এইতো কয়েকদিন আগে চলন্ত ট্রাকে এক কিশোরীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করলো চালক হেলপার। তারা গাজীপুর থেকে তুলে নিয়েছিলো কিশোরীকে। তারপর দুই নরপশু চলন্ত ট্রাকেই তাকে ধর্ষণ করে। নারায়ণগঞ্জে এসে ট্রাকটি থামলে জনতা মেয়েটিকে উদ্ধার করে। পুলিশের তৎপরতায় চালক হেলপার আটকও হয়। তারা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছে।
এ ঘটনার রেশ এখনও কাটেনি। এরই মধ্যে চলন্ত বাসে কলেজ ছাত্রীকে ধর্ষণ করে চালক হেলপারসহ তিনজন। ধর্ষণ করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। মেয়েটির ঘাড় মটকে এবং মাথা থেঁতলে মৃত্যু নিশ্চিত করে রাস্তা ফেলে দিয়ে যায়। এ ঘটনায় পুরো দেশ এখন নড়েচড়ে বসেছে। এর আগেও বেশ কিছু ধর্ষণ ঘটনা নিয়ে এমন নড়াচড়া করেছিল দেশ। ফলাফল শূন্য। চলন্ত বাসে কলেজ ছাত্রী ধর্ষণ! পিতা কর্তৃক কন্যা ধর্ষণ! মসজিদের ভেতর ঈমাম কর্তৃক শিশু ধর্ষণ! বাসা থেকে তুলে নিয়ে ক্ষমতাসীনদের হাতে তরুণী ধর্ষণ!
একের পর এক ধর্ষণ ঘটনা ঘটেই চলছে দেশে। ধর্ষণ যেন এই দেশের জন্য এখন পান্তাভাত হয়ে যাচ্ছে! এ যেন কোনো ঘটনাই নয়। বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রে নির্বাহী বিভাগও কেমন নির্লপ্ত!
ধর্ষণ হচ্ছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধর্ষক গ্রেপ্তারও হচ্ছে। কিন্তু বিচার হচ্ছে ক’জনের? বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণকাণ্ড এখন লাগামহীন। কিছুতেই রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে আদতে ধর্ষণরোধ করা সম্ভব হবে বলেও মনে হচ্ছে না। দিন দিন এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহতার দিকেই যাবে। পরিস্থিতি এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে, নারী-পুরুষের সম্মুখ যুদ্ধও ঘটতে পারে। তবে এই ধর্ষণ ঘটনা বৃদ্ধির জন্য আমাদের বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ তাদের দায় কিছুতেই এড়াতে পারে না।
ধর্ষণের সাথে সম্পৃক্ত প্রমাণিত হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধানও রাখা হয়েছে আমাদের প্রচলিত আইনে। যা ধর্ষণ ঘটনা রোধে যথেষ্ট। তারপরও কেন দিনের পর দিন ধর্ষণ ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে? এর একটাই উত্তর- বিচারহীনতা। কেননা, এ যাবতকালে ক’টা ধর্ষণ ঘটনার সুষ্ঠু এবং সঠিক বিচার সম্পন্ন হয়েছে? বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে সৃষ্টি হচ্ছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। এতে করে ধর্ষণ করতে উৎসাহিত হচ্ছে একটা শ্রেণি। কারণ তারা জানে ধর্ষণ করলে এ দেশে বিচার হয় না!
এদেশে ইয়াসমিন আক্তার গণধর্ষণ এবং হত্যার বিচার ছাড়া আর ক’টি বিচার হয়েছে, বলতে পারেন? সেও ইয়াসমিন ধর্ষণ ঘটনার বিচার হতো না। এক বিচারের দাবিতে ১৭ জন প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিলো বলেই ২০০৪ সালে অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিলো। তাও এই বিচার প্রক্রিয়া এতটা সহজ ছিল না। একমাত্র দেশব্যাপী মানুষ সমস্বরে জেগে উঠায় সম্ভব হয়েছিলো। এরপর কেটে গেছে অনেক বছর। বেড়েছে ধর্ষণ ঘটনা। শাস্তি হয়নি একটিও!
পূর্ণিমা ধর্ষণ, তনু ধর্ষণ ও হত্যা, বনানীর ধর্ষণ, সৎবাবা কর্তৃক কন্যা ধর্ষণ, জন্মদাতা কর্তৃক ঔরসজাত কন্যা ধর্ষণ, ঈমাম কর্তৃক শিশু ধর্ষণসহ এমন অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে আমরা কথা বলছি। এদের কেউ কেউ গ্রেপ্তারও হয়েছে। কিন্তু বিচার হয়নি একটিরও। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে এমন আরও অসংখ্য ধর্ষণ মামলা বছরের পর বছর ধরে ফাইলবন্দি হয়ে আছে। কোথাও কোথাও বিচারের এই দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ধর্ষকরা খালাসও পেয়ে যাচ্ছে!
এমন বিচারহীনতার সংস্কৃতিই জন্ম দিচ্ছে তুফানদের মতো কীটদের। তারা ধর্ষণ করছে, উল্লাসে মেতে উঠছে। রাষ্ট্রও এদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করছে না। এখন হয়তো কেউ বলতে পারেন, ধর্ষকরা তো গ্রেপ্তার হচ্ছে। আমিও বলি হচ্ছে। গ্রেপ্তার মানেই শেষ কথা নয়। এদের বিচার দ্রুততার সঙ্গে শেষ করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে সর্বোচ্চ শাস্তির। সেটি সম্ভব হলেই ধর্ষণকাণ্ড রোধ করা সহজ হবে। অন্যথায় এই দেশে ধর্ষণ ঘটনা মহামারি আকার ধারণ করেব।
এমনিতেই আমাদের নারীরা ঘর থেকে বাইরে, কোথাও নিরাপত্তা বোধ করছে না। আমরা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও পারছি না। রক্ষক বেশে কখনো কখনো ভক্ষকের ভূমিকায় আমরাই উপনীত হচ্ছি। মূল হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা নিয়ে বেড়ে ওঠা পুরুষ আমরা। আমাদের কাছে নারী মানেই ভোগ্যপণ্য! নারী শরীর দেখলেই হামলে পড়তে ইচ্ছে করে, হামলেও পড়ি। পুরুষতান্ত্রিক এই মানসিকতাই ধর্ষণে উৎসাহ যোগাচ্ছে।
আমরা অনেক সময় দেখি পুরুষ নামী পশুদের অসভ্য আচরণের প্রতিবাদ করতে গেলেও অনেক মেয়েকে ‘বেশ্যা’ গালি শুনতে হচ্ছে। সমাজ তাকে বেশ্যা বলে অবহিত করছে। এইতো কদিন আগে রাজধানীর বনানীতে এক মেয়ের সাথে অসভ্য আচরণের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সে উল্টো একদল পুরুষের হাতেই লাঞ্ছিত হলো! মেয়েটিকে মলম পার্টির সদস্য অখ্যা দিয়ে প্রকাশ্যে পেটালো তারা, গণধর্ষণও করতে চাইলো! মেয়েটির ভাষ্য মতে, তার সাথে যা করা হয়েছে সেটি ধর্ষণ থেকে কোনো অংশে কম নয়।
ঘটনার বর্ণনায় যতটুকু জানা গছে, প্রতিদিনকার মতো ২৩ আগস্ট সন্ধ্যায় মিরপুর ১০ থেকে বনানীতে টিউশনি করতে যাচ্ছিল মেয়েটি। সৈনিক ক্লাব থেকে পায়ে হেঁটে সে তার ছাত্রের বাসার দিকে রওনা দেয়। এর মধ্যে পিছন থেকে একজন পুরুষ তার নিতম্বে থাপ্পর দিয়ে জোড়ে হাঁটা শুরু করলো। মেয়েটি তার পিছনে দৌঁড়াতে থাকে। এ ঘটনার জোর প্রতিবাদ করে সে। অসভ্য লোকটি যেন পালাতে না পারে, এ জন্য তারে চোখে পিপার স্প্রে করা হয়। তখনি বাধে বিপত্তি।
আশপাশের পুরুষগুলো মেয়েটিকে মলম পার্টির সদস্য হিসেবে অাখ্যায়িত করে হামলে পড়ে তার ওপর। রীতিমতো গণিমতের মাল ভেবে যে যেভাবে পেরেছে গায়ে হাত দিয়েছে, লাথি দিয়েছে এক পর্যায় ধর্ষণ করারও প্রস্তুতি নেয় পুরুষগুলো। ঘটনাক্রমে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। হাজতে ভরে রাখে। ফোন পর্যন্ত করতে দেয়া হয়নি। শেষতক ফোন করার সুযোগ পেলে বাড়ির লোকজন এসে গভীর রাতে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়।
এ ঘটনা শোনার পর অনেকেই বলেছিল, লোকটিকে যেহেতু একদল মানুষ ধরেই ফেলেছিলো তখন পিপার স্প্রে করার কি দরকার ছিলো! আচ্ছা মেনে নিলাম উচিত হয়নি। তাই বলে আপনারা দলবদ্ধভাবে একজন মেয়ের ওপর হামলে পড়বেন! মেয়েটিকে শারীরিকভাবে কিল ঘুষি লাথি মারবেন? আপনাদের ধারণা মতে মেয়েটি যদি মলমপার্টির সদস্যও হয়ে থাকে, তারপরও তো তাকে মারতে পারেন না। কেননা, আইন আছে। পুলিশ খবর দিয়ে তাকে সোপর্দ করতে পারতেন।
তা না করে কী করলেন? আবার পুলিশ কী করলো? মেয়েটিকে একাই তুলে নিয়ে এলো। যারা অন্যায় করেছে তাদের মধ্য থেকে একজনকেও গ্রেপ্তার করেনি!
প্রতিদিন লোকালবাসে নারীরা কী পরিমাণের অসভ্যতামির শিকার হচ্ছে পুরুষ দ্বারা, সে চিত্র চমকে উঠার মতো। দু একজন প্রতিবাদ করছে তো অনেকেই মান সম্মানের ভয়ে, লজ্জায় চুপ করে থাকছে। যারা প্রতিবাদ করছে তাদের সাথে উল্টো অভাবনীয় আচরণ করা হচ্ছে, অসভ্য ব্যক্তির সঙ্গে গলা মিলিয়ে অন্য পুরুষরা বলে উঠে, ‘পাবলিক বাসে এমন একটু-আধটু হবেই, বেশি সমস্যা হলে প্রাইভেট কার কিনে চলাফেরা করুন’। স্কুল কলেজেও কি মেয়েরা নিরাপদ থাকছে? শিক্ষক সহপাঠি দ্বারা যৌন হয়রানিসহ ধর্ষণের শিকারও এ যাবত কম হয়নি।
বাইরের চিত্র না হয় বাদই দিলাম। ঘরের ভেতরেও তো নারী নিরাপদ নয়! বাবা, কাকা, খালু অথবা নিজ অত্মীয় দ্বারা যৌন হয়রানিসহ ধর্ষণের শিকার এ যাবতকাল কম মেয়ে হয়নি। চলতি বছরই এমন বেশ কটি ঘটনা আমাদের সামনে এসেছে। ধর্মশালায়ও মেয়েরা নিরাপত্তা পাচ্ছে না! কিছুদিন আগে পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানতে পেরেছি মসজিদের ভেতরেই ঈমাম কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়েছে এক কন্যাশিশু! সম্প্রতি আরেকটি ঘটনায় জানতে পেলাম, মুয়াজ্জিন কর্তৃক মসজিদের বারান্দায় ধর্ষণের শিকার হয়েছে কন্যাশিশু!
এসব ঘটনা দেখে শুনে এরপরও কি বলবেন নারীরা নিরাপদ? সম্ভবত আজকের নারীদের কাছে বাঘ যতটা না ভয়ঙ্কর তার চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে পুরুষ। আমিও পুরুষ। এসব ঘটনায় আমিও লজ্জিত। আপনিও কি লজ্জিত নন? এক একটি ধর্ষণ ঘটনা পুরো পুরুষ জাতিকেই লজ্জার সাগরে ডুবিয়ে দিচ্ছে। এরপরও মাথা তুলে বড় গলায় আমরা কীভাবে বলতে পারি ‘সব পুরুষ এক না?’ সেই বলার জায়গাটা কি এত এত ধর্ষণ ঘটনার পর সুরক্ষিত আছে বলে মনে করছেন?
আমাদের নীরবতা। রাষ্ট্রের নির্লপ্ততা। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে নারীর প্রতি সহিংস ঘটনা বেড়েই চলেছে। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠাও ধর্ষণ ঘটনা বৃদ্ধির আরেকটি কারণ। এবার অন্তত এসব রোধে সোচ্চার হওয়া দরকার। নয়তো আমাদের পরিবারও পরিত্রাণ পাবে না। এই অসভ্য আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে আমরাও পরিণত হবো।
ধর্ষণের মতো এই অসভ্য আচরণ থেকে রক্ষা পেতে হলে বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে দেশের নির্বাহী বিভাগ পর্যন্ত চাপ সৃষ্টি করতে হবে। এসব ঘটনায় দ্রুত বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি তুলতে হবে। ইয়াসমিন আক্তারের ঘটনায় যেভাবে দেশের সমগ্র মানুষ সোচ্চার হয়েছিলো, একইভাবে আবারও সোচ্চার হতে হবে। দরকার সম্মিলিত প্রতিবাদ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)