ফের রক্ত ঝরেছে জার্মানিতে। ঠিক যেভাবে গুলশান, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইরাক, প্যালেস্টাইন রক্তাক্ত হয়েছে এই রক্তপাতও তেমনই। পদ্মা থেকে রাইন, কঙ্গো থেকে ভলগা, টেমস থেকে নীল নদের পাড় আজ মানুষের রক্তে রক্তাক্ত। কারা মারছে? সংখ্যায় তারা কতজন? না। মোটেই বেশি না এই ঘাতকদের সংখ্যা। কিন্তু তারাই আজ গোটা দুনিয়ার শান্তিকামী মানুষের জন্য ভয়াবহ আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে। দিশাহীন হয়ে পড়েছে।
আইএস কি ইরাক ও সিরিয়ায় কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়ায় রণ কৌশল বদলাচ্ছে? ইসলামী খেলাফত কায়েমের কথা বলে যে যুদ্ধের সূচনা করা হয়েছিল ইরাক ও সিরিয়ায় তা কি ধীরে ধীরে গুপ্ত হামলার আদলে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়বে? সাম্প্রতিক হামলাগুলো সেরকম ইঙ্গিতই দিচ্ছে। এমন চলতে থাকলে তথাকথিত ইসলামী জঙ্গি সংগঠনগুলোর কারণে আগামী দিনগুলোতে হয়ত রক্তের স্রোত আরো দীর্ঘ হবে।
এবার কি জঙ্গিরা জার্মানিতে আক্রমণ শুরু করল? মাত্র এক সপ্তাহের মাথায় ফের সন্ত্রাস। গেল সপ্তাহে ফ্রান্সের নিস শহরে ট্রাকচালক পিষে মেরেছিল ৮৪ জনকে। আর শুক্রবার জার্মানির মিউনিখ শহরের এক রেস্তোরাঁ এবং শপিং মলে ভর সন্ধেবেলা হামলা চালিয়ে অন্তত ৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে। আহত হয়েছেন অনেকেই। পুলিশেরও আশঙ্কা, মৃতের সংখ্যা বাড়তে পারে।
এ সপ্তাহের গোড়াতেই জার্মানির বাভেরিয়ায় লোকাল ট্রেনে কুড়াল আর ছুরি নিয়ে চড়াও হয়েছিল ১৭ বছরের এক কিশোর। আফগান শরণার্থী সেই কিশোরের আক্রমণে আহত হন পাঁচ জন। পুলিশ তাকে গুলি করে মারে। পরে তার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে হাতে আঁকা ইসলামিক স্টেটের (আইএস) পতাকা মিলেছিল। পাওয়া গিয়েছিল একটি ভিডিও-ও। যাতে আইএসের প্রতি সমর্থনের কথা জানিয়েছিল ওই কিশোর।
মিউনিখের হামলা কী কারণে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। রাত পর্যন্ত কেউ হামলার দায় নেয়নি। তবে ‘উচ্ছ্বাস’প্রকাশ করেছে ‘ইসলামিক স্টেটের সমর্থক’বলে দাবি করা একটি গোষ্ঠী। আরবি ভাষায় লেখা টুইটে তারা বলেছে, ‘আল্লাকে ধন্যবাদ। আল্লা ইসলামিক স্টেটের সদস্যদের সমৃদ্ধশালী করুন। ইউরোপে ইসলামিক স্টেট ছড়িয়ে পড়ছে।’
গত ১০ মাসে জার্মানিতে একের পর এক ঘটনা প্রমাণ করেছে, সন্ত্রাসবাদীরা যে কোনও সময় হামলা চালাতে পারে। পাঁচ দিনে দুটি আক্রমণ সেই আশঙ্কাই সত্যি প্রমাণ করল। এই ঘটনায় স্বভাবতই আতঙ্ক ছড়িয়েছে মিউনিখে। সর্বশেষ জার্মান পুলিশ বলেছে, শুক্রবার শপিং মলে হামলাকারী ছিল একজনই। তার বয়স ১৮ বছর। তিনি ইরানি বংশোদ্ভূত জার্মান নাগরিক। সে আত্মহত্যা করেছে বলে পুলিশের অনুমান। ওই তরুণের মাথায় গুলির চিহ্ন রয়েছে। হামলাকারী ওই তরুণের দেহ অলিম্পিয়া শপিং সেন্টার নামের ওই বিপণিকেন্দ্র থেকে এক কিলোমিটার দূরে পড়ে ছিল।
দেখা যাচ্ছে, গুলশানে যারা হামলা করেছে, প্যারিস, জার্মানিতে যারা হামলায় অংশ নিয়েছে, তারা সবাই কিশোর বা যুবক। ১৭ থেকে ২৫ বছর বয়সী কিশোর বা টগবগে যুবক। তারা কেন এমন ঘটনায় জড়াচ্ছে? কেন তারা বিগড়ে যাচ্ছে? দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ এক সময় লিখেছিলেন, যে বয়সে পুরুষ ভালোবাসে নারীকে,/সে বয়সে তুমি/ভালোবেসেছিলে তোমার মাতৃভূমি, দক্ষিণ আফ্রিকাকে।/যে বয়সে পুরুষ প্রার্থনা করে প্রেয়সীর বরমাল্য,/সে বয়সে/তোমার কন্ঠ রুদ্ধ হয়েছে ফাঁসির রজ্জুতে/যে বয়সে/পুরুষের গ্রীবা আকাঙ্ক্ষা করে/রমনীয় কোমল বাহুর ব্যগ্র-মুগ্ধ আলিঙ্গন;/সে বয়সে/তোমাকে আলিঙ্গন করেছে/মৃত্যুর হিমশীতল বাহু।’
পৃথিবীর নানা প্রান্তে সংঘটিত বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনাকারী কিশোর-যুবদের করুণ পরিণতি দেখে নির্মলেন্দু গুণের এই কবিতাটির কথাই বার বার মনে হচ্ছে। তরুণ-কিশোররা কেন, কিসের মোহে এমন ঠাণ্ডা মাথার খুনী হয়ে যাচ্ছে? কী তাদের প্রণোদনা? কোথায় যুবদের সমস্যা? কেন তারা প্রেমিক না হয়ে সন্ত্রাসী হচ্ছে? নিরীহ মানুষের রক্ত নিয়ে হোলি খেলছে? যে জীবন প্রত্যেকের প্রিয় সম্পদ, সেই জীবনকে তুচ্ছ করে আত্মঘাতী হচ্ছে? পৃথিবীর আজ এ কোন অসুখ? এই অসুখের নিরাময় কীভাবে? মানুষ খুনের নেশা কী ধরনের ‘মানসিক রোগ?’ ঠা-ঠা গুলি করে মানুষ হত্যার পাগলামী কেন যুব-তরুণদের পেয়ে বসল?
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসী হামলার ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়ছে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর। আর এর সামগ্রিক অভিঘাতে জর্জরিত হচ্ছে পুরো মানবজাতি। দেশে দেশে আইএসের দাবিকৃত বর্বর হামলার সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া গিয়ে পড়ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত অভিবাসী মুসলিম সম্প্রদায় এবং সিরিয়া, লিবিয়া ,আফগানিস্থান থেকে ইউরোপে আশ্রয়প্রার্থী লাখ লাখ শরণার্থীর উপর। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর পর থেকে গৃহহীন হয়েছে প্রায় এক কোটি মানুষ। গত কয়েক বছরে ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে সমুদ্র পাড় হয়ে ইউরোপে আশ্রয় পেয়েছে প্রায় এক লাখ মানুষ । শরণার্থীদের আরো একটি বড় অংশ এখনো ইউরোপে আশ্রয় পাবার প্রত্যাশায় দিন গুণছে।
ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানীতে সংঘটিত হামলার ফলে এই শরণার্থীদের জীবন এখন আরো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ইউরোপে শরণার্থী বিরোধী জনমতকে চাঙ্গা করবে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের প্রবল আপত্তির পরও জার্মানী শরণার্থীদের প্রতি উদার মনোভাব দেখিয়েছিল। এখন জার্মানিতেও যদি জঙ্গি হামলা হয়, এবং হামলাকারীদের পরিচয় ‘মুসলিম অভিবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত হয়, তাহলে জার্মানিতেও শরণার্থী বিরোধী জনমতের চাপ বাড়বে।
শরণার্থীদের আশ্রয় দানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় যে যুক্তিটি উপস্থাপন করা হচ্ছে তা হল এই শরণার্থীদের হাত ধরে ইউরোপে আইএস প্রবেশ করবে যেটা নিরাপত্তা আশঙ্কাকে বৃদ্ধি করবে। একই সংঙ্গে লঙ্ঘিত হবে খ্রিস্টান মুল্যবোধ। যদিও এই শরণার্থীদের প্রায় সবাই মধ্য প্রাচ্যে আইএস এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীগত যুদ্ধের দানবীয় ধবংস লীলা থেকে বাঁচতেই ইউরোপে আশ্রয় প্রার্থী হয়েছে। তারপরও এদের মধ্যে আইএসের উপর সহানুভুতিশীল ব্যক্তি থাকার সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই।
পাশাপাশি এই বিপুল সংখ্যক মুসলিম অভিবাসীকে ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে সংযুক্ত করার কাজটিও কম চ্যালেঞ্জিং নয়। মুল ধারার ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে সংযুক্ত করতে না পারলে এই অভিবাসীদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বোধ আরো বাড়বে এবং এর ফল ঘরে তুলতে পারে আইএসের মত ইসলামী জঙ্গিরা। একদিকে ধর্মীয় ও জাতিগত অসহিষ্ণুতা রোধ করে ইউরোপের উদার সংস্কৃতি রক্ষা অপরদিকে ক্রম বর্ধমান নিরাপত্তা আশঙ্কা, সব মিলিয়ে পুরো পরিস্থিতিটাই এখন ইউরোপের জন্য চ্যালেঞ্জিং। এর মধ্যে মিউনিখের হামলা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ধর্মের কিছু কিছু কাহিনী বিন্যাসে মানুষের সহিংস ও হিতাহিত জ্ঞানশূন্য আত্মঘাতী হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট উস্কানি রয়েছে। অনেকেই ভুল-ভাল বুঝিয়ে যুবদের বিপথে পরিচালিত করছে। ধর্মের কট্টর অনুসারীরা জীবন-মরণকে নগণ্য ভেবে পার্থিব জীবনের সুখ-শান্তি প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিকে পিছনে রেখে ধর্মের বিস্তার ও ‘স্রষ্টার সান্নিধ্য ও আনুগত্য লাভকে’ই এক মাত্র সত্য বানিয়ে পরকালে অনন্ত শান্তি ও যাবতীয় ভোগ্যবস্তু লাভের অন্ধমোহে নিজেদের অবস্থানকে সর্বাগ্রে রেখে বাকি সব কিছুকে ধ্বংস করার এক দুর্বার অনুপ্রেরণা লাভ করছে।
তাহলে তরুণ সম্প্রদায়ের এই যে ‘অসুখ’, সন্ত্রাসী-জঙ্গি হয়ে মানুষ মারা ও নিজে মরার প্রবণতা-এটা থেকে রেহাই মিলবে কীভাবে? জার্মানিতে সর্বশেষ যে হামলা পরিচালিত হয়েছে, এই জাতীয় ‘ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত হামলা’ ঠেকানো কঠিন যতক্ষণ পর্যন্ত না মুসলিমদের মাঝে সামগ্রিক চেতনাগত পরিবর্তন সাধিত হয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা কতটুকু? ‘সঠিক ধর্মীয় শিক্ষা’ কে, কাকে দেবে? আর ‘বিকৃত ধর্মীয় শিক্ষা’র বিস্তার রোধ করাই বা কীভাবে সম্ভব? তাহলে কী আমরা এক অন্তহীন সন্ত্রাসবাদের মধ্যে নিপতিত হতে চলেছি?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)