বিশ্বে বাংলাদেশই সম্ভবত একমাত্র দেশ যেখানে প্রায় সব ধরনের পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটে। নিয়োগ পরীক্ষা, ভার্সিটি-মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা, এইচএসসি, এসএসসি থেকে শুরু করে অপেক্ষাকৃত নবীন জেএসসি কিংবা পিইসি পরীক্ষায়ও প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা আজ আমাদের অলঙ্ঘনীয় নিয়তি।
এ এক সর্বনাশা ভাঙ্গনের পথ। কী ভয়ঙ্কর এক সংস্কৃতির সঙ্গী হয়ে বেড়ে উঠছে আমাদের প্রজন্ম! কী বিভীষিকাময় এক মানসিক পতনের পাঠ নিয়ে ‘শিক্ষিত’ হচ্ছে আমাদের কিশোর তরুণেরা! আগের রাতে কিংবা পরীক্ষার দিন সকালে অর্থের বিনিময়ে হাতে পাওয়া ফাঁসকৃত প্রশ্নের উত্তরগুলো পঞ্চম কিংবা অষ্টম শ্রেণিতে পড়া নিজের সন্তানকে সরবরাহ করছে বাবা কিংবা মা। এ দৃশ্যও কি কল্পনা করা যায়!
অবুঝ সন্তানকে দিয়ে জীবনের শুরুতেই এমন অনৈতিক কাজে অভ্যস্ত করানোর মাধ্যমে অভিভাবকরা যে পাপ করছেন, তার দায় কি রাষ্ট্রেরও নয়? এ কেমন রাষ্ট্র! যে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কর্ণধররা ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে এবং রাষ্ট্র সেখানে থাকে নির্লিপ্ত নির্বিকার, সে আবার কেমন রাষ্ট্র! রাষ্ট্র তো একটি ক্ষমতা। কোথায় তার সেই ক্ষমতার চর্চা? যারা প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত, দিনের পর দিন ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে প্রশ্ন-ফাঁস বাণিজ্যের যারা মূল সওদাগর, তাদের ক্ষমতা কি রাষ্ট্রের ক্ষমতার চেয়েও বেশি? রাষ্ট্র কি তাদের কাছে অসহায়? নাকি ক্ষমতা চর্চার ব্যাকরণে এ এক ‘নিপাতনে সিদ্ধ’ সন্ধি! ক্ষমতার অদৃশ্য ‘হাতে’ নাই হয়ে যায় সবকিছু। এই হাত আমরা দেখি না, কারণ দেখতে চাই না।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, শিক্ষামন্ত্রী একজন সহজ সরল ভালো মানুষ। কিন্তু তাঁর মন্ত্রিত্বের পুরো সময়টা জুড়ে প্রশ্ন ফাঁসের যে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটছে, তার দায় তিনি এড়াবেন কীভাবে। অথচ মন্ত্রী এবং প্রশাসন অধিকাংশ সময়ই প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি স্বীকারই করতে চান না। এই দুর্বলতায় ‘অধরা’ সেই সিন্ডিকেট বাধাহীনভাবে চালিয়ে যায় তাদের কার্যক্রম। কখনো কখনো চক্রের দু একজন ধরা পড়লেও থেমে থাকে না প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা। কারণ মূল কারিগররা থাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে, কিংবা কে জানে কিছু বিষয়কে ধরা ছোঁয়ার বাইরে রেখেই হয়ত ক্ষমতা চর্চা করতে হয়! না হলে মন্ত্রী চাইলে, রাষ্ট্র চাইলে এ সিন্ডিকেট খুঁজে বের করা তো অসম্ভব নয়। চোখের সামনে পাঁচ শ টাকা থেকে শুরু করে লাখ টাকায় বিক্রি হয় প্রশ্ন, রাষ্ট্র তাকিয়ে দেখে- বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে এই দৃশ্য বড় বেমানান।
এই বাংলাদেশে পদ্মা সেতু হচ্ছে, বড় বড় ফ্লাইওভার হচ্ছে, মেট্রোরেল হচ্ছে। মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছে। রাষ্ট্রের সমস্ত বিনিয়োগ এবং মনোযোগ এইসব অবকাঠামোর দিকে। কিন্তু শিক্ষার ব্যবস্থায় এবং মানে যে ভয়াবহ অধঃপতন হচ্ছে তার দিকে রাষ্ট্রের দৃষ্টি নেই। লক্ষ লক্ষ জিপিএ ৫ উৎপাদনই হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষার মৌল উদ্দেশ্য। এখন কেউ শিক্ষার্থী হচ্ছে না; হচ্ছে পরীক্ষার্থী। ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বুধবার ঢাকার এক অনুষ্ঠানে বলেন, “দেশের শিক্ষার অবস্থা শোচনীয়। কারণ, শিক্ষাকে নামিয়ে আনা হয়েছে পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার মধ্যে। শিক্ষাব্যবস্থা পরীক্ষাকেন্দ্রিক হওয়ায় জ্ঞান ও শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে।” পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষারও সমালোচনা করেন তিনি। বলেন, “আমরা শিশুদের ওপর পরীক্ষার চাপ কমানোর কথা বলছি। অথচ সেই চাপ কমাবার পথে না গিয়ে পঞ্চম শ্রেণিতেও একটি পরীক্ষা যোগ করেছি। এই পরীক্ষার কোনো আবশ্যকতা নেই, এটা শিক্ষার্থীদের জন্য পীড়ন।”
পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষার যৌক্তিকতা/প্রয়োজনীয়তা নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন ছিল। বিশেষ করে পাবলিক পরীক্ষা হিসেবে পিইসি না নেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে গত বছর হাইকোর্টে এক আইনজীবী রিট আবেদন করেন। আদালত পিটিশন গ্রহণ করে কেন পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা অবৈধ ঘোষণা করা হবে না মর্মে রুল জারি করেন। মঙ্গলবার এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সংসদে যা বলেছেন তাতেই রয়ে গেছে সব প্রশ্নের উত্তর। জাতীয় পার্টির এমপি কাজী ফিরোজ রশীদ আদালতের ঐ রিটের প্রেক্ষিতে পিইসি পরীক্ষা নেওয়ার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তার উত্তরে প্রধানমন্ত্রী আদালতের উদ্দেশ্যে বলেন, “জরুরি মামলা শুনানির সময় নেই। এই সমস্ত খুচরা জিনিস নিয়ে সময় কাটানো কেন?”
বাচ্চাদের শিক্ষা, পরীক্ষা এই রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর কাছে “খুচরা” জিনিস। হতেও পারে। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের দিকে ছুটে চলেছি। এবারও আমাদের জিডিপি সাতের উপরে। মাথাপিছু আয় ১৬ শ মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে উঠছে। দৃশ্যমান হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মাসেতু। সারাবিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হয়েছে বাংলাদেশ। এমন বাংলাদেশে বাচ্চাকাচ্চাদের শিক্ষা-দীক্ষা তো খুচরা জিনিসই! এই জিনিস নিয়ে এতো মাথা ব্যথার কিছু নেই।
এমন “খুচরা” যে জিনিস, তাতে প্রশ্ন ফাঁস হলে কার কী? প্রশ্ন ফাঁসও একটি খুচরা ঘটনা। এসব বাদ দিয়ে আসেন, উন্নয়নের “পাইকারি” জিনিস নিয়ে আলোচনা করি!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)