ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন পরিচিতমুখ। দেশের সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, উপ-রাষ্ট্রপতি ছিলেন তিনি। বিভিন্ন মন্ত্রী পরিষদেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বিএনপির ও জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। রাজনীতির প্রত্যেকটি ধারায় তিনি বিচরণ করেছেন। সাম্প্রতিক রাজনীতির কয়েকটি বিষয় নিয়ে অভিজ্ঞ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ কথা বলছিলেন চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে।
চ্যানেল আই অনলাইন: আওয়ামী লীগ বলছে, তারা আবারও ক্ষমতায় আসবে। এটি কি চ্যালেঞ্জ নাকি হুমকি?
ব্যারিস্টার মওদুদ: আওয়ামী লীগ, যারা এখন ক্ষমতায় আছে তারা চিন্তাই করে না যে, তাদেরকে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যেতে হবে। তারা ভাবছেন যে, তারা ক্ষমতায় আছেন এবং থাকবেন। সেটা ভাবাটাই স্বাভাবিক। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয় আমাদের মতো অনুন্নত দেশে, যেখানে রাজনৈতিক বা গণতান্ত্রিক চর্চার কালচার ডেভেলপ করে নাই। গণতন্ত্রাকি চর্চায় আমরা মেচিউর হয়নি। আমরা ইমমেচিউর অবস্থায় আছি। এটা একেবারে সত্য কথা। এর জন্য আমরা সুযোগ পাইনি। আর যতোটা সুযোগ পাওয়া গিয়েছিলো সে সুযোগটা আমরা সদ্ব্যহার করতে পারি নাই। গণতন্ত্র মানে হলো গণতান্ত্রিক চর্চা বা মূল্যবোধ। সেটা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। একারণে তারা শেষদিন পযন্ত বলে যাবে এসব কথা। পতন না হওয়া পর্যন্ত, তারা একথাই বলে যাবে। এগুলো অভিজ্ঞতার আলোকে বলা কথা। ক্ষমতা এরকমই জিনিস যে, একেবারে শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আকড়ে ধরতে ইচ্ছা করে।
চ্যানেল আই অনলাইন: আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপি বিরল প্রজাতির মতো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আপনার বক্তব্য কী?
ব্যারিস্টার মওদুদ: একথা তারা ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেও বলেছিলো। বিলুপ্ত কি হয়েছে বিএনপি? বরং এতো অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, জুলুম, মামলা, হামলা, খুন-গুমের পরও আজকে বিএনপির অবস্থান আগের চেয়েও অনেক শক্ত। দুর্বলতা আছে। অনেক সাংগঠনিক দুর্বলতা আছে।এরপরও গত চার বছরে এতো কিছুর পরও বিএনপির কোন স্তরের কোন নেতা কি বিএনপির ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে আওয়ামী লীগে চলে গেছে? তার কারণটা কি? চলে যাওয়ার তো কথা। কিন্তু যায়নি। সুতরাং গত ৪ বছর বিএনপি সংগঠন হিসেবে আরো শক্তিশালী হয়েছে। তাদের মানসিক অবস্থা আরো শক্ত হয়েছে।
চ্যানেল আই অনলাইন: আপনার মতে, বিগত ৪ বছরে বর্তমান সরকারের মূল অর্জন কী?
ব্যারিস্টার মওদুদ: গণতন্ত্রের প্রেক্ষাপটে এই সরকারের কোনো অর্জন নেই। তারা সুশাসন কায়েম করতে পারেনি। দেশে একটি কার্যকর সংসদ গঠন করতে পারেনি। তারা আইনের শাসনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তারা বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করেছে। প্রধান বিচারপতির প্রতি তারা কিরূপ আচরণ করেছেন তা দেশের মানুষ দেখেছে। সূতরাং গণতান্ত্রিক চর্চার দিক থেকে এই সরকার গত ৯ বছরে কোন অর্জন দেখাতে পারবে না। কোন কিছুই করতে পারেনি। তারা কোন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি। তারা গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য, শক্তিশালী করার জন্য, গণমাধ্যমকে শক্তিশালী করার জন্য, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য কোন কিছু করতে পারেনি। উপরুন্ত তারা ভিন্ন মতকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার একটা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।
চ্যানেল আই অনলাইন: তবে সরকার যে অনেকগুলো ফ্লাইওভার করেছে, ফোর লেনের রাস্তা তৈরি করেছে, এগুলোকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ব্যারিস্টার মওদুদ: এসব উন্নয়নের সঙ্গে গণতন্ত্র, সভ্যতা বা সুশাসনের সম্পর্ক নাই। করতেই পারে। এসব উন্নয়ন আইয়ুব খানও করেছিলেন। এই যে এতো সুন্দর স্থাপত্য- আমাদের সুন্দর একটি জাতীয় সংসদ ভবন নির্মিত হয়েছিলো আইয়ুব খানের আমলে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে জনগণ কিভাবে আন্দোলন করেছিলো তা সবাই জানেন। সূতরাং এসব উন্নয়ন কাজ তো হবেই। ৯ বছর ক্ষমতায় আছে। দেশের মানুষের টাকা দিয়ে তৈরি হচ্ছে সবকিছু। ‘ফ্লাইওভারস আর নট স্টেটস ভেলুস’। ফ্লাইওভার আমাদের রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ নয়। রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ হলো সেটা যে আমরা কতোটা পরিপক্বতা অর্জন করতে পেরেছি, কতোটুকু গণতন্ত্রমনা হতে পেরেছি, কতোটুকু সহনশীল হতে পেরেছি, এটা গুরুত্বপূর্ণ। সেটাই হলো উন্নয়নের আসল ক্রাইটেরিয়া। ফ্লাইওভার উন্নয়নের ক্রাইটেরিয়া না। ক্রাইটেরিয়া হলো সেটা যে, আমরা জাতি হিসেবে কতোটা এগিয়ে গেলাম। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সেখানে মূল্যবোধ থাকবে, পারস্পরিক সম্পর্ক থাকা, সবাইকে নিয়ে রাজনীতি করা, ইনক্লোসিভ, নট এক্সক্লোসিভ। এটাই তো জাতির প্রত্যাশা। মূলত জবাবদিহিহীন উন্নয়ন অর্থ হলো বড় বড় প্রকল্প, বড় প্রজেক্ট, বড় বড় ঘুষ, বড় বড় দুর্নীতি। বিশ্বব্যাংক যখন কোন অর্থ দেয় তখন তারা মনিটরিং করে। তাদের এক্সপার্টরা মনিটরিং করে। সেখানে অর্থ সঠিক জায়গায় ব্যয় হচ্ছে কিনা দেখে। কাজ সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা; সিমেন্ট, বালু, রড মানসম্মত হচ্ছে কিনা বা কোন রকম অনিয়ম হচ্ছে কিনা তারা তা দেখে। এই যে বর্তমান সরকারের অধীনে নিজস্ব অর্থায়নে কাজ হচ্ছে এখানে তো কোন মনিটরিং নেই। এই অর্থটা যে দেশের মানুষের জন্য, মানুষের মঙ্গলের জন্য সঠিকভাবে ব্যয় হচ্ছে কিনা তা মনিটরিং করছে কে?
চ্যানেল আই অনলাইন: জনগণের প্রত্যাশা কি বলে মনে করেন?
ব্যারিস্টার মওদুদ: জনগণের প্রত্যাশা একটাই। জনগণ গণতন্ত্র চায়। গত ১শ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখবেন, আমাদের দেশের মানুষ সবসময় গণতন্ত্রমনা। তারা নিজের অধিকার ফিরে পেতে চায়। ভোটাধিকার পেতে চায়। ওয়ার্ড লেভেল থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত তারা যখনই সুযোগ পেয়েছে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে। সুতরাং দেশের মানুষের স্বাভাবিক প্রত্যাশা একটাই -আগামী নির্বাচন যখন হবে তখন তারা যেন নিজের ভোট নিজেই দিতে পারে, যাকে খুশি তাকে দিতে পারে, সেটির নিশ্চয়তা দেয়া। নির্বাচনের সময় কেন্দ্রে গিয়ে দেখলো ব্যালট পেপার ছিনতাই হয়ে গেলো। ধানের শীষের ভোট চলে গেলো নৌকায়, ব্যালট পেপার ছিড়ে ফেলা হলো। এধরনের ঘটনা জনগণ দেখতে চায় না।
চ্যানেল আই অনলাইন: বেগম খালেদা জিয়ার মামলা সম্পর্কে কিছু বলুন…
ব্যারিস্টার মওদুদ: সরকার বেগম জিয়াকে ঘায়েল করে আসলে বিএনপিকে দুর্বল করতে চায়। একারণে সম্পৃক্ততা না থাকা সত্ত্বেও বেগম খালেদা জিয়ার নামে মামলা দিয়ে প্রতিদিন কোর্টে হাজিরা দিতে বাধ্য করছে। কুয়েতের আমির যে অর্থ দিয়েছিলো তা মূলত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের জন্য। এতে বেগম জিয়ার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এই মামলায় বেগম জিয়ার সাজার চেষ্টা করবে তারা। তবে তা করে বিএনপিকে দমিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। জনগণ এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিবে। আমার ধারণা সরকার এধরনের ভুল চিন্তা থেকে সরে আসবে।