চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

চরবাসীর উন্নয়নে বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ কেন খরচ হয় না?

জাতীয় বাজেটে প্রায় প্রতি অর্থবছরেই চরের মানুষের উন্নয়নে থোক বরাদ্দ দেওয়া হলেও সেই অর্থ খরচ হচ্ছে না। কেন খরচ হয় না এর কোনো জবাবদিহিতা নেই। কেউ খবরও রাখেন না। অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কেউ বলতেও পারে না বরাদ্দকৃত অর্থ কেন খরচ হয় না। আর তাই চরবাসীর উন্নয়নের নামে বরাদ্দকৃত টাকা শুধু বাজেটের পাতাতেই থেকে যাচ্ছে। টানা কয়েকবছর ধরে এভাবেই চলছে।

২০১৪-১৫ অর্থবছরে চরের মানুষের উন্নয়নে যে ৫০ কোটি টাকা অর্থ থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল তার পুরো টাকাটাই অব্যবহৃত থেকে যায়। একটি টাকাও খরচ করা হয়নি। একইভাবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আবারও চরবাসীর উন্নয়নে থোক ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু চরবাসী তার কোনো সুফল পায়নি। সর্বশেষ অর্থবছরেও চর এবং হাওরের মানুষের উন্নয়নে সম্মিলিতভাবে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে কিন্তু কোনো টাকা এখনও খরচ হয়নি।

এর আগে ২০১১-২০১২, ২০১২-২০১৩ এবং ২০১৩-২০১৪ অর্থ বাজেটে চরের অতিদরিদ্র মানুষের সার্বিক জীবন মান উন্নয়নে আলাদা করে জাতীয় বাজেটে সুনিদ্দিষ্টভাবে কোনো বিশেষ বরাদ্দ রাখা ছিল না। চরের মানুষ একেবারেই উপেক্ষিত ছিল। এতে করে চরের মানুষেরা চরমভাবে উন্নয়ন বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হয়। চর এলাকার মানুষের উন্নয়নের জন্য সরকারি ভাবে জাতীয় বাজেটে প্রথম বারের মত বিশেষ বরাদ্দের ঘোষণা আসে ২০০৯-১০ অর্থ বছরে। ঐ অর্থ বছরে বরাদ্দের প্রস্তাবিত পরিমাণ ছিল ১৮১ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা। পরের বছর ২০১০-১১ অর্থ বছর এই বরাদ্দের প্রস্তাবিত পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৫৪৬ কোটি ৬৮ লক্ষ টাকা। চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ২০০৯-১০ এবং ২০১০-১১ অর্থবছরে যে বরাদ্দ ঘোষনা করা হয় সে সময়কালেও কোন সুনির্দিষ্ট সেবা চরের মানুষের কাছে পৌছেঁনি। বরাদ্দে সুনির্দিষ্টভাবে চরাঞ্চলের জন্য খাত উল্লেখ না থাকায় বরাদ্দ ও ব্যয়ের কোন ধরণের তথ্যও জানা সম্ভব হয়নি। যদ্দুর জানা যায় উল্লিখিত দুটি অর্থবছরে চরের উন্নয়নে বরাদ্দ প্রদান করা হলেও সেই অর্থ থেকে যায় খরচ হয়নি। দেখা যাচ্ছে ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে আজ অব্দি চরের মানুষের সামগ্রিক জীবন মান উন্নয়নে জাতীয় বাজেটে যে থোক বরাদ্দ প্রদান করা হয় সেই অর্থ কোনো প্রক্রিয়াতেই খরচ হয়নি।

আমরা কয়েক বছর ধরেই খেয়াল করছি চরের মানুষের জীবন মান উন্নয়নে সরকারের বরাদ্দৃকত অর্থ খরচের কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বা পরিকল্পনা নেই। আর তাই বাজেটে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা খরচ করা হচ্ছে না। অথচ দুর্গম চরের হতদরিদ্র মানুষগুলো সীমাহীন সমস্যায় জর্জরিত। দেশের দুর্গম চরাঞ্চল এখনও অবহেলিত এক জনপদ। বলা যায়, দুর্গম চরাঞ্চলে সেই অর্থে কোনো উন্নয়ন হয়নি। আর তাই চরবাসীকে শত দুর্যোগ মোকাবিলা করে বহুবিধ সমস্যার মধ্যেই জীবনযাপন করতে হয়।

সংবিধানে যে সব মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে চরবাসীর জীবনে তার প্রতিফলন বা বাস্তবায়ন কিছুই নেই। খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা-সবখানেই চরবাসী পিছিয়ে। এই পিছিয়ে থাকার বহুবিধ কারণ হলো-চরম যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা, সম্পদহীনতা এবং সরকারি সেবার অপ্রতুলতা। তবে বিভিন্ন চরাঞ্চলে দাতাদের সহযোগিতায় উন্নয়ন সগগঠনগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রকল্পভিত্তিক কর্মপ্রক্রিয়ার মধ্যে চরের অতিদরিদ্রদের ক্ষমতায়ন, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, সম্পদ সৃষ্টি এবং সরকারি সেবা প্রাপ্তির জন্যে নিরবিচ্ছন্ন কাজ করছে।

কেয়ার বাংলাদেশ, প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন, অক্সফাম বাংলাদেশ, কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড, আরডিআরএস, ব্র্যাকসহ বেশকিছু আন্তর্জাতিক ও জাতীয় উন্নয়ন সহযোগী ও সংস্থা চরের মানুষের উন্নয়নে কাজ করছে।

চরাঞ্চলের উন্নয়নে এ যাবৎকাল সরকারের পক্ষ থেকে বড় ধরনের খুব ভালো কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এখন পর্যন্ত যা হচ্ছে সেটা দাতাগোষ্ঠীর অর্থায়নে উন্নয়ন সংগঠনগুলো যতটুকু করছে। ফলে অনেক আগে থেকেই চর নিয়ে যেসব উন্নয়ন সংগঠন মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে তাদের একটি বড় দাবি ছিল চরের মানুষের উন্নয়নে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ এবং তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে কখনও কখনও বরাদ্দ দেওয়া হলেও বরাদ্দকৃত টাকা পড়ে থাকছে তার সুফল কোনোভাবেই চরের মানুষের কাছে যাচ্ছে না।

বহু নদ-নদী বেষ্টিত বাংলাদেশের একটি বড় অংশ চরভূমি হিসেবে পরিচিত। মূলভূমির সাথে যুক্ত চর, দ্বীপচর, উপকূলীয় চর, অস্থায়ী চর- সব মিলিয়ে এসব চরে প্রায় ১ কোটি মানুষ বসবাস করে। বাংলাদেশের মোট ভূমির প্রায় ১০ শতাংশ চরভূমি । দেশের প্রায় ৩২টি জেলার ১০০ উপজেলার অংশবিশেষ জুড়ে বিস্তৃত এই চরাঞ্চল। তীব্র নদী ভাঙ্গন, বন্যা, খরাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মৌসুমী বেকারত্ব এসব মোকাবিলা করেই বছরের প্রায় পুরো সময়টা ধরেই চরের মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়। প্রতিবছর গড়ে ৫০ হাজার মানুষ নদী ভাঙনের শিকার হয়ে গৃহহীন হয়ে পড়ে। এ বছর বন্যায়ও চরের মানুষ ফসলি জমি, ঘরবাড়ি এবং অন্যান্য সম্পদ হারিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ ঝুঁকির দেশে পরিণত করেছে। নদীবাহিত এদেশের চরাঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠী এই দুর্যোগের প্রথম ও প্রধান শিকার। দেশের দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীর বসবাস চরাঞ্চলে। প্রতিবছরই চরের মানুষকে তাদের সম্পদ হারাতে হচ্ছে বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ও ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে না হয় জীবন ধারণের প্রাত্যহিক চাহিদা মেটাতে।

চরে বসবাসরত মানুষগুলো জীবন ধারণের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারে না। খাদ্যাভাব পূরণ করাই তাদের কাছে প্রধান চিন্তার বিষয়। এছাড়া কৃষি সেবা, চিকিৎসা সেবা, শিক্ষা সেবাসহ অপরাপর সরকারি সেবাসমূহ এখনও তাদের নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন ও দুর্গম হওয়ায় সরকারি বা বেসরকারি বিভিন্ন সেবা ও সহযোগিতা চর এলাকায় ঠিকমত পৌঁছায় না। যেটুকু যায় তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্যও বটে।
চর এলাকায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হলে শুধু বাজেটে লোক দেখানো বরাদ্দ নয়, একই সাথে তা বাস্তবায়নও করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ বিষয়ে কিছুদিন চরবিষয়ক একটি মতবিনিময় সভায় সাবেক প্রতিমন্ত্রী আখম জাহঙ্গীর হোসাইন এমপি বলেছিলেন, চরের মানুষের উন্নয়নে বরাদ্দ দিয়ে তা খরচ না করাটা চরম অন্যায়। এটি অদক্ষতারও প্রমাণ। তার মতে, শুধু বরাদ্দ দিলেই হবে না। সুস্পষ্ট করে বলতে হবে, বরাদ্দকৃত টাকা কোন কোন খাতে কীভাবে খরচ হবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)