রাজধানীর মুগদা মদিনাবাগ এলাকার একটি ডোবায় পড়ে হৃদয় (৩) নামে এক শিশু এক সপ্তাহ পর্যন্ত নিখোঁজ থাকলেও ওই ডোবায় ২০-৩০ বছর আগের পুরু ময়লার স্তর জমা হয়ে থাকায় হৃদয়কে এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) মেজর শাকিল নেওয়াজ।
চ্যানেল আই অনলাইনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি বলেন: মদিনাবাগের ওই ডোবায় ২০-৩০ বছর আগের পুরু ময়লার স্তর জমা হয়ে আছে। ডোবার যে অবস্থা সেখানে পৃথিবীর অন্য কোন ডুবুরি নামবে কি না তা সন্দেহ রয়েছে, কিন্তু আমরা নেমেছি। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।
‘তবে বর্তমান যে অবস্থা তাতে শিশুটিকে উদ্ধারের জন্য সমন্বয় প্রয়োজন। ডোবা দেখভাল করার দায়িত্ব আমাদের নয়, এলাকাটির জনপ্রতিনিধিরা এতদিন কী করেছেন? ডোবা সুরক্ষিত থাকলে শিশুটিকে এভাবে পড়তে হতো না।’
যেকোন দুর্যোগ মোকাবেলায় ফায়ার সার্ভিসের অনেক সফলতা রয়েছে উল্লেখ করে দুর্ঘটনার সময় কাউকে দোষারোপ না করে নিজেদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিরও আহ্বান জানান মেজর শাকিল নেওয়াজ।
তিনি বলেন: নিজের নিরাপত্তা সর্বপ্রথমে নিজের নিশ্চিত করতে হবে। কোন একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। যেকোন দুর্যোগে জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।
যে কোন দুর্যোগে কিছু ভুল হলেও ফায়ার সার্ভিসের দোষ না ধরে নিজেদের সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ জানিয়ে তিনি বলেন: ঈদের মধ্যে লঞ্চে কী ভিড়টাই না হয়। ক’জন যাত্রী নিজেদের কাছে লাইফ জ্যাকেট রাখে, কিংবা বর্তমান সময়ে কতোজন মানুষ সাঁতার জানে? সর্বোপরি কিছুক্ষণের জন্য হলেও তো নিজের সুরক্ষা নিজেকে দিতে হয়। দুর্ঘটনা ঘটলে সেখানে ফায়ার সার্ভিসের যেতে আধ ঘন্টা সময়তো লাগবেই।
বর্তমান সময়ে ফায়ার সার্ভিস কতোটা উন্নত ও সমৃদ্ধ এমন প্রশ্নের জবাবে ফায়ারের এই উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন: আসলে গত পাঁচ থেকে দশ বছরে ফায়ার সার্ভিস উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন করেছে। বর্তমান সরকার অনেক অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়েছে।
‘সরকার আমাদের জনবলও দিচ্ছে, কিন্তু জনবল তো নিয়োগের দুই তিনদিনের মধ্যেই মাঠে যেতে পারে না। তাদের এক বছর প্রশিক্ষণ দিতে হয়, তারপর তারা আস্তে আস্তে গড়ে উঠে। দেশজুড়ে আমাদের জনবল মোট আট হাজার, এর মধ্যে বেসামরিক লোক রয়েছে, তাদের বাদ দিলে ছয় হাজার লোক রয়েছে। এই ছয় হাজার লোক দিয়ে আমরা এমন কিছু নেই যে করছি না।’
তিনি বলেন: আমাদের যেকোন কাজেই জড়াতে হয়। ভিআইপি থেকে শুরু করে খেলোয়াড় নিয়ে আসা পর্যন্ত। বড় কোন দুর্ঘটনায় আমরা যাচ্ছি, চিকিৎসার জন্য অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত আমরা দেই।
‘পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশে তিন শিফটে ভাগ হয়ে ২৪ ঘন্টা ফায়ারের লোকজন কাজ করে, কিন্তু আমাদের এখানে সে সিস্টেম নেই। আমাদের ফায়ার সার্ভিসের এই কাঠামো ১৯৮২ সালে করা, তখন রাজধানীতে ছিল ১১টি স্টেশন আর এখন রয়েছে ১৩ থেকে ১৪টি স্টেশন। ১৯৮২ সালের লোকসংখ্যা আর এখনকার লোক সংখ্যা প্রচুর পার্থক্য।
যেকোন রকমের বড় দুর্যোগে শুধুমাত্র ফায়ার সার্ভিস নয় এলাকাবাসী থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি সবার সমন্বিত উদ্যোগ থাকতে হবে। তাহলে দুর্যোগ মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।’
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে ডুবে যাওয়া বালুবাহী বাল্কহেডের ভেতর থেকে ২৮ ঘণ্টা পর সোহাগ হাওলাদার (৩৫) নামের এক গিজারম্যানকে (ইঞ্জিন সহকারী) জীবিত উদ্ধার করে বেসরকারী ডুবুরিরা। তার আগের দিন বিকেলেই সার্ভিস ও বিআইডব্লিউটিএর ডুবুরি দল নিখোঁজ গিজারম্যানকে উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে সন্ধ্যা সাতটার দিকে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করে।
এর আগে ২০১৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর বিকেলে শাহজাহানপুরে রেলওয়ে মাঠে পরিত্যাক্ত পানির পাম্পের পাইপে পড়ে যায় চার বছরের শিশু জিহাদ। ফায়ার সার্ভিসের ২৩ ঘণ্টার অভিযানে তাকে উদ্ধার করা যায়নি। পরে ২৭ ডিসেম্বর বেলা তিনটার দিকে একদল স্বেচ্ছাসেবী পাইপের ভেতর থেকে তার নিথর দেহ উদ্ধার করে। ওই মামলায় ইতোমধ্যে রেলওয়ে ১০ লাখ টাকা ও ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
শাকিল নেওয়াজ বলেন: আমরা ফায়ার সার্ভিস কখনোই জায়গা ত্যাগ করি না, মুগদায় এখন পর্যন্ত আমাদের লোক আছে, আমরা কখনোই চাই না একটা মৃত ব্যক্তিকে উদ্ধার করতে। তবে নারায়নগঞ্জের যে ব্যাপারটির কথা বলছেন তা আমার জানা নেই।
ডুবুরিদের দক্ষতা নিয়ে তিনি বলেন: পুরানো কাঠামো থাকায় বর্তমানে সারা দেশে আমাদের ডুবুরি মাত্র ২৫ জন। আমরা ডুবুরির প্রজেক্ট প্রক্রিয়ার কাজ উন্নতিকরণ করছি, এটা বাস্তবায়ন হলে আর কোন সমস্যা হবে না, প্রত্যেকটা জেলায় জেলায় আমাদের ডুবুরি থাকবে, তখন আর কোন সমস্যা হবে না।
ফায়ার সার্ভিসকে আরো উন্নত হতে হলে কী কী প্রয়োজন জানতে চাইলে তিনি বলেন: বর্তমান সরকারের কাছ থেকে যে সুযোগ সুবিধা আমরা পাচ্ছি তাতে আশা রাখি আগামী পাঁচ দশ বছরের মধ্যে ফায়ার সার্ভিস আরও উন্নত হবে। দিন দিন আমরা উন্নত হচ্ছি। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, জনবল নিয়োগ সহ সকল প্রক্রিয়া আমরা অব্যাহত রেখেছি।
তবে শুধুমাত্র আমাদের উন্নতি হলে হবে না, আমাদের পাশপাশি সবার সচেতনতা ও উন্নতি সাধন করতে হবে। সচেতনতা অনেক সময় বড় বিপর্যয় থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।