চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

গাধা, ঘোলা পানি ও তিস্তার পানি

গাধা নাকি ঘোলা পানি পান করে। এটা কেন করে – সে সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। সমস্যা হলো কোনো মহামহিম গাধাও এখনো পর্যন্ত কাউকে বিষয়টি স্পষ্ট করে জানায়নি। তাই বলে অবশ্য বিষয়টি দুর্জ্ঞেয় রয়ে যায়নি। আমাদের মতো এমন ‘বিশেষজ্ঞ’-এর দেশে গাধা বিশেষজ্ঞও একবারে কম নেই (লেখক নিজেও কম যান না!)। এই স্বনামধন্য গাধা বিশেষজ্ঞদের মতে, গাধা যে ইচ্ছে করেই ঘোলা পানি পান করে, তা নয়। গাধা আসলে পরিষ্কার পানিই পান করতে চায়। কিন্তু নিজের মূর্খতার কারণে শেষ পর্যন্ত সেটা ঘোলা হয়ে যায়।

ব্যাপারটা খোলাসা করেই বলা যাক। সাধারণত গাধারা নদী, পুকুর, ডোবা, খাল-বিলের পানি পান করে থাকে। পানি পান করতে নেমে গাধা মনে করে জলটা যথেষ্ট পরিষ্কার নয়। এরপর গাধা তার নিজস্ব স্টাইলে জল পরিষ্কারের নামে সেখানে কিছুক্ষণ লাফালাফি, দাপাদাপি করে। এতে পানি খুব দ্রুতই ঘোলা হয়ে যায়। এরপর গাধা নিশ্চিন্তে সে পানি পান করে। গাধা তার নির্বুদ্ধিতা বা খাসলতের কারণেই ঘোলা পানি পান করে।

আমাদের সমাজে কিছু কিছু মানুষ আছে যারা গাধার চেয়ে অধম। কিন্তু সমস্যা হলো, তারা যে গাধার চেয়ে অধম – এ তথ্যটা তারা নিজেরা জানেই না। কেউ যদি জানানোর চেষ্টা করে তাহলে তারা ক্ষমতাসীন দলের উগ্র সমর্থকদের মতো ক্ষেপে যান।

‘গাধা’ সম্বোধনটা তাই পরম শ্রদ্ধেয় মা-বাবা আর প্রিয়তমা স্ত্রী ছাড়া অন্য কারও মুখ থেকে কখনোই কেউ আশা করেন না। এগুলো সাধারণ জ্ঞানের কথা। এগুলো জেনে রাখা ভালো। কেননা সাধারণ জ্ঞানে ভালো না হলে এ যুগে ‘অসাধারণ’ হওয়া যায় না। যাক এসব তত্ত্ব-কথা। আমাদের দেশের মানুষ জেনেশুনেবুঝে ঘোলা পানি পান করতে চায় না বটে; কিন্তু ওয়াসা কিংবা নদী-পুকুর – যেখানে ঘোলা পানিই একমাত্র সম্বল, সেখানে পরিষ্কার পানি পান করাটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

অনন্যোপায় হয়ে অনেকে ঘোলা পানি পান করতে বাধ্য হলেও আমাদের দেশের মানুষ কিন্তু ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার’ করতে ভীষণ পছন্দ করে। বিশেষ করে চতুর মানুষেরা। আর এ কথা কে না জানে যে, আমাদের সমাজে চতুর মানুষের সংখ্যাই বেশি? ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অবশ্য অনেক সুবিধা আছে। এতে নিজের ইচ্ছের বাস্তবায়ন করা যায়। যদি ইচ্ছে হয় যে মাছ ধরব না, তাহলে তাই করা যায়। আবার ইচ্ছে হলে খানিকক্ষণ হাত চালিয়ে বলে দেওয়া যায়, এখানে মাছ নেই। আবার ইচ্ছে হলে দুয়েকটি ছোট মাছ ধরাও যায়। পানি ঘোলা হলে মাছ ধরা না-ধরা, মাছ পাওয়া না-পাওয়া এমনকি মাছ থাকা না-থাকা নিয়ে যা খুশি তাই বলে দেওয়া যায়। এক্ষেত্রে শিকারি যা বলবে তাই সই। শিকারির কথাকে মিথ্যে প্রমাণ করা কঠিন।

কিন্তু পানি যদি পরিষ্কার হয় এবং গভীরতা কম হয় তাহলে যে কেউ বলতে পারে পানির নিচে কি মাছ আছে, কোথায় আছে। কারণ পরিষ্কার পানিতে মাছের গতিবিধি বা বিচরণ দেখা যায়। শিকারি যদি ইচ্ছেমতো বড়ো মাছের জায়গায় ছোট মাছ ধরেন অথবা মাছ না-ধরেন, তাহলে এ ব্যাপারে অতিউৎসাহীরা কথা বলেন বা বা আপত্তি তোলেন। শিকারি এক্ষেত্রে মাছ ধরা নিয়ে, মাছ থাকা না-থাকা নিয়ে মনগড়া বক্তব্য রাখার সুযোগ বড়ো বেশি পান না। প্রতিশ্রুত মাছ ধরতে সে বাধ্য হন। কিন্তু কোনোরকমে পানিটা যদি একবার ঘোলা করা যায় তাহলে আর কোনো দায়-দায়িত্ব থাকে না। কারও কাছে জবাবদিহিও করতে হয় না। সেজন্য মতলববাজরা সব সময় ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চান।

আমাদের দেশের রাজনীতিতে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের প্রবণতা অসম্ভব বেশি। রাজনীতিবিদরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের আগ্রহ দেখান। এতে তাদের সুবিধে হয়। ইচ্ছেমতো মাছ ধরতে পারেন। স্বার্থের অনুকূলে না হলে মাছ ধরা থেকে বিরতও থাকতে পারেন। একে অন্যকে দায়ী করতে পারেন। সেজন্য তারা সবার আগে পানি ঘোলা করার ব্যাপারে মনোনিবেশ করেন। পানি যথেষ্ট ঘোলা হলেই কেবল তারা মাছ ধরতে প্রস্তুত হন। পছন্দের মাছ পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে তারা জলেই নামেন না। চুপচাপ বসে থাকেন। অথবা ‘মাছ পাওয়া যাচ্ছে না’ – বলে ঘোষণা দেন।

বর্তমানে ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে চলছে ‘পানি ঘোলা’ করার একটা প্রবণতা। অনেকে এ চুক্তি না হওয়ার জন্য দায়ী করছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়কে। আবার অনেকে বলছেন, মমতার ওপর দায় চাপিয়ে আসলে সুচতুর মোদি সরকার বাংলাদেশকে ঠকাতে চায়। এদিকে আরেক শ্রেণির মানুষ সরাসরি শেখ হাসিনাকে দায়ী করে ‘নতজানু পররাষ্ট্র নীতির’ কারণেই এই চুক্তি হচ্ছে না বলে মন্তব্য করছেন। সব মিলিয়ে পানি পুরোমাত্রায় ঘোলা বানিয়ে ফেলা হয়েছে।

ফলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান ভারত সফরের প্রধান আলোচ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে তিস্তার পানি। তিস্তা ব্যারেজের ফলে তিস্তার পানি বাংলাদেশে বইয়ে দেওয়ায় প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক পথে যে বিঘ্ন তৈরি হয়েছে ও পানি ছাড়ার একচেটিয়া অধিকার যে ভারতের হাতে চলে গেছে, সেই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকায় চাষের প্রয়োজনীয় পানি পাওয়াই বাংলাদেশের প্রধান দাবি।

বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী যদি এই চুক্তি হচ্ছে না বলে শীর্ষ কূটনৈতিক পর্যায়ে আগেই জানানো হয়। এর পর থেকেই সব আলোচনা গিয়ে গড়ায় তিস্তার পানি চুক্তিতে। অন্য অনেক ইস্যুতে ইতিবাচক সমঝোতা হলেও এই ইস্যুতে শেখ হাসিনা ও ভারতকে ধরার একটা মোক্ষম সুযোগ সমালোচকরা ছাড়বে কেন? তাই তো সমালোচকরা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পানি ঘোলা করার উৎসবে নেমেছেন!

অবশ্য গঙ্গা-তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বিরোধ জন্মলগ্ন থেকেই চলছে। এ ক্ষেত্রে অভিযোগের তীর সব সময়ই ভারতের বিরুদ্ধে। তিস্তার পানি বন্টন সংক্রান্ত চুক্তিটি ২০১১ সালে চুড়ান্ত হলেও গত ছয় বছরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরম বিরোধিতার কারণে স্বাক্ষর করা হয়নি। এবারও তিনি এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ৬৬ বছর জুড়ে ঝুলে থাকা ছিটমহল সমস্যা আমরা মিটিয়ে দিয়েছি। রাজ্যের স্বার্থ আমাকে দেখতে হবে। বাংলার কল্যাণকে অক্ষুণ্ন রেখে বাংলাদেশকে সাহায্য করা হবে। এই বক্তব্যের মধ্যে এটা স্পষ্ট যে, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ঘোলা জলে মাছ শিকারের নীতি গ্রহণ করেছেন!

যদিও নদীর পানি নিয়ে এমনটা হওয়ার কথা নয়। তখনই কথা হয়, যখন নদীর পানি, আকাশের হাওয়া, প্রাকৃতিক অরণ্য, পাহাড়ের বরফ—এমন সব নৈসর্গিক ও স্বাভাবিক বিষয়ের ওপর রাষ্ট্র তার দখল কায়েম করে। সমুদ্রের পানির মতো প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর দখলদারি জারি করেই সাম্রাজ্যবাদ শুরু।

অনেকে বলেন, তিস্তা ব্যারেজ যদি না হত তা হলেই তো এই সমস্যা তৈরি হত না। তিস্তার পানি মহানন্দায় ফেলে মহনন্দার খাত দিয়ে গঙ্গায় ফেলার পরিকল্পনা থেকে তিস্তা ক্যানাল কাটা হয়েছে। এরপর থেকেই তিস্তা দিয়ে বাংলাদেশে পানি প্রবাহ কমতে শুরু করেছে।

এখন ভারতের রাজনীতিকদের কাছে আমাদের আকুল আবেদন, তিস্তার মতো মহৎ নদীকে নদীতে ফিরিয়ে দিন। আপনারা ঘোষণা করুন, নদীকে আটকাবার জন্য ব্যারেজ থাকবে না। নদী ব্যারেজহীন, নদী তার প্রাকৃতিক প্রবাহ পথে ফিরে যাক। নদী কেন এমন সীমান্ত মানবে, যে সীমান্ত সে নিজে তৈরি করেনি?

আশা করি তিস্তার পানি নিয়ে পানি ঘোলা করার খেলা সংশ্লিষ্ট সবাই বন্ধ করবেন। কেননা পানি ঘোলা করার এই প্রবণতা অত্যন্ত অমর্যাদাকর। এটা হচ্ছে ‘গাধার কাণ্ড’। মানুষই যদি গাধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তাহলে গাধারা কী করবে? মানুষের না থাক, গাধাদের তো একটা ইজ্জত আছে!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)