স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর! সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের চারপাশের জীব-জগৎ নিয়েই মানুষ জীবনযাপন। প্রত্যেক জীবের সঙ্গে অন্য জীবের কোনো না কোনোভাবে সম্পর্ক রয়েছে। জ্ঞান-বুদ্ধির অধিকারী মানুষও সেই সম্পর্ক বা বন্ধনে আবদ্ধ।
ছেড়ে আসা বাসার নিচের একটি কুকুরের প্রতি অব্যক্ত কিছু কথা ফেসবুকের স্ট্যাটাসে তুলে ধরেছেন চ্যানেল আইয়ের বার্তা সম্পাদক আদিত্য শাহীন।
ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন:
আমার কুকুরপ্রেম নেই। তবে মসজিদের আজান শুনে ক্রন্দনরত কুকুর আমার মন খারাপের কারণ হয়েছে বহুবার। তাছাড়া হিজ মাস্টার ভয়েস এর নিপার কিংবা জাপানের টোকিও শহরের শিবুইয়ারেলওয়ে স্টেশনের ‘হাসিকো’র প্রেম উপাখ্যান নিয়ে খন্ড খন্ড করে বহুবার ভেবেছি। কিন্তু কখনো মনে হয়নি আমি কোনো কুকুরের মনিব হই। তুলতুলে ছোটখাটো কিংবা বিশালাকার উচ্চকন্ঠি কোনো কুকুরের ভালোবাসা পাবার সাধ হয়নি। কৈশরে আমাদের পাড়ায় একটি সুদর্শন ও পরিচ্ছন্ন কুকুর ছিল। নাম টগর। টগরের সাহস ছিল খুব। তাকে নির্দেশ দিলে যাকে তাকে নিমিষেই ধাওয়া করতো। সে আমাদের সাহস হয়ে উঠেছিল।
অজানা অচেনা কুকুরের প্রতি আমার ভীতিও ছিল কিছুটা। গভীর রাতে একা কুকুরের মুখোমুখি হয়ে রীতিমত যুদ্ধকান্ডও ঘটিয়েছি বহুবার। কুকুর দেখলেই হাতে ইট নিয়ে ছুঁড়ে মারার ভঙ্গি করে নিজেকে বাঁচাতে চাইতাম। ভীতি থেকেই আমার এই সন্ত্রাস আসতো। কোনো কোনো কুকুর ইট দেখেও পালায় না। সেগুলো সাংঘাতিক ভীতিকর। অনেক পরে বুঝেছি কুকুরের মুখের দিকে না তাকালে, চোখে চোখ না রাখলে তারা মানুষকে শত্রু মিত্র কিছুই ভাবে না।
নব্বইয়ের মাঝামাঝিতে আমাদের বাড়িতে একটি বাচ্চা কুকুর যোগাড় করা হয়েছিল। বাবার আপত্তির মুখেও আমরা যেকোনোভাবে কুকুরটিকে আমাদের পরিবারের সদস্য করতে চেয়েছিলাম। আমার বিশেষ অনুরাগ ছিল না, কিন্তু পরিবারের অন্য সবার খুব টান ছিল। একদিন হাজাম ডেকে কুকুরটিকে খাসি করাও হলো। সেটির নাম রাখা হলো ‘জ্যাক’। জ্যাকের প্রতি সবার ভালোবাসা যখন ঘন হয়ে উঠছে একদিন ঘটলো এক মর্মান্তিক ঘটনা। আব্বার পেছন পেছন বাজারে গিয়ে মহাসড়কে গাড়ির নীচে পিষ্ট হয়ে প্রাণপাত ঘটলো জ্যাক এর। মা কাঁদলেন। আমাদের বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। স্বজন হারানোর মতো কষ্ট অনুভব করা গেল। আমার নিকটতম অনেক বন্ধুর কুকুরপ্রীতি দেখে অনেকক সময় অতি আদিখ্যেতা মনে হয়। আমার সময় নেই এগুলো নিয়ে মেতে থাকার। তাছাড়া একটি প্রাণ লালন পালনের যে দায়িত্ব, তা বহন করা আমার কাছে ঝামেলা মনে হয়। মনে হয়, কখনো খাবার দিতে ভুলে গেলে কি না কি হয়ে যায়। আমার বন্ধু সোহেল রেজার একটি পোশা বানর ছিল। সেটি অজানা কারণে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। আমার মায়ের একটি টিয়ে ছিল। অতি আপন পাখিটি খাঁচা থেকে বেরিয়ে পাশেই ডানা নেড়ে চাঞ্চল্য দেখাচ্ছিল। একটি বিড়াল এসে চিরতরে থামিয়ে দিল তাকে। আমি বহুবার কোকাটেল আর কবুতর পালনের উদ্যোগ নিয়েছি। টেকাতে পারিনি। অনেকেই সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু সেগুলোকে দিনে দিনে সরিয়ে দিতে হয়েছে।
গতমাসে আমার উনিশ বছরের আবাসিক ঠিকানাটি পাল্টে ফেলেছি। সেখানে কতশত স্মৃতি। ইচ্ছে করেই কাঁচা স্মৃতিতে হাত দিচ্ছি না। কমপক্ষে একশ মুখের প্রতিকর শুভাশীষ ছিল আমার সঙ্গে। কাকে রেখে কার কথা বলি। বিশ্বাস করি তাদের শুভকামনাটুকু থেকেই যাবে। তবে গত কয়েকদিন মনের ভেতর খচখচ করছে বাসার নীচে সবসময় পায়চারিরত কুকুরটি। বয়স আট দশ বছর হয়েছে হয়তো। চলতে ফিরতে ওর সঙ্গে সখ্য। মাঝে মাঝে ভোরে ও আমার পেছন পেছন হাঁটতে বেরিয়ে পড়তো। এগিয়ে দিত গলির মুখ পর্যন্ত। আমরা দেখতাম শান্ত একটি কুকুর। ওর নাম লালু। বাড়ির কেয়ারটেকার ও গার্মেন্টস এর নিরাপত্তারক্ষীরা ওর নাম ধরে ডাকে। লালু যে আমাদেরকে এইভাবে জানতো বা ভাবতো তা কখনো বুঝিনি। বাসা ছেড়ে আসার দুদিন আগে থেকেই ওকে বেশ বিষন্ন দেখাচ্ছিল। ও হয়তো দোতলার ভাড়াটে হিসেবে এই আমাদেরকে মনে রাখবে ‘নিপার’ কিংবা ‘হাচিকো’র মতো। নাও রাখতে পারে আমি তো ওর মনিব ছিলাম না।