ভবনে ঠাসা পুরো এলাকা। মাঝে মাঝে কিছু সরু গলি দিয়ে যাতায়াতের পথ। নেই কোন ফুটপাত। সেই সরু গলিগুলোতে সবসময়ই রিক্সা, ভ্যান, মাইক্রোবাস চলাচল করায় পায়ে চলা মোটেও সহজ নয়। লালবাগ কেল্লার গেট ধরে রহমত উল্লাহ বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে সতর্কভাবে কিছুদূর হেঁটে গেলেই চোখে পড়বে অদ্ভুত সুন্দর এক স্থাপনা।
গলি লাগোয়া গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখা মিলবে উন্মুক্ত এক প্রান্তরের। ডান পাশটা একেবারে খোলামেলা। সেখানে লাগানো হয়েছে নানা ধরনের শোভা বর্ধনকারী গাছ। আর বাঁম পাশেই রয়েছে একটি প্রাচীন স্থাপনা। মাটি থেকে প্রায় ১৭ ফুট উচু প্লাটফর্মের ওপরে তৈরি এ স্থাপনাটিই খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ।
দূর থেকে দেখে যে কেউ ভাবতে পারেন: স্থাপনাটি আসলে পোড়া মাটির তৈরি। লাল ইট আর চুনাপাথরের মিশ্রনে স্থাপনাটির রঙ অনেকটা পোড়া মাটির মত। রঙের দিক থেকে কেউ কেউ আবার মিল খুঁজতে পারেন দিল্লীর লাল কেল্লার সঙ্গেও। প্লাটফর্মের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই চোখ ভরে যাবে অভিজাত মুঘল স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম নিদর্শন তিলোত্তমা এ মসজিদটি দেখে। প্রায় সোয়া তিনশ’ বছর বয়স হলেও জৌলুস কমেনি এতটুকু। চারপাশের ঘিঞ্জি এলাকার মধ্যে এ মসজিদ আজও যেন সাক্ষ্য বহন করে চলেছে মুঘল আভিজাত্যের।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষিত খান মোহাম্মাদ মৃধার এ অমর কীর্তিটি আজও জমজমাট মুসল্লীদের নিয়মিত পদচারণায়। অলিগলিতে মসজিদ থাকার পরেও এ মসজিদটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য এক আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে এখনও সমাদৃত।
নির্মাণ ইতিহাস
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন এবং বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী: ১৭০৪-৫ সালে ঢাকার প্রধান কাজী, কাজী খান মোহাম্মদ এবাদউল্লাহ নির্দেশে খান মোহাম্মাদ মৃধা এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। প্রায় ১৭ ফুট উচুঁ প্লাটফর্মের উপর বানানো হয়েছিল তিন গম্বুজ এই মসজিদটি। নামাজ ঘরের উত্তর-পূর্ব দিকে রয়েছে মাদ্রাসা। মসজিদ আর মাদ্রাসা ছাড়া বাকি অংশ একদমই উন্মুক্ত। ধারণা করা হয় এখানেই শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হতো। আর নীচের ঘরগুলো ছিল থাকার জায়গা।
এখনও সমান জমজমাট!
বৃহস্পতিবার দুপুরের পর মসজিদ চত্বরে প্রবেশ করে দেখা যায়, প্লাটফর্মের নিচের খোলা জায়গা ক্রিকেট খেলছে কয়েক কিশোর। আসরের আগে আগে বিভিন্ন এলাকা থেকে মুসল্লীরা আসতে থাকেন নামাজ আদায় করতে। নামাজ শুরু হতে হতে পুরো মসজিদ ভরে যায়। এরপর বাইরে চাটাই বিছিয়েও অনেককে নামাজ আদায় করতে দেখা যায়। এরকম দৃশ্য প্রায় প্রতি ওয়াক্তের নামাজেই দেখা যায় বলে জানালেন কয়েকজন মুসল্লী।
জুমার দিনে জায়গা পান না অনেকে!
পুরো মসজিদ চত্বরটি বেশ জায়গা জুড়ে। সঠিক পরিমাণ কোথাও উল্লেখ না থাকলেও স্থানীয়রা জানান: চত্বরটি কয়েক একর হবে। প্লাটফর্মের ঠিক মাঝামাঝি মূল মসজিদের অবস্থান। কিন্তু মসজিদের চারপাশ জুড়ে অনেক খোলা জায়গা। মুসল্লীদের চাপ থাকলে সেখানে চাটাই বিছিয়ে নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু জুমার দিনে মূল মসজিদ, এর চারপাশটা ভরেও জায়গা হয় না অনেক মুসল্লীর। তাই বাইরের প্লাটফর্মের নিচের খোলা জায়গা, অজু খানার সামনের প্রান্তর ভরে সামনের সড়কে দাঁড়িয়েও অনেকে নামাজ আদায় করেন বলে জানালেন মসজিদের মুয়াজ্জিন ও খাদেম মো. জসীম উদদীন।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন: জুমার দিনে এত লোকজন আসে যে পুরো চত্ত্বর ভরেও লোক উপচে পড়ে, অনেক সামনের সড়কে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেন কেউ বা সেই সুযোগও পান না।
যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে
মসজিদটি প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রাধীন থাকলেও কমিটির মাধ্যমে এটি পরিচালনা করছেন স্থানীয়রাই। মসজিদ কমিটিই এলাকাবাসীর সহযোগিতায় এটি পরিচালনা করেন বলে জানালেন মসজিদের খাদেম।
মসজিদটিতে মোট চারজন স্থায়ীভাবে কর্মরত রয়েছেন। একজন প্রধান ইমাম, একজন সহকারী ইমাম একজন মোয়াজ্জিন এবং একজন খাদেম।
জুমার দিনে দানবাক্সে যে টাকা ওঠে তা দিয়েই এই চারজনের বেতন-ভাতা হয়ে যায় বলে জানালেন ৪৩ বছর ধরে মসজিদটির খাদেমের দায়িত্বে থাকা জসীম উদদীন।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মচারী আবদুল ওয়াদুদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: মসজিদের বাইরের কাজটা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরই করে। কিন্তু ভেতরের অংশে রঙ বা কোন আসবাবপত্র লাগাতে হলে অধিদপ্তরের অনুমতি সাপেক্ষে স্থানীয়রাই তা করে থাকেন।
প্রত্নতত্ত্ব এবং পুরাকীর্তিতে যাদের আগ্রহ রয়েছে তাদের জন্য তিলোত্তমা এ ভবনটি নিঃসন্দেহে এক অপরূপ নিদর্শন হতে পারে।