রীক হজরত ইব্রাহিমের কবর এবং তাঁর বংশধরদের অনেকের কবরও এখানে হওয়ায় জায়গাটি মুসলিমদের কাছে বিশেষ মর্যাদার বটে। তবে ইউনেস্কোর বিবেচনায় ধর্ম মোটেই বিবেচ্য ছিলনা। তবুও ইজরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র রেগেমেগে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। তাঁদের গোস্বা দিনে দিনে বেড়েছেই, কমেনি। মার্কিন এই ‘শালিস মানি তালগাছ আমার’ অবস্থানের পেছনেও পুঁজিবাদী অর্থনীতির বদ-অভ্যাসটিই বেশি।
বর্তমানে আমেরিকার কাছে শুধু ইউনেস্কোরই পাওনা ৫০০ মিলিয়ন ডলার। আমেরিকা দেয়নি। “ইসরায়েল্-বিরোধিতার প্রতি পক্ষপাত” ছুতোটি তুলেছে এই আধা বিলিয়ন ডলারও না দেবার জন্য। ইব্রাহিমি মাজার-মসজিদকে ইউনেস্কোর ‘হেরিটেইজ সাইট’ ঘোষণা করার মধ্যে কানাকড়ি ‘ইহুদিবিরোধিতা’ বা ‘ইজরায়েলবিরোধিতা’ বা পক্ষপাত নাই। তবে ঘটনাটির মাধ্যমে আবারো স্পষ্ট হল যে এই দুইটি অপকর্মনির্ভর দেশ মূলত কপটতায় সেরা, মুক্তচিন্তার ভেকধারী, এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান-সভ্যতা সব কিছুকে মার্কিন প্রভুত্ববাদ সুসঙহত করার উপকরণ হিসাবেই দেখে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর ১৯৯০ সাল হতে জাতিসঙ্ঘের সকল সংস্থার অর্থায়নের ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় চাঁদাখেলাপি। অন্য ১৯২টি দেশের ক্ষেত্রে (গরীব বাংলাদেশসহ) চাঁদা পরিশোধের হার যেখানে ৯২-৯৩%, সেখানে আমেরিকা টেনেটুনে আজতক ৩৫-৩৭% দিয়েছে ।
ফক্স নিউজ ২০১৫ সালের শেষের দিকে উগ্র ডানপন্থিদের উস্কে দিয়েছিল এই বলে যে, আমেরিকা জাতিসঙ্ঘকে অতিরিক্ত বেশি চাঁদা দিয়ে দিচ্ছে— আট হতে দশ বিলিয়ন। আসলে গত বছর চাঁদা দিয়েছে মাত্র দেড় বিলিয়ন— প্রতিশ্রুত অংকের পাঁচ ভাগের এক ভাগেরও কম।
দীর্ঘদিন চাঁদাখেলাপি থাকায় ২০১৩ সালে আমেরিকা ইউনেস্কোয় ভোটাধিকারটিও হারিয়েছে। এই অপমানটিও সম্ভবত মার্কিন ইউনেস্কো-বিদ্বেষের আরেকটি বড় কারণ।
প্রশ্ন হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘকে আস্তে আস্তে অকার্যকর করে তোলার পথেই এগুচ্ছে না তো? জাতিসঙ্ঘের অন্যান্য সংস্থাগুলোর জন্য নির্ধারিত চাঁদাও না দিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কোনোভাবে বাধ্য করার শক্তি জাতিসঙ্ঘের আদৌ আছে কী? অন্য সংস্থাগুলোয়ও ভোটাধিকার হারানোর কোনো সম্ভাবনা আছে কি?
উত্তর, না নাই! শুধুমাত্র নব্বই-পূর্ব সময়ের মত সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টানটান স্নায়ুযুদ্ধটি টিকে থাকলেই মার্কিন দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা যেত।
সৃষ্টিকর্তার পরেই পৃথিবীর বুকে সর্বময় শক্তিশালী হয়ে উঠা যুক্তরাষ্ট্রের হাতে জাতিসংঘের এই জিম্মিদশা সারা বিশ্বের জন্য আতংকের। বিশ্বময় পরমাণু যুদ্ধের নতুন ধারার ডামাডোল বাড়ছে প্রতিদিনই। এই সময়ে জাতিসঙ্ঘের শক্তিশালী থাকা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু ঘটছে উল্টোটি। জাতিসঙ্ঘের শক্তি-সামর্থ্যহীন হতে চলা দৃশ্যমান হচ্ছে প্রতিদিনই।
ট্রাম্প বলে দিয়েছে ইরানের সঙ্গে ২০১৫য় করা চুক্তি অনুযায়ি কংগ্রেসে বাৎসরিক সত্যায়ন প্রতিবেদন (যে ইরান চুক্তির শর্ত মেনে চলছে) আর পাঠাবে না, এবং যুক্তরাষ্ট্র কারো মতামতের বা কোনো চুক্তির তোয়াক্কা না করে ইরানের বিরুদ্ধে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই কঠোর হবে। এমন্ ধারা ঘোষণা ইরানকে উত্তর কোরিয়ার মত পরমাণুবোমা পরীক্ষণে নামিয়ে দেয়ার উস্কানি মাত্র! ইরান ইতোমধ্যে বলেই দিয়েছে দেশটি কি করবে না করবে তার জন্য কারো হুমকি-ধামকি বা মাতব্বরি এখন থেকে পাত্তাই দেয়া হবেনা।
ইউনেস্কো বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান জাতিসঙ্ঘের শক্তিহীনতাই থাকাই নির্দেশ করে। জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থাও এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে শক্তিহীন হতে থাকলে বিশ্বসমাজকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)