চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

গণমাধ্যমে শঙ্কর ভাষা (পর্ব-৪)

প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, মুখ থেকে কলমে ভাষা যায়। প্রমথ চৌধুরীর সময় কলমের সংখ্যা কম ছিল। আজ আর তা নেই। আজ কলমের সংখ্যা বেড়েছে। ইচ্ছে করলেই দু’কলম প্রচার করা সম্ভব। তা সে হোক স্বল্প বা বেশি পরিসরে। আর সেই জন্য কলম থেকে মানুষের মুখে সংক্রমিত হওয়ার সংখ্যাও বেশি।

কলম বলতে গণমাধ্যমকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। পত্রিকা, বই, বেতার টেলিভিশন, ইত্যাদি। এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে সব ছক বদলে গেছে। কোন প্রকার বিনিয়োগ বা প্রতিষ্ঠান ছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহার করে নিজেকে প্রচার করা সম্ভব। গণমাধ্যম অনেক বেশি মানুষের দোরগোড়ায়। তাই এর ভাষা অবশ্যই প্রভাব ফেলছে মানুষের কথা বলায়।

কোন কোন ভাষা বিজ্ঞানী মনে করেন, ভাষা নিয়ে ভাবার কিছু নেই। নদীর স্রোতের মত তার নিজের ইচ্ছায় চলতে থাকবে। ভাঙবে আবার গড়বে। আবার অনেকে মনে করেন, একে উপযোগি করে পরিচালনা প্রয়োজন। ভাষাকে সুন্দর করার এবং ধরে রাখার জন্য কট্টর, সংরক্ষণবাদী অবস্থানে আছে বেশিরভাগ জাতি গোষ্ঠী। আর অল্প সংখ্যক অবহেলা করাদের দলে আছি আমরা। আকাশ সংস্কৃতি আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশেই বেশি প্রভাব ফেলছে।

ভাষা প্রকৃতির মত রূপ বদলাবে। এটা স্বাভাবিক। নতুন কিছু আসবে। কিছু চলে যাবে। অর্থাৎ যোগ হবে, বিয়োগ হবে। কিন্তু তার মধ্যেও একটা স্বাভাবিকতা থাকতে হবে। ভাষার পথ চলায়, রূপ পরিবর্তনে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনেক। গণমাধ্যম ভাষার স্বাভাবিক গতিপথে ধাক্কা দিচ্ছে। এর ভাল মন্দ বিচার করবে সময়।

মানুষের মুখ থেকে কথা নিয়েই তো ভাষা। গণমানুষের মুখের কথা নিয়েই ভাষা। আর গণমানুষের জন্যই গণমাধ্যম। গণমাধ্যম মানুষকে তথ্য দিচ্ছে। আর দিচ্ছে বিনোদন। মানুষের সুখ দুঃখ, হাসি কান্না, প্রেম বিরহ প্রকাশ করছে। জানিয়ে দিচ্ছে দেশ বিদেশের তথ্য। আর এই বিদেশি তথ্য বা প্রযুক্তি বিনিময়ের সময় পরিবর্তন হচ্ছে ভাষা। আর এখানে সেতুর কাজ করছে গণমাধ্যম। প্রযুক্তির নতুন কিছু আসলে আগে নতুন শব্দ তৈরির উদ্যোগ ছিল। গণমাধ্যম বা যারা লেখালেখি করেন তারা সেই দায়িত্ব ঘাড় পেতে নিয়েছে। কিন্তু এখন খুবই কম। নেই বললেই চলে। গণমাধ্যম মানুষের জীবনযাত্রার অন্যতম অংশ এখন।

বাংলাদেশে এখন গণমাধ্যম বেশি। তাই মানুষের কথা বলায় এর প্রভাবও বেশি। এতে ভাল খারাপ দুটোই হচ্ছে।

যেসব গণমাধ্যম নিজস্ব সংস্কৃতি ও জেনে শুনে ভাষার ব্যবহার করছেন, তাদের অনুকরণ করায় ভাষায় সুন্দর পরিবেশ থাকছে। কিন্তু যারা কিছুই না জেনে না বুঝে, নিজের মত করে লিখছে, বলছে সেটা একটা জগাখিচুড়ি বা শঙ্কর ভাষা  হচ্ছে।

গড্ডালিকা প্রবাহে নিজেকে ছেড়ে দিলে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু চর্চার মাধ্যমে নিজেকে উন্নত করতে চাইলে সচেতনতা দরকার। গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে এখনও কিছু পত্রিকা তার ভাষা সুন্দর করার চেষ্টা করছে। নতুন সুন্দর শব্দ ব্যবহারের চেষ্টা করছে। নতুন শব্দ তৈরি করছে। একটা নিয়মতান্ত্রিকতা বজায় রাখছে। তবে কোন কোন পত্রিকা অকারণে এত বেশি বিদেশি শব্দ ব্যবহার করছে যা চোখে লাগার মত। গণমাধ্যমের সবচেয়ে খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে কিছু বেতার। গণমানুষের মুখ থেকে কথা তারা আনছে না। নিজেরা ‘ইচ্ছেভাষায়’ উচ্চারণ করছে। আর তা পরে সংক্রমিত হচ্ছে তরুণদের মধ্যে। এই তালিকায় আছে কিছু নাটক, চলচ্চিত্রও। নতুন ব্যতিক্রমি কিছু করতে গিয়ে লেজেগোবরে করে ফেলছে তারা।

আজকাল গণমাধ্যমের ভাষা: ছাপানো মাধ্যমের একটা সীমাদ্ধতা আছে। সকলের জন্য এমাধ্যম নয়। যারা পড়তে পারে না তাদের কাছে যেতে পারে না ছাপানো অক্ষর। যান্ত্রিক মাধ্যম টেলিভিশন, বেতার, মোবাইল ফোন, সহজে সবার জন্য। শুনতে ও দেখতে পেলেই হলো। বাংলাদেশের মত দেশে তো বটেই। গোটা দুনিয়াজুড়ে এর কদর বেশি। এ দশকের জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে দাড়িয়েছে ইন্টারনেটের ফেসবুক, টুইটার বা এই ঘরনার মাধ্যম। যা মানুষের প্রকাশকে সহজ করে দিয়েছে। এতে অনেকে যেমন শিখছে তেমনই দূষণও করছে।

গণমাধ্যমে ভাষা ব্যবহারে যত্নবান না হলে ভাষার সৌন্দর্য, উৎকর্ষ হারাবে। ভুলের কারণে নিজস্বতা হারাবে। তাই আজ শঙ্কা। বর্তমান গড্ডালিকা প্রবাহে সুন্দর মিষ্টি বাংলা ভাষায় চীড় ধরবে না তো? এ প্র্রশ্ন আজ স্পস্ট। দ্বিধায় ভোগা কিছু মানুষ এসবে প্রভাবিত হচ্ছে। আর বেশি প্রভাব ফেলছে ও প্রভাবিত করছে খণ্ডিত জানা মানুষ।

গণমাধ্যমের বর্তমান ভাষার অবস্থা একটু পর্যালোচনা করা যাক। তাহলে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে।

বিজ্ঞাপনের ভাষা: গণমাধ্যমের মধ্যে বিজ্ঞাপনের ভাষা সবচেয়ে খারাপ। ক্রেতাকে আকৃষ্ট করার জন্য যা ইচ্ছে তাই বলছে। আর তা সংক্রমিত হচ্ছে তরুণদের মধ্যে বেশি। প্রমিত, আঞ্চলিক, দেশি, বিদেশি সব এক সাথে জগাখিচুড়ি হচ্ছে। অনেক বিজ্ঞাপনেই উগ্র এবং অশালীন ভাষা। সহজে এসব ভাষা মুখে মুখে চলে যাচ্ছে। খেলার ছলে আড্ডায় বিজ্ঞাপনের উগ্রভাষা ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে।  কিছু উদাহরণ দেখলে এটা আরও পরিস্কার হবে।

মিস নুডলস্ এর বিজ্ঞাপনে বলছে, ‘ছেড়ে দে শয়তান। মন পাবি দেহ পাবি কিন্তু মজা পাবি না।’ খাবারের এই বিজ্ঞাপনে খাবারের মজার কথা বলা হলেও অশ্লীল ইঙ্গিত আছে। বাক্য প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়লেই সেটা স্পস্ট। অশ্লীল বিষয় মাথায় রেখেই সচেতনভাবেই এই বাক্য গঠন করা হয়েছে তা আর বলার অবকাশ রাখে না। এ বাক্যে যেমন খিন্তি আছে তেমন আছে অশ্লীল বিষয়।

গ্রামীণফোন তাদের বিজ্ঞাপনে বলছে, ‘… নইলে শুধু আপডাউন চলবে ভাইয়া’ ‘… আরে ডিজুস থাকলে পুরো ডাউনলোড দাও।’ এখানে শব্দ নির্বাচন এবং বাক্য গঠনে কোন শালিনতা রাখা হয়নি। আর মিশ্রন তো আছেই। ‘ডিজুস’ শব্দ এমনভাবে আমাদের সমাজে এখন ঢুকেছে যে, এই শব্দ শুনলেই বিশেষ এক তরুণ শ্রেণি চোখে ভাসে। শ্রেণি সম্বোধন ক্ষেত্রে ‘ডিজুস’ শব্দ ব্যবহার হচ্ছে।

আরএফএল এর এক বিজ্ঞাপনে বলছে ‘এই আমার লগে চিটিং কইরা ফিটিং করতাছ না? স্টপ। কাজ এক্কেবারে স্টপ। – কে আপনি? জানেন না? এই এলাকার পোলা।’

এ ধরণের অসংখ্য বিজ্ঞাপন আছে যা দেখে ও শুনে মানুষের মুখে বিকৃতি হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে। টেলিভিশন ও বেতারগুলো এসব প্রচার করছে অবলিলায়।

উপন্যাস: হুমায়ুন আহমেদ তার ‘কে কথা কয়’ উপন্যাসে প্রচুর বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে বাক্য লিখেছেন। যেমন, ১৫ পৃষ্টায় লিখেছেন, ‘‘মুনা বললেন, আমাদের একটাই ছেলে। বয়স টেন প্লাস। সে অঁঃরংঃরপ ঈযরষফ।’ আবার ১৭ পৃষ্টায় লিখছেন, অঁঃরংঃরপ ঈযরষফৎবহ – রা এই বিষয়টা চট করে ধরে ফেলে।  তারা জবাড়ষঃ করে।’ পুরো ইংরেজি অক্ষরে এই শব্দ লেখা হয়েছে। এখানে মুনা’র যে চরিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে তারা হইতো এভাবেই কথা বলে। তাই সেই চরিত্র উপস্থাপন করতে এমন শব্দের ব্যবহার। এখন কথা হলো, ‘মুনা’ কেন এভাষায় কথা বলে? কে কার কাছ থেকে নিল? হুমায়ুন আহমদের কাছ থেকে মুনা, নাকি মুনার মুখ থেকে হুমায়ুন আহমেদ? আর যদি মুনার মুখ থেকে হুমায়ুন আহমেদ নিয়ে থাকে তাহলে প্রমথ চৌধুরীর সেই কথায় এখানে ঠিক। মুখের কথা থেকে কলমে ভাষা গেছে। আর তাই যদি হয় তবে মুনার মুখে গেল কী করে? এই বইতেই হুমায়ুন আহমেদ ১৩১ পৃষ্টায় আবার পুরো একটা বাক্য ইংরেজি ভাষায় ইংরেজি অক্ষরে লিখেছেন। দঞযধঃ’ং ঠবৎু মড়ড়ফ.’ ‘মুনা বলল, প্যাঁচানো জবাব দেবে না। বলো ণবং কিম্বা ঘড় ।’ এখানে আবার ‘ঘড়’ এরপর ‘।’ দাড়ি দেয়া হয়েছে। ‘ . ’ ফুলস্টপ নয়। মানে ‘ঘড়’ কে মুখের বাংলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

হুমায়ুন আহমেদ এই বইয়ের শুরুতে যে ভূমিকা লিখেছেন, সেখানে সরাসরি ইংরেজি অক্ষরে অনেকগুলো শব্দ লিখেছেন। শুধু তাই না। প্রচুর ইংরেজি শব্দ বাংলা হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যেমন, শুরুতেই, “আমার মেজো মেয়ে শীলা তখন ক্লাস টু কিংবা থ্রি’তে পড়ে। তার হোমওয়ার্কের খাতা উল্টে পাল্টে দেখছি এক জায়গায় চোখ আটকে গেল।…ডাক্তাররা বললেন, কিছু কিছু ইনফরমেশন তার মাথায় উল্টো করে আসে। ইংরেজিতে একে বলে উুংষবীরধ।  অটিষ্টিক শিশুদের এরকম হয়।”

এখানের ‘ক্লাস’ ‘টু’ ‘থ্রি’ ‘হোমওযার্ক’ ‘ইনফরমেশন’ এগুলোর কী বাংলা শব্দ নেই? উপন্যাসের প্রয়োজনে না হয় মানুষের মুখের কথা তুলে ধরলাম কিন্তু ভূমিকায় এটা কী অবস্থা?

রকিব হাসান ‘মূর্তি রহস্য’ উপন্যাসের আট পৃষ্ঠায় বলছে, ‘বই গুলো মলাটের নিচ থেকে বের করে এক জায়গাতে জড় করল রাজু। ‘বুক শেলফগুলো সব ভরতি’, জিমিকে বলল সে। ফায়ারপ্লেসের ওপরের তাকেই রাখি, কি বলিস?’ এই বাক্যে ‘বাকশেলফ’ আছে আবার ‘তাক’ ও আছে। ‘বুকশেলফ’ না বলে ‘বইয়ের তাক’ বলা যেত।

ঠিক পরের পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘হ্যালো, ‘রাজু বলল, ‘মিনিষ্টার আনিস চৌধুরী আছেন? …ও। এলে তাঁকে বলবেন, প্লিজ তাঁর ভাগ্নে রাজু ফোন করেছিল। আমাদের বাড়িতে আসছেন তিনি। বলবেন, যেন ছদ্মবেশে আসেন। আমি স্টেশনে গিয়ে তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করব।’ ‘আচ্ছা বলব,‘হাসতে হাসতে বলল সেক্রেটারি, ‘যদি বেরিয়ে যাওয়ার আগে দেখা হয়। তিনি এখন …’ দরজার বাইরে জুতোর শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে ‘গুডবাই’ বলে রিসিভার রেখেদিল রাজু।’

এখানে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তা সচরাচর বলেই থাকি। উপরের এই অংশে ছয়টা বাক্য আছে। প্রায় প্রতিবাক্যেই একটা করে বিদেশি শব্দ আছে। ‘হ্যালো’ ‘মিনিষ্টার’ ‘প্লিজ’ ‘সেক্রেটারি’ ‘গুডবাই’ ‘রিসিভার’ ইত্যাদি।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল ‘দস্যি ক’জন’ উপন্যাসে ১৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, আবার সে কিটিশ সিটিশ করে কিছু একটা বলল। শুনে মনে হল বলছে, “হি ইজ কামিং।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কে কামিং?” একটা বাংলা আর একটা ইংরেজি শব্দ। দুটো মিলে ভয়ংকর বাক্য ‘কে কামিং?’

আঞ্চলিক ভাষায় অনেক উপন্যাস আছে। সেগুলো কিন্তু মানুষের মুখে যাচ্ছে না। হাসান আজিজুল হকের প্রথম উপন্যাস ‘আগুন পাখি’। আঞ্চলিক ভাষায় লেখা উপন্যাসের শেষে তিনি লিখছেন, ‘সকাল হোক, আলো ফুটুক, ত্যাকন পুবদিকে মুখ করে বসব। সুরুজের আলোর দিকে চেয়ে আবার উঠে দাঁড়াবো আমি।’ এগুলো আমাদের নিজস্ব মাটি থেকে উঠে আসা শব্দ। বিকল্প শব্দগুলো এখান থেকে  খুব কমই নেয়া হয়।

পত্রপত্রিকা বা টেলিভিশনে ‘কে কামিং’ অনুকরণ করা হলেও ‘পুবদিকে’ খুব কম শোনা যায়। আর ‘ত্যাকন’ তো প্রশ্নই আসে না।

এখানে শব্দ ব্যবহারেও শ্রেণি বৈষম্য তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ মনে করছে, ‘কে কামিং’ বলতে পারলে একটু উচ্চশ্রেণিতে উঠা যায়। নিজেকে উচ্চ উচ্চ মনে হয়। আর ‘ত্যাকন’ বললে কে কি ভাবে এই দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাজ করে অনেকের মধ্যে।

সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ নোয়াখালির ভাষায় ‘চাঁদের অমাবস্যা’ লিখেছেন। আবু ইসহাক বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষায়, শামসুদ্দীন আবুল কালাম বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু সেখানের প্রভাব মুখে মুখে নেই বললেই চলে।

নাটকের ভাষা: মঞ্চে এখনও যে নাটক হচ্ছে তা বেশ মান সম্মত। সেখানে ভাষা ও বোধ দুটোই আমাদের সংস্কৃতিকে ধারন করেই আছে। কিন্তু টেলিভিশনে! কিছু কিছু টেলিভিশনের নাটকে যে কোথাকার শব্দ ব্যবহার করে ভাষা তৈরি করেছে বলা মুশকিল। জিনিয়াস, স্মার্ট বয়, রানওয়ে, মিস্টার এন্ড মিসেস, টাইগার ভাই, ইনডিসিপ্লিন, ফাস্ট ডেট, হাউসফুল, ছাইয়্যা ছাইয়্যা, লাভ ডট কম, সিটি বাস এগুলো নাটকের নাম। বাংলা শব্দের বালাই নেই। পুরোটাই বিদেশি শব্দ। এসব নাটকের সংলাপের অবস্থা আরও খারাপ। মিশ্র আর উগ্র ভাষায় ভরা। তাই শঙ্কা।

পত্রিকার ভাষা: পত্রিকাগুলোর মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। যে যার মত করে বানান লিখছে। নিজস্ব বানাননীতি করে চলছে দৈনিক প্রথমআলো। নিজস্ব উচ্চারনে বানান লিখছে দৈনিক কালেরকণ্ঠ। যখন দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকা প্রকাশ হয় তখন তারা নিজস্ব নীতিতে বানান লিখত। বিশেষ করে বিদেশি শব্দগুলো। দৈনিক সকালের খবরও একই অবস্থা। বাংলা একাডেমির অভিধানে আছে ‘কোম্পানি’। সব পত্রিকা লিখছে ‘কোম্পানি’। কিন্তু কালেরকণ্ঠ ও সকালের খবর লিখছে ‘কম্পানি’। এমন উদাহরণ আরও অনেক আছে। ইত্তেফাক, সমকাল বাংলা একাডেমির অভিধান মেনেই লিখছে।

অনেক পত্রিকায় অকারণে বিদেশি শব্দ ব্যবহার করছে। ১৭ই জানুয়ারি ২০১৭ তারিখের পত্রিকায় এক প্রতিবেনে বলা হচ্ছে,‘ গতকাল সমাপনী দিনে সকালে বিচ ক্লিনিং কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়।’ এখানে ‘বিচ ক্লিনিং’ শব্দটা বাদ দিয়ে দেশি বা প্রচলিত শব্দ ব্যবহার করা যেত। বলা যেত, ‘ সৈকত পরিষ্কার’।

যথেষ্ট যত্নবান না হওয়ায় পত্রিকাগুলোতে এসব শব্দ অহরহ ছাপা হচ্ছে। আর এমন অযত্নের কারণে এক এক করে অপ্রয়োজনীয় বিদেশি শব্দ ঢুকছে বাংলায়।

অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ পত্রিকার ভাষা নিয়ে বলেছেন, ‘বাংলা পত্রিকাগুলো নির্বিচারে বাংলা ও বিদেশি শব্দের মিশ্রণ ঘটায়। বাংলাকে দ্বিতীয় স্থানে সরিয়ে রাখে এবং এক অমার্জিত-অসংস্কৃত ভাষাজগত সৃষ্টি করে।’

সাধুভাষা এখন আর ব্যবহার নেই বললেই চলে। দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদকীয় এখনও সাধুভাষায় লেখে। কিছু দিন আগে পুরো পত্রিকায় ছিল সাধুভাষায়। ১৯০১ সালের ৭ই ডিসেম্বর। ঢাকায় প্রথম বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। সেদিনের ঘটনা পরের দিন এক খবরের কাগজে লেখা হয়েছিল এভাবে, ‘গতকাল সন্ধ্যার অব্যবহতি পরে শ্রীযুক্ত নবাব বাহাদুরের অনুকম্পায় ঢাকা নগরীর প্রধান প্রধান রাস্তা চপলা চমকে অকস্মাৎ হাসিয়া উঠিয়াছে। ঢাকার ন্যায় শহরে এরূপ দৃশ্য লোক নয়নে নপিততি হইবে ১০ বৎসর পূর্বে বোধ হয় তাহা স্বপ্নের অগোচর ছিল।’

দলিলের কিছু সংক্ষিপ্ত শব্দ আছে। অনেক পুরানো পত্রিকা ঘাটলে এ শব্দগুলো দেখা যায়। কিন্তু পত্রিকাতে এখনতো ব্যবহার হয়ই না। দলিলেও কম দেখা যায়। যেমন, পিতা>পিং, স্বামী> জং, সকল> গং, ঠিকানা> সাং, দখল>দং, মোকাম>মোং যৌথমালিকানা> এজমালি, জমা> জ:, কিস্তি> কি:, পুর্ন বিবেচনার জন্য প্রার্থনা> ছানি, আপোষ> ছোলেনামা,  জমির অংশ> কিত্তা, তসমুক> তম: (বন্ধকনামা), বিস্তারিত> বিতং, চারদিকের সীমানা>চৌ:, বাতিল> খারিজ।

ফেইসবুক: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মধ্যে ফেইসবুক বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়। এখনকার তরুণ মধ্যবিত্তের কাছে যেন ফেইসবুক না থাকলেই নয়। এখানে প্রচারে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। একেবারেই রাষ্ট্রীয় আর অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া। তাই যে যার মত মন্তব্য লিখছে, অনেকে অসচেতনভাবেও। স্বয়ং বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান মন্তব্য লিখেছেন বাক্যে বাক্যে ভুল দিয়ে। একছত্রের মধ্যে ২৪টা ভুল। এগুলো অবহেলা বা অযত্নের কারণে হয়েছে তা ভুলের নমুনা দেখলেই বোঝা যায়। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকেরটা দেখলেই অন্য যারা লিখছে তাদের অবস্থা কিছুটা অনুমান করা যায়। কোন সম্পাদনার বিষয় নেই বলে যা ইচ্ছে তাই। আর ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লেখাও হচ্ছে এই মাধ্যমের কারণে। কয়েক বছর আগে ভিয়েতনাম তার নিজস্ব লিপি বাদ দিয়ে ইংরেজি লিপি নিয়েছে। অর্থাৎ তারা ইংরেজি লিপিতে নিজেদের শব্দ উচ্চারণ করে এবং লেখে। মানে ভিয়েতনামের নিজস্ব লিপি এখন জাদুঘরে। আমাদের অবশ্য সে শঙ্কা করার মত পরিস্থিতি এখনও হয়নি। তবে অভ্র যারা লিখতে পারেননা বা লিখতে চান না আবার পুরো ইংরেজি বাক্যও লেখেন না তারা কিন্তু এখনই ইংরেজি অক্ষর দিয়ে বাংলা উচ্চারণ করেন, লেখেন। লিখছে, ঠধষড় ধপযর (ভাল আছি), শধসড়হ ধপযড়? (কেমন আছ?), চঐ ফরড় (ফোন দিও) ইত্যাদি। এভাবে বাক্যের পর বাক্য লিখে যাচ্ছে। পরিস্থিতির কারণেও এভাবে লিখতে হচ্ছে। তবে সচেতন, সুন্দর বাক্যে লেখাও অনেক আছে।

চলচ্চিত্রে অশ্লীল ভাষা: চলচ্চিত্র অনেক বড় মাধ্যম। গতিময় শিল্প মাধ্যম। মানুষের কাছে যাওয়ার বিশাল এই মাধ্যম আমাদের কি শেখাচ্ছে? এই বিশাল গণমাধ্যমে এখন রুচির জায়গা খুব কম। ইচ্ছেমত নাম আর সংলাপে ভরা। চলচ্চিত্রে বাক্যের সৌন্দর্য যেমন নেই। তেমনই নেই সুন্দর বোধের জায়গা। চলচ্চিত্রে নায়ক বা নায়িকার অভিন্ন লক্ষ। কেমন করে দুজন দুজনকে কাছে পাবে। আর এই লক্ষকে ঘিরেই পুরো কাহিনী। ব্যতিক্রম আছে তবে তা খুব কম।

চলচ্চিত্রে শুধু যে মিশিয়ে, মিশ্রভাষা ব্যবহার হচ্ছে তাই না – অশ্লীল, গালালাগ আর খিস্তি হচ্ছে ইচ্ছেমত। সুন্দর রুচি সেখানে অনুপস্থিত। হাতে গোনা কিছু বাদ দিলে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া বেশিরভাগ চলচ্চিত্রে খিস্তি আছেই। নিদিষ্ট কোন ভাষিক রূপ চলচ্চিত্রে দেখা যাচ্ছে না। প্রমিত, কথ্য, আঞ্চলিক, ইংরেজী, হিন্দি, আরবি সব ভাষার উপস্থিতি আছে বাক্যে। আর বিদেশি ভাষার নামকরণ তো আছেই।

ওয়ানিং, লাভ ম্যারেজ, সুইট হার্ট, মিসড্ কল, লাভার নাম্বার ওয়ন, ওয়ানওয়ে, লাভস্টেশন, মিনিষ্টার, জিরো জিরো সেভেন, বুলেট প্রুফ, ওয়ান্টেড এগুলো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের নাম। বাংলা ভাষায় প্রচারিত চলচ্চিত্রের নাম। ২০১৬ সালে মুক্তি পাওয়া নামের তালিকা দেখলে দেখা যাবে অনেক চলচ্চিত্রের নাম ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, শুটার, রানা পাগলা দ্যা মেন্টাল, রুদ্র দ্যা গ্যাংস্টার, বাজে ছেলে দ্যা লোফার। এখানে যে শুধু বিদেশি শব্দ ব্যবহার হচ্ছে তাই-ই নয় বাক্য গঠনেও অন্য এক ধারা দেখা যাচ্ছে। শুধু ঢাকায় নয় কোলকাতাতেও একই অবস্থা।

অবাক হওয়ার মত ভাষা ব্যবহার হচ্ছে চলচ্চিত্রে। কিছু উদাহরণ।

রঙ্গীন চশমা চলচ্চিত্রে এক পর্যায়ে ভিলেন বলছে ‘দিসনা আমায় মাইনকা চিপা রে।’

‘বাঘের বাচ্চা’ চলচ্চিত্রের একটু সংলাপ তুলে ধরা হলো।

“যুবক: আখেরি জামানা এখন, নাইলে মাইয়া মানুষে পাম্প করে?

যুবতী: করলে কী হয়?

যুবক: সিস্টেম নাই। পাম্প করনের কাম পুরুষ মানুষের। তাগো আলগা পাম্পারের কোনো দরকার হয় না। পুরুষ মানুষের পাম্পার লগেই থাকে।”

এই সংলাপে অশ্লীল, কদর্য, নোংরা, মিশ্রণ সব আছে।

বেতার:  বেতার এখন বেশ জনপ্রিয়। আগেও ছিল। এখন বিশেষ এক শ্রেণির কাছে বেশি জনপ্রিয়। গত কয়েকবছর ‘কথাবন্ধু’ বা ‘রেডিওজোকি’ নামে এক বেতার চরিত্রের জন্ম হয়েছে। যার কাজই হচ্ছে বাংলা শব্দগুলোকে ইংরেজি আদলে উচ্চারণ করা। বাংলাভাষার যে সুর ছন্দ কথা বলার তাল লয় তার কিছুই নেই কথায়। আর বাক্য গঠনে প্রতি শব্দ পর পর একটা করে ইংরেজি শব্দ বলা। হরহামেশা বাক্যের মধ্যে ইংরেজি বলা। এটাকে অনুকরণ করছে অনেকে। একটা উদাহরণ দেখি। হ্যালো…ও…ও ফ্রেন্ডস, কেমন আছ তোমরা? হোপ দিস উইকে তোমরা মেনি মেনি ফান করেছ উইথ লটস অফ মিউজিক। এনিওয়ে এখন তোমাদের সাথে আছি কুল ফ্রেন্ড জারা এন্ড আছে জোশ সব মিউজিক ট্রাক এন্ড লটস অফ আড্ডা, সো ফ্রেন্ডস ঝটপট জয়েন করে ফেলো আমাদের আড্ডায় এন্ড ফেভারিট গান শুনতে মোবাইলের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে লিখো এস-ও-এস-জি, স্পেস দিয়ে সেন্ড কর এইটনাইনসিক্সজিরো নম্বরে, নাউ এনজয় কর একটা হিট গান। আর একটা উদাহরণ শুনি- ‘ডিয়ার ফ্রেন্ডস এখন প্লে করছি ২১শে ফেব্রুয়ারির স্পেশাল ট্রাক আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী…তো শুনতে থাকো আর এনজয় করো এন্ড অফকোর্স একুশের চেতনাকে উদ্দিপ্ত করো।’

এক সময় ছাপা অক্ষরে ভুল একথা কল্পনাতীত ছিল। কিন্তু এখন তা মেনেই চলতে হচ্ছে। বাংলা একাডেমি অভিধান করেছে। সম্পাদক বললেন, কিছু ভুল আছে, পরবর্তী সংষ্করণে সংশোধন হবে। যে ভুল মানুষের কাছে গেল তা নিয়ে কিছু হলো না। পাঠ্যপুস্তকে ভুল। শিক্ষামন্ত্রী বললেন, ভুল হতেই পারে। আর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ফেইসবুকে ভুল লিখে বললেন, ভুল হতেই পারে।

এই সব পর্যালোচনায় এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা শঙ্কর হব, না নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে বাঁচবো। এখন সমাধানের সময় এসেছে। আমাদের ভাষা যে সমৃদ্ধ তাতে শঙ্কর হওয়ার প্রয়োজন নেই। তবু সেদিকেই যাচ্ছি। শঙ্কর হতে চাইলে সহজে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিলেই হবে। আর নিজস্ব কৃষ্টি নিয়ে চললে এখনই সতর্ক হতে হবে। সতর্ক হতে হবে গণমাধ্যমগুলোকেও।

অধ্যাপক ড. আয়েশা বেগমের কথায় শেষ করতে চাই  ‘চীন, জাপান, কোরিয়া, রাশিয়ার মতন মাতৃভাষা -সংরক্ষণবাদী দেশের জনগণও ইংরেজি ভাষাসহ ফারসি, জার্মানি, স্প্যানিস, আরবি, হিন্দি, বাংলা ইত্যাদি ভাষা শিখছে। দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষা শিক্ষা শিক্ষার্থীর আত্মশক্তি বৃদ্ধি করে। প্রয়োজনে ইংরেজি ভাষা শিখতে আপত্তি নেই। আপত্তি সে ভাষাতে বাঁচতে চাওয়া। প্রাণের ভাষা আবেগের ভাষা আনন্দের ভাষা ও সম্ভাবনার ভাষা মাতৃভাষা বাংলা ভাষাতেই বাঁচতে চাই। পূর্বপুরুষদের ভাষা, কাহ্নপা, চণ্ডীদাস, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ এবং বঙ্কিম-শরৎ-মানিক-ওয়ালীউল্লাহ-আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বাংলা ভাষায় বাঁচতে চাই।’