চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

চরাঞ্চলের মানুষের উন্নয়নে বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হোক

জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল এখনও সবচেয়ে অবহেলিত এক জনপদ হিসেবে চিহ্নিত। এ কারণেই চরাঞ্চলের অতিদরিদ্ররা যেমন উন্নয়ন বঞ্চিত তেমনি উন্নয়নের মূলধারাতেও তারা সংযুক্ত হতে পারেনি। স্বভাবতই উন্নয়ন ধারা থেকে পিছিয়ে পড়ছে চরের অতিদরিদ্ররা।খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, ক্ষমতায়ন সবদিক দিয়েই দুর্গম চরের মানুষেরা এখনও এক নাজুক অবস্থায় পতিত।

শুধু এই নয়, দেশের ভেতরে থেকেও যেনো বাংলাদেশের চরাঞ্চলের অনেক জায়গাতেই একটি ভিন্ন এবং দুরবর্তী সামাজিক অবস্থা বিরাজ করছে।অথচ আমাদের দুর্দিনে জনসংখ্যার বিস্ফোরণে আগামীদিনের খাদ্যভান্ডার, নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তার উৎসভূমিতে রূপান্তর করা সম্ভব আমাদের এই শত সম্ভাবনার চরাঞ্চলকে। কিন্তু জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় চরাঞ্চল অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার কারণে চর সম্পদের সঠিক ব্যবহার যেমন হচ্ছে না তেমনি চরের অতিদরিদ্ররাও শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সবদিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

তবে চরাঞ্চলে কৃষি বিপ্লবের নতুন নতুন সংবাদ আমাদেরকে ভীষণ আশাবাদী করে। সম্প্রতি একটি দৈনিক পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন চরের বালু জমিতে উচ্চ পুষ্টিসমৃদ্ধ কমলা রংয়ের মিষ্টি আলু চাষ করে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। আবার ভাঙ্গন কবলিত পদ্মা, যমুনা নদীর চরগুলোতে গবাদী পশুর খামার বদলে দিচ্ছে কৃষকের জীবন। পাবনা, রাজশাহীর এসব চরের প্রতিটি কৃষকেরই আয়ের প্রধান উৎস গবাদি পশু। তিস্তা চরের বালুতে বিশেষ পদ্ধতিতে কুমড়ো উৎপাদন বিশ্বখ্যাতি পেয়েছে। রংপুর, লালমনিরহাটের চরগুলোতে ব্যাপকহারে কুমড়ো চাষ হচ্ছে। জামালপুরের বিভিন্ন চরের টমেটো কৃষকের জীবন বদলে দিয়েছে। রাজবাড়ি ও মানিকগঞ্জের চরের মরিচ ঢাকার বাজার আলোকিত করছে। আসলেই নানান ধরণের সবজি, দুধ, মাংসের এখন অন্যতম উৎস দেশের চরাঞ্চল গুলো।

নদীমাতৃক বাংলাদেশের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে চর এলাকা। এর মধ্যে কোনো কোনো চর মূলভূমির সাথে সংযুক্ত। আবার অসংখ্য দুর্গম চর রয়েছে মূলভূমির সাথে যেগুলো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বাংলাদেশের মোট ভূমির বড় এক অংশ চরভূমি। দেশের প্রায় ৩২টি জেলার শতাধিক উপজেলার অংশবিশেষ চরাঞ্চল। প্রায় এককোটি মানুষ চরে জীবনব্যাপী বহুবিধ ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করে। চরবাসীর জীবন মানেই অসংখ্য সমস্যায় নিমজ্জিত সংকটময় এক দূরুহ জীবন।

ভৌগোলিক বিচার-বিশ্লেষণে দ্বীপচর বাংলাদেশের উচ্চমাত্রার দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। দ্বীপচরগুলো প্রচণ্ড রকম নদী ভাঙ্গনের শিকার। ফলে নিরন্তর দুঃখ-কষ্টের এক বঞ্চনাময় জীবন অতিবাহিত করতে হয় তাদের। অবশ্য এই বঞ্চনা একদিন নয়, দীর্ঘদিনের। ফসল উৎপাদনের সুযোগ কম থাকা, দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা, সরকারি সকল ধরণের মৌলিক সেবার অপর্যাপ্ততা, কর্মসংস্থানের স্বল্পতা, পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড না থাকা, খাদ্যাভাব এবং বহুমুখী দুর্যোগপ্রবণ হওয়ার কারণেই দ্বীপচরে বসবাসরত মানুষকে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়।

এ সংগ্রাম জন্মাবধি বললে ভুল হবে না। উৎপাদনমুখী কার্যক্রম সীমিত হওয়ায় বছরের একটা বড় সময় ধরে কর্মহীনতা দ্বীপচরবাসীর  বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে বড় এক অন্তরায়। চরাঞ্চল বাংলাদেশের দরিদ্রতম এলাকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে নানামুখী ঝুঁকির পাশাপাশি সকল প্রকার সরকারি-বেসরকারি সুযোগ সুবিধার অভাব, অপ্রতুলতা কোনো প্রকার অনুসন্ধান ছাড়াই দেখতে পাওয়া যায়।

বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনধারণে সহযোগিতা করতে নানা ধরণের নিরাপত্তামূলক এবং জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন ধরণের উন্নয়নমূলক কর্মসূচি পালন করে থাকে। এর প্রতিফলন দেখা যায় জাতীয় বাজেটেও। কিন্তু বাজেটে চরের মানুষের উন্নয়নে বরাদ্দ ও বাস্তবায়নে চরম অদক্ষতা দেখতে পাচ্ছি। গত অর্থবছরে চরের মানুষের উন্নয়নে একটি টাকাও বরাদ্দ রাখা হয়নি। আবার এর আগের দুটি বছরে অর্থাৎ ২০১৪-১৫ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৫০ কোটি টাকা করে বরাদ্দ রাখা হলেও সেই বরাদ্দের একটি টাকাও খরচ হয়নি। কেন চরের মানুষের জন্যে বরাদ্দকৃত টাকা খরচ হলো না তারও কোনো অনুসন্ধান পাওয়া যায়নি।

চর এলাকায় মানুষ প্রতিদিনই নানামূখী সমস্যার মোকাবিলা করে এটি নতুন বিষয় নয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রথম শিকারও হয় চরের মানূষ। বন্যা, নদীভাঙ্গন, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, প্রচন্ড শীতসহ সকল প্রকার দুর্যোগে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ দুর্ভোগের শিকার হয় এই মানুষগুলো। খাদ্য নিরাপত্তার অভাব অনেক সময় ভয়াবহ রুপে দেখা যায় এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে। দুর্যোগকালীন সময়ে এই দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে।

এছাড়াও দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় চরের মানুষের কাছে পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা হয়নি। চরের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোও বহু সমস্যায় আক্রান্ত। ফলে গর্ভবতী নারী ও নবজাতক শিশুদের প্রয়োজনীয় সেবার নূন্যতম পরিমাণ তাদের কাছে পৌঁছায় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপযুক্ত কাঠামোর অভাব, শিক্ষকদের অনুপস্থিতি, মৌসুমভিত্তিক কার্যক্রমে শিশুদের জড়িত থাকাসহ বিভিন্ন কারণে চর এলাকার সর্বত্র শিক্ষার নাজুক অবস্থা বিদ্যমান। আবার স্কুলের অবস্থান দূরে হওয়ার কারণে চরে প্রচুর শিশু রয়েছে যারা কখনই স্কুলে যেতে পারে না।

আরেকটি জাতীয় বাজেট ঘোষণার সময় আসন্ন। চরের অতিদরিদ্র, অভাবী মানুষেরা তাকিয়ে আছে তাদের উন্নয়নে সরকার কি ভূমিকা নেয় তার দিকে। চর এলাকায় বড় ধরণের পরিবর্তন আনতে হলে বাজেটে যেমন বরাদ্দ আবশ্যক, একই সাথে তা বাস্তবায়নও করার উদ্যোগ নিতে হবে। কৃষি, স্বাস্থ্য, পশুপালন এ সব ক্ষেত্রে চরে বিশেষ ধরণের, বিশেষ উন্নয়নমূলক কর্মসূচিও চালু করা প্রয়োজন রয়েছে। আবার চরের নারীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারলে চরদারিদ্র্য অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব।

এটি সত্য, চরাঞ্চলে অনেক ধরণের রিসোর্স রয়েছে যেগুলো কাজে লাগানো গেলে অর্থনীতিতে বড় ধরণের পরিবর্তন আনা সম্ভব। চরের কৃষি জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার করা গেলে খাদ্যনিরাপত্তায় বড় প্রভাব রাখতে পারে। এ ছাড়া চরে যে জনবল রয়েছে সেই জনবলকে যদি দক্ষ, আরও কর্মক্ষম করে গড়ে তোলা যায়, তাহলে চরাঞ্চলে এক ধরণের বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা অসম্ভব কিছ্ইু নয়। আসন্ন বাজেটে অবশ্যই চরবাসীর উন্নয়নে বিশেষ বরাদ্দ এবং একই সাথে বরাদ্দকৃত টাকা কোথায়, কীভাবে খরচ হবে তার দিকনির্দেশনা রাখতে হবে

স্পষ্টত মনে আছে গত বছর সিরডাপ মিলনায়তনে ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্সের উদ্যোগে চরের স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা শীর্ষক যে জাতীয় সংলাপের আয়োজন করা হয়েছিল সেখানে প্রধান অতিথি ডেপুটি স্পীকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া এমপি, অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান এমপি, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন এবং সমবায় প্রতিমন্ত্রী মো. মশিউর রহমান রাঙ্গা, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ এমপি সহ উপস্থিত সাবেক প্রতিমন্ত্রী মো. মোতাহার হোসেন এমপি এবং কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. মকবুল হোসেন এমপি, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আখম জাহাঙ্গীর হোসাইন এমপি, আব্দুল মজিদ খান এমপি, ফরিদুল হক খান এমপি, আমাতুল কিবরিয়া চৌধুরী এমপি, মো. ইয়াসিন আলী এমপি, গোলাম মোস্তফা এমপি, সফুরা বেগম এমপি, সেলিনা বেগম এমপি, টিপু সুলতান এমপিসহ সবাই চরের মানুষের উন্নয়নে বাজেটে সুস্পষ্ট বরাদ্দ এবং একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গঠনে ঐক্যমত পোষণ করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের চরের মানুষের উন্নয়নে আন্তরিক একথা তিনি বহুবার বহু সভায় বলেছেন। কিন্তু কেন জানি চরবাসীর উন্নয়নে সঠিক কোনো স্থায়ীত্বশীল উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না।

চরের মানুষকে অবহেলা অবজ্ঞা করে দেশের উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। উপেক্ষা আর বৈষম্য নয়, চরের মানুষের দিকে সহানুভূতির দিকে তাকাতে হবে। চর এলাকায় বড় ধরণের পরিবর্তন আনতে হলে শুধু বাজেটে বরাদ্দ নয়, একই সাথে তা বাস্তবায়নও করার উদ্যোগ নিতে হবে। ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্স এর চেয়ারম্যান খন্দকার ইব্রাহীম খালেদ অনেকবার বলেছেন, বাজেটে চরের মানুষের উন্নয়নে বরাদ্দ দিয়ে খরচ করতে না পারাটা দুঃখজনক। এটি এক ধরণের অদক্ষতাও বটে। তাঁর মতে, শুধু বরাদ্দ দিলে হবে না সেক্ষেত্রে একটি নীতিমালা বা দিকনির্দেশনা দিতে হবে, যে কিভাবে টাকাটা কোথায়, কোন খাতে কীভাবে খরচ হবে।

এ জন্যে তিনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে চরাঞ্চলের জন্য লাইন মিনিস্ট্রি হিসেবে ঘোষণার জন্যে অনেকবার দাবি করেছেন। চরের মানুষের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে একটি চর ফাউন্ডেশন এর মতো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোরও প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি বলেছেন। আমার মতে, চরের মানুষের স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে চরের মানুষের জন্যে বাজেটে সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ দিতে হবে। সেই বরাদ্দ খরচের দিকনির্দেশনা দিতে হবে। চরের মানুষের স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি জাতীয় চর ফাউন্ডেশন বা কোনো ধরণের কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)