চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

কাপ্তাই বাঁধের কারণে ঘরহারা শরণার্থীদের কী হবে?

রাখাইনে রাষ্ট্রীয় মদদে জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আসায় কক্সবাজারে মানবিক বিপর্যয় চলছে। তারা এখানে এসে ওই নির্যাতনের বিষয়ে যে ভয়াবহ বর্ণনা দিচ্ছেন, তা সত্যিই হৃদয়বিদারক। এ কারণে স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্রীয় হুমকিসহ আরও অন্যান্য ঝুঁকি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মানবিক দিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য শুরুর দিকে আঞ্চলিক রাজনীতি ও স্বার্থের কারণে চীন-ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশের অমানবিক অবস্থান লক্ষ্য করা গেলেও ঘরহারা এসব মানুষের পক্ষে মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল জনমতের কারণে তারাও এসব শরণার্থীকে সহযোগিতা করতে এবং তাদের হারানো ঘরবাড়ি ও নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে মিয়ানমারকে চাপ দিতে বাধ্য হয়েছে।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার শুরুর দিকে কিছুটা অস্পষ্ট নীতি গ্রহণ করলেও পরে নির্যাতিত এসব মানুষের পক্ষে প্রবল জনমতের কারণে তাদেরকে আশ্রয় দিতে শুরু করে। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর কক্সবাজার সফরের মাধ্যমে নিপীড়নের শিকার এসব মানুষের পক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান সুস্পষ্ট হয়। এক্ষেত্রেও বলা যায়, মানবতা এবং মানবিকতার পক্ষে সাধারণ মানুষের অবস্থানের বিজয় হয়েছে। আরও খুশির খবর হলো- বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে আমরা যার যার অবস্থান থেকে এই অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে দেখেছি এবং তাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব প্রদানের মাধ্যমে সেখানে ফিরিয়ে নেয়ার জোরালো দাবি তুলতে দেখছি। এটা অবশ্যই ভালো দিক। কেননা প্রত্যেক মানুষের নিজদেশে, নিজের বাড়িঘরে, পরিবার-পরিজন নিয়ে নিরাপদভাবে বাস করার অধিকার রয়েছে। আর এই বিষয়টা আমরা সবার চেয়ে ভালো বুঝি এই কারণে যে, আমাদের দেশের জন্মলগ্নে আমরা পাকিস্তানের বর্বরতায় একই অবস্থার শিকার হয়েছি।

কাপ্তাই লেক। ছবি: গেটি ইমেজেস

তবে বাংলাদেশের এই মানবিকতার বিপরীতে পাকিস্তান আমলের একটি অমানবিকতার ইতিহাস রয়েছে যেটা স্বাধীনতার পরও সুন্দরভাবে সমাধান করা যায়নি, যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার। সেই ইতিহাস গত শতাব্দীর পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের। ওই সময়ে চট্টগ্রামে কাপ্তাই বাঁধের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের হাজার হাজার পরিবার ঘরহারা হয়েছিল। বাঁধের জন্য জমি অধিগ্রহণ বিষয়ে সেখানকার মানুষের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। তাই শেষ পর্যন্ত বিষয়টি সংঘর্ষে জড়ায়। এরপর পাহাড়িদের ওপর শুরু হয় পাকিস্তানের বর্বরতা। আর সেই কারণে পাহাড়িরা ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এর মধ্যে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তন বক্তা ও কানাডার ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি অব অন্টারিও’র প্রেসিডেন্ট প্রফেসর অমিত চাকমার পরিবারও। অবশ্য স্বাধীনতার পরও বিভিন্ন সময়ে পাহাড়িরা তাদের আবাসভূমি ছেড়ে ভারতে পালিয়ে শরণার্থী হতে বাধ্য হয়েছিল।

সর্বশেষ সংবাদ হলো- পাঁচ দশকেরও আগে ভারতে চলে যাওয়া এসব শরণার্থীর মধ্যে অরুণাচল প্রদেশে চাকমা ও হাজং শরণার্থীদের সেখানকার শর্তসাপেক্ষ নাগরিকত্ব দেয়ার ঘোষণা এসেছে। এরা শুরুর দিকে সংখ্যায় প্রায় পাঁচ হাজার থাকলেও ৫০ বছর পর এখন প্রায় পাঁচ লাখের মতো। মূলত অরুণাচল সরকার সবসময়ই তাদেরকে নাগরিকত্ব দেয়ার বিরোধী ছিল। তাই এ বিষয়ে একটি মানবাধিকার সংস্থার মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তাদেরকে নাগরিকত্ব দেয়ার পক্ষে রায় দেয়। আর সুপ্রিম কোর্টের রায় কেন্দ্রীয় সরকার মানতে বাধ্য হওয়ায় এখন তারা শর্তসাপেক্ষ নাগরিকত্বের বিষয়টি সামনে আনছে।

তবে শর্তসাপেক্ষ নাগরিকত্ব চাকমা এবং হাজং শরণার্থীরা প্রত্যাখ্যান করছে। কেননা এর ফলে তারা ভারতের পূর্ণ নাগরিকত্ব পাচ্ছে না। এছাড়া অরুণাচলে তারা জায়গা-জমি কিনে স্থানীয়দের মতো বাড়িঘর করে থাকতে পারবে না, যেই সুবিধা ভারতের অন্যান্য রাজ্যে থাকা কাপ্তাই বাঁধের শরণার্থীরা পায়। তাই প্রকৃতপক্ষে এটা মূলত তাদের জন্য অবমাননাকর।

অরুণাচলে চাকমা ও হাজং শরণার্থীদের বাসস্থান

ভারতের অন্যান্য রাজ্যে একইরকম শরণার্থীদের পূর্ণ নাগরিকত্ব দেয়া হলেও অরুণাচলে তাদেরকে নাগরিকত্ব দেয়া হচ্ছে না মূলত অরুণাচলের সাধারণ মানুষের তীব্র আপত্তির কারণে। কেননা স্থানীয়রা মনে করে, এসব পাহাড়ি তাদের চেয়েও বেশি পরিশ্রমী, আর নাগরিকত্ব পেলে তারা নিজেদের পরিশ্রমের মাধ্যমে স্থানীয়দের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। তাই তাদের নাগরিকত্ব দেয়ার বিরুদ্ধে অরুণাচলের মানুষ।

হয়তোবা আবারও আদালতের নির্দেশে তারা সেখানকার পূর্ণ নাগরিকত্ব পেতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো- তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে যাওয়া এসব শরণার্থীর বিষয়ে কি বাংলাদেশের কোন দায় নেই? নিজের নাগরিকদের অন্য দেশ পূর্ণ নাগরিকত্ব দিতে চায় না এটা কি সেই শরণার্থীদের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের জন্য অবমাননাকর নয়? পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক হিসেবে আমাদের কি মনে হয় না যে, এদেশটা পাহড়িদেরও? তারা তো নিজেদের ঘরবাড়ি রক্ষার জন্যই পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার এতবছর পরও কি আমরা তাদের ঘরবাড়ি ফিরিয়ে দিতে পেরেছি? সাম্প্রতিক সময়ের কথা বললে বলতে হয়, মুন্সিগঞ্জের আড়িয়াল বিলেও তো জমি অধিগ্রহণ নিয়ে তুমুল আন্দোলন আর সংঘাতের মুখে সরকার সেখান থেকে পিছু হটেছে। সেজন্য তো কাউকে ঘরহারা আর দেশছাড়া হতে হয়নি। তাহলে নিজের ঘর রক্ষার জন্য আন্দোলন করে পাহাড়িদের কেন দেশছাড়া হতে হবে? কেন তাদেরকে অন্যদেশে গিয়ে অবমাননাকর নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে হবে?

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ, কাপ্তাই বাঁধের কারণে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে শরণার্থী হওয়া এসব চাকমা ও হাজংসহ সকল শরণার্থীর মধ্যে যারা বাংলাদেশে ফিরতে চায় তাদেরকে পূর্ণ নাগরিকত্ব প্রদান করে সসম্মানে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। অমানবিক পাকিস্তানের বিপরীতে স্বাধীন এবং মানবিক বাংলাদেশের কাছে এই প্রত্যাশাটুকু নিশ্চয়ই খুব বেশি নয়। কেননা শরণার্থী ইস্যুতে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ খেতাব পাওয়া আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানে ভিনদেশী শরণার্থীদের সঙ্গে প্রয়োজনে খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়ার কথা বলেছেন, সেখানে ভিনদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হওয়া আমাদের নাগরিকদের আমরা এই অবমাননাকর ও অমানবিক অবস্থায় থাকার বিষয়টি কল্পনা করতে পারি না।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)