কানাডার আদিবাসীদের দীর্ঘকাল জুড়ে বঞ্চনা এবং এর সমাধানকল্পে সদ্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত লিবারেল সরকারের গৃহীত নানান পদক্ষেপ এখন কানাডায় একটি অন্যতম আলোচিত বিষয়।
১৯৮২ সালের সাংবিধানিক আইনের ৩৫ ধারা অনুযায়ী কানাডায় বসবাসরত আদিবাসীদের মূলত তিনভাগে ভাগ করা যায়: ফার্স্ট নেশন, মেতিস এবং ইনুইট। ২০১১ সালের শুমারী অনুযায়ী এই আদিবাসীদের সংখ্যা ১,৪০০,৬৮৫ যা মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪.৩ ভাগ। এরা ৬৩৪ টির মতো স্বীকৃত ব্যান্ড বা গ্রুপে ছড়িয়ে রয়েছে। এদের রয়েছে স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, ভাষা, শিল্পকলা, সংগীত। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই আদিবাসীরা সামগ্রিক কানাডীয় সংস্কৃতি নির্মাণের অবিচ্ছেদ্য এবং অপরিহার্য অংশ।
ফার্ষ্ট নেশনদের কানাডায় বসতি এবং বাণিজ্য যোগাযোগ শুরুর সময়কাল ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এদের অর্ধেকেরই বসবাস অন্টারিও এবং বৃটিশ কলম্বিয়া প্রদেশে। ফার্ষ্ট নেশনদের সংখ্যা ৮,৫০,০০০। সত্তরের দশক থেকেই ‘ইন্ডিয়ান’ শব্দটি প্রতিস্থাপিত হয় ফার্ষ্ট নেশন দ্বারা। এই ফার্ষ্ট নেশনদের মধ্যে কানাডার উত্তর-পশ্চিমে আথাপাস্কান, দোগ্রিব; প্রশান্ত মহাসাগর উপকূলবর্তী অংশে হাইদা, সালিশ, ক্যকিউটল, নুটকা, নিসগা; সমতলে ব্ল্যাকফুট, পেইগান; উত্তরের বনাঞ্চলে ক্রি; গ্রেট লেক এলাকায় এলগোনকুইন, ইরোকুয়া, হুরন; এবং আটলান্টিক এর উপকূলে বেওথুক, ইন্নু ইত্যাদি গোষ্ঠীর বসবাস। ফার্ষ্ট নেশনরা ইউরোপীয়দের সংস্পর্শে আসে ১০০০ খ্রিস্টাব্দের সময়ই। তবে খুব বর্ধিত যোগাযোগ হয় সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে, ইউরোপীয়রা কানাডায় স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপনের পর।
ইনুইটদের বসবাস কানাডার উত্তরে। ১৯৮২ সালের সাংবিধানিক আইনের ২৫ এবং ৩৫ ধারায় ইনুইটদেরকে ফার্ষ্ট নেশন কিংবা মেতিসদের থেকে স্বতন্ত্র আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কানাডায় ইনুইট শব্দটি দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে এস্কিমো শব্দটি। ইনুইটদের সংখ্যা ৫০,৪৮০। এরা মূলত বসবাস করে কানাডার সুমেরু অঞ্চলের ন্যুনাভেট টেরিটোরি, ক্যেবেক, ল্যাব্রাডর, উত্তর-পশ্চিম টেরিটোরির বিভিন্ন এলাকায় এবং সুমেরু মহাসাগরের তীরবর্তী বিভিন্ন অংশে।
বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ফার্ষ্ট নেশন এবং ইনুইটদের পাশাপাশি মেতিসরাও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায় স্বতন্ত্র আদিবাসী হিসেবে। প্রাথমিকভাবে মেতিস বলতে ফার্ষ্ট নেশন এবং ইউরোপীয় মিশ্রণ বুঝানো হলেও সময়ের সাথে এর অর্থ বর্ধিত হয়। ২০১১ সালের শুমারী অনুযায়ী মেতিসদের সংখ্যা ৪,৫১,৭৯৫, যা মোট জনসংখ্যার শতকরা ১.৪ ভাগ এবং মোট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শতকরা ৩২.৩ ভাগ। মেতিসরা প্রথম বসতি স্থাপন করে কানাডার অন্টারিও প্রদেশে, গ্রেট লেকের পার্শ্ববর্তী এলাকায় এবং পূর্ব কানাডায়। পরে রেশম বাণিজ্যের সুবিধার্থে তারা স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে মেতিসরা ব্রিটিশ কলম্বিয়া এবং উত্তর-পশ্চিম টেরিটোরির ম্যাকেন্জি নদীর উত্তর পর্যন্ত বিস্তৃত।
আত্ত্বীকরণের নামে কানাডীয় আদিবাসীদের অর্থাৎ ফার্ষ্ট নেশন, ইনুইট এবং মেতিসদের রাষ্ট্রীয়ভাবে বঞ্চণার ইতিহাস অনেক পুরোনো। আঠারোশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই কানাডীয় সরকার এবং ইউরোপীয়-কানাডীয়রা আদিবাসীদের ‘মূল’ কানাডীয় সংস্কৃতিতে আত্ত্বীকরণ প্রক্রিয়ায় উৎসাহিত করতে শুরু করে। ঊনবিংশ শতকের শেষে এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতে একের পর এক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় পরিপূর্ণভাবে আদিবাসীদের ‘মূলধারার’ সংস্কৃতিতে একীভূত করে ফেলার জন্য। এর জন্য প্রণীত হয় গ্র্যাজুয়াল সিভিলাইজেশন অ্যাক্ট, দ্য ইন্ডিয়ান অ্যাক্ট ইত্যাদি নানান ধরনের আইন, যেগুলোর কেন্দ্রীয় ভাবনাই ছিল ইউরোপীয় আদর্শের খ্রিস্টীয়বাদ, স্থায়ীভাবে বসবাসভিত্তিক জীবনযাপন, কৃষি এবং শিক্ষা।
১৬০০ খৃষ্টাব্দে যখন প্রথম মিশনারীরা কানাডায় আসে মূলত তখন থেকেই আদিবাসীদের ধর্মান্তরকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে ১৮৬৭ সালে ইন্ডিয়ান অ্যাক্ট প্রণয়নের মাধ্যমে এটি নিয়মতান্ত্রিক রূপ পায়, যেখানে যারা ধর্মান্তরিত হবেনা তাদের ক্ষেত্রে নানান নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় অনাগ্রহীদের কোর্টে আইনগত সুবিধা হ্রাস, মদ্যপানে নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি। এই আইনটি সংশোধিত হয় ১৮৮৪ তে এবং এর মাধ্যমে আদিবাসীদের সনাতন ধর্মীয় এবং সামাজিক আচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয় (পটল্যাচ নিষিদ্ধকরণ)। ১৯২০ এ এই আইন পুন:সংশোধনের মাধ্যমে অ-খ্রিষ্টীয় আচার যেমন আদিবাসীদের প্রচলিত পোশাক, নৃত্য ইত্যাদিতেও নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়।
ধর্মান্তরকরণের পাশাপাশি ‘মূল’ স্রোতে নিয়ে আসার জন্য আদিবাসীদেরকে স্থায়ী বসবাসভিত্তিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তুলবার প্রচেষ্টা ও চলতে থাকে। ঊনবিংশ শতকে গড়ে তোলা হয় মডেল কৃষিভিত্তিক লোকালয় যাতে তারা কৃষিনির্ভর স্থায়ী আবাসনে অভ্যস্ত হয়ে উঠে। এই প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে ১৮৬৭ সালের ইন্ডিয়ান অ্যাক্টের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয় আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত এলাকা বা রিজার্ভেশন। এর সাথে যুক্ত করে দেয়া হয় আরো নিষেধাজ্ঞা, যেমন যে কোনো ধরনের মদ্যপান নিষিদ্ধকরণ, ব্যান্ডের নির্বাচনে ভোট প্রদান রহিতকরণ, শিকার এবং মৎস্য ধরার এলাকা সংকোচন, এক এলাকার আদিবাসীদের সাথে অন্য এলাকার আদিবাসীদের যোগাযোগ বন্ধ ইত্যাদি।
১৮৫৭ সালে গ্র্যাজুয়াল সিভিলাইজেশন অ্যাক্ট প্রণয়নের মাধ্যমে অন্যান্য কানাডীয়দের সাথে আদিবাসীদের আইনগত পার্থক্য ঘুচানোর লক্ষ্যে তাদেরকে তাদের আদিবাসী পরিচয় প্রত্যাখ্যান করতে উৎসাহিত করা হয়। যদি কেউ এতে রাজী হয়, তবে তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের আদিবাসী পরিচয় অপসারিত হয়ে যাবে, যাতে তারা কানাডীয় সমাজে আরো বেশী একীভূত হতে পারে। যদিও তখনো ইউরোপীয়রা তাদেরকে কানাডীয় নাগরিক হিসেবে বিবেচনাই করতোনা। তবে এ প্রক্রিয়ায় খুব কমই সাড়া মিলেছিল। এবং যেসব অল্পকিছুসংখ্যক আদিবাসী এই প্রক্রিয়ায় তাদের আত্মপরিচয় বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছিল, তার ফলাফলও হতাশাব্যাঞ্জক ছিল। পরবর্তীতে ১৮৬৭ সালে প্রনীত ইন্ডিয়ান অ্যাক্টের মাধ্যমে একে বাধ্যতামূলক করা হয়। এবং স্বপরিচয় লুপ্ত করার মাধ্যমে আদিবাসীরা পায় নানান নাগরিক সুবিধাদি, যেমন, সেনাবাহিনীতে অংশগ্রহণ, সংরক্ষিত এলাকায় দীর্ঘ সময় অনুপস্থিত থাকার সুযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ইত্যাদি। ১৯৫১ সালে এবং ১৯৮৫ সালে দুটি বড় সংশোধন আসে এই আইনের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটাস অংশে।
ইন্ডিয়ান অ্যাক্টের মাধ্যমে আদিবাসীদের আত্ত্বীকরণের সর্বশেষ ধাপটি ছিল কানাডীয় আবাসিক বিদ্যালয়ের প্রবর্তন। এর মাধ্যমে আদিবাসী শিশুদেরকে তাদের ‘বন্য’ কমিউনিটি থেকে ‘উচ্চতর’ এবং ‘সভ্য’ করে তুলবার চেষ্টা চলতো। ১৮৪৭ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ক্যাথলিক চার্চ এবং কানাডীয় সরকারের যৌথ প্রচেষ্টায় সমগ্র কানাডা জুড়ে ১৩০টি আবাসিক বিদ্যালয় পরিচালিত হয়, যেখানে আদিবাসী শিশুদেরকে তাদের বাসস্থান থেকে জোরপূর্বক নিয়ে আসা হতো। শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে এই বিদ্যালয়গুলি প্রতিষ্ঠিত হলেও এগুলোতে ঠিকমত অর্থায়ন হয়নি এবং অপব্যবহারের মাধ্যম হিসেবেই এগুলো বেশি ব্যবহৃত হয়েছে।
আইন এবং নানান কর্মসূচীর মাধ্যমে আদিবাসীদের ইউরোসেন্ট্রিক সমাজে আত্ত্বীকরণের এসব প্রক্রিয়া সর্বদিক দিয়েই ১৯৪৯ সালে কানাডার স্বাক্ষরকৃত এবং ১৯৫২ সালে কানাডার সংসদে পাশকৃত ইউনাইটেড নেশনস জেনোসাইড কনভেনশনের সুস্পষ্ট লংঘন। আদিবাসী শিশুদেরকে জোরপূর্বক তাদের বাসস্থান থেকে আবাসিক বিদ্যালয়গুলোতে স্থানান্তরের জন্য কানাডাকে এমনকি আন্তর্জাতিক গণহত্যা ট্রাইব্যুনালের ও মুখোমুখি হবার আশংকা দেখা দেয়।
অবশেষে ২০০৮ সালের জুন মাসে গঠন করা হয় ‘ট্রুথ এন্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশন’। এই কমিশন ‘ইন্ডিয়ান রেসিডেনশিয়াল স্কুলস সেটেলমেন্ট এগ্রিমেন্টে’রই একটি বর্ধিত উপাদান বা সংযোজন। এই কমিশনের সহযোগী কানাডার কেন্দ্রীয় সরকারের ট্রুথ এন্ড রিকন্সিলিয়েশন সেক্রেটারিয়েট। এর লক্ষ্য ছিল ইন্ডিয়ান আবাসিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল তা সব কানাডীয়দের অবহিত করা। এই কমিশনে আবাসিক বিদ্যালয়গুলোর প্রাক্তন ফার্ষ্ট নেশন, ইনুইট এবং মেতিস শিক্ষার্থী, তাদের পরিবার, কমিউনিটির সদস্য, চার্চ, বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সবার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় দীর্ঘ ৬ বছর ধরে। গতবছর অর্থাৎ ২০০৫ সালে এর একটি সংক্ষিপ্ত সামারি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এতে উঠে আসে ৯৪ টি বিষয়ে অতি দ্রুত রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ এবং বাস্তবায়নের প্রস্তাবনা। ২০০৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তৎকালীন রক্ষণশীল প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার কানাডীয় সরকার এবং এর নাগরিকদের পক্ষ থেকে আবাসিক বিদ্যালয় ব্যবস্থার জন্য ক্ষমা প্রার্থণা করেন।
বর্তমানে কানাডার ক্ষমতায় আছে লিবারেলরা। গত অক্টোবরের ফেডারেল নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এরা সরকার গঠন করে। লিবারেলদের একটি অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল নিখোঁজ এবং হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া আদিবাসী নারীদের ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় তদন্তসহ ট্রুথ এন্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশনের ৯৪ টি প্রস্তাবনার সবগুলোরই বাস্তবায়ন। উল্লেখ্য, এবারে সর্বাধিক ১০ জন আদিবাসী প্রার্থী ফেডারেল নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন এবং লিবারেল প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর মন্ত্রীসভায় আইন মন্ত্রনালয়ের মতন অতি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় এবং ইন্ডিজিনাস এন্ড নর্দার্ন অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুজন মন্ত্রীই আদিবাসী। নভেম্বরে এবারের মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো অন্তর্ভুক্ত ছিল আদিবাসী সংগীত, নৃত্য এবং বাদ্য। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পরপরই আনুষ্ঠানিকভাবে থ্রৌন স্পিচে সরকারের প্রতিশ্রুত নানান সেক্টরের অগ্রাধিকারমূলক কর্ম পরিকল্পনার মধ্যে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় আদিবাসীদের বিষয়ে প্রতিশ্রুতির কথা।
বর্তমানের লিবারেল সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আদিবাসী বিষয়ক দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা অনেকটাই কাটতে শুরু করেছে এবং খুব সম্প্রতি কিছু সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনাও রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত হয়েছে।
গত ৮ ডিসেম্বর কোবেকের গাতিনুতে এসেম্বলী অব ফার্ষ্ট নেশনস আয়োজিত ৩ দিন ব্যাপী সম্মেলনে শত শত ফার্ষ্ট নেশন প্রধান এবং প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তার বক্তব্যে ৫ টি বিষয়কে সামনে নিয়ে খুব শীঘ্র কাজ শুরু করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন, যা তাদের সাম্প্রতিক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত ছিলঃ ১) নিখোঁজ এবং খুন হওয়া আদিবাসী নারীদের বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে তদন্ত করা, যা ইতিমধ্যে প্রক্রিয়াধীন। ট্রুডো বলেন, তার সরকার এই তদন্তকে একটি অন্যতম অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করছে। কারণ, এই ট্র্যাজেডির শিকাররা এর প্রতিকারের জন্য অপেক্ষা করেছেন সুদীর্ঘ সময়। ন্যায়বিচারের মাধ্যমে নির্মমতার শিকার পরিবারদের কিছুটা হলেও যন্ত্রণা লাঘব করা যাবে। ২) ফার্ষ্টনেশনের শিক্ষা বাবদ উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ দেয়া ৩) ফার্ষ্টনেশনের শিক্ষার জন্য শতকরা ২ ভাগ লিমিট তুলে দেয়া। এই বরাদ্দ এবং লিমিট তুলে নেয়া, এই নতুন বছরের অর্থাৎ ২০১৬ সালের প্রথম বাজেটেই বাস্তবায়িত হবে। শতকরা ২ ভাগ লিমিটের বিষয়টি বলবৎ আছে গত ২০ বছর ধরে। ট্রুডো বলেন, সময় এসেছে ফার্ষ্ট নেশনের সাথে পর্যাপ্ত ও গ্রহণযোগ্য বরাদ্দের মাধ্যমে নতুন ফিসক্যাল সম্পর্ক তৈরীর। ৪) ট্রুথ এন্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশনের ৯৪ টি প্রস্তাবনার সবগুলো বাস্তবায়িত করা, যার শুরু হবে আদিবাসীদের অধিকারের ব্যাপারে জাতিসংঘ প্রনীত ঘোষণার বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। ৫) আদিবাসীদের উপর একপাক্ষিকভাবে চাপিয়ে দেয়া এবং রক্ষণশীল স্টিফেন হারপার সরকারের সময় এককভাবে গৃহীত হওয়া সব আইনকে প্রত্যাহার করা। ঐ সমস্ত আইনের সম্পূর্ণ রিভিউ করা এবং আদিবাসীদের অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক, সুশাসনের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, অথবা পাবলিক পলিসির সাথে অসংগতিপুর্ণ সব ধরনের আইনকেই এর আওতায় আনা হবে বলে জানান তিনি। ট্রুডো বলেন, আদিবাসীদের সাথে সম্পর্ক পুন:নির্মাণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এই ৫টি ছাড়াও আরো অনেক কিছুই করণীয় আছে। তিনি বলেন ফার্ষ্ট নেশনদের সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত অধিকারে অসুবিধেজনক কিছু নেই বরং এ বিষয়টি একটি পবিত্র আইনগত বাধ্যবাধকতা।
এই সমাবেশেই এসেম্বলী অব ফার্ষ্ট নেশনের জাতীয় নেতা পেরি বেলগার্ডে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে অভিবাদন জানান। তিনি বলেন, ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ট্রুডোর নেতৃত্বে লিবারেল সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ আশাবাদের যথেষ্ট কারণ তৈরি করেছে। তিনি আরো বলেন, তাদের মানুষেরা অমানবিক অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়েছে সুদীর্ঘ সময়, বঞ্চিত হয়েছে অনেক মৌলিক নাগরিক সুবিধাদি থেকে, ন্যায় বিচারের জন্য অপেক্ষা করেছে দীর্ঘকাল। কাজেই কানাডীয় সরকারের উচিৎ অতি শীঘ্র আদিবাসী ও অন্যান্য ক্যানাডীয় নাগরিকদের মধ্যকার নাগরিক জীবনযাপন মানের পার্থক্য ঘুচানো।
সেদিনই, অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর, অটোয়ার পার্লামেন্ট হিল থেকে স্ট্যাটাস অফ উইমেন মন্ত্রী প্যাট্রিসিয়া হাজডু এবং ইন্ডিজিনাস অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রী ক্যারোলিন বেনেট এর উপস্থিতিতে আইন মন্ত্রী জোডি উইলসন-রেবোল্ড, সংবাদ সম্মেলন করে বহুল প্রতীক্ষিত নিখোঁজ ও খুন হওয়া আদিবাসী নারীদের তদন্তের দুই পর্বের প্রথম পর্ব শুরুর ঘোষণা দেন। তিনি জানান, এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তারা সে সপ্তাহের মধ্যেই হারিয়ে যাওয়া ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া আদিবাসী নারীদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করবেন অটোয়ায়। যার উদ্দেশ্য হবে তদন্তের রূপরেখায় তাদের অভিমত এবং এর মাধ্যমে তদন্তের লক্ষ্য নির্ধারণ করা। এবং পরবর্তী দুই মাস ধরে আরো পরিবার, আদিবাসী সদস্য, জাতীয় আদিবাসী সংগঠন, সম্মুখ সারির সরকারী কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে।
উল্লেখ্য, গত বছরের শুরুতে জাতীয় পর্যায়ে প্রথম পুলিশ রিপোর্টে জানা যায়, কত সংখ্যক ফার্ষ্ট নেশন, ইনুইট আর মেতিস আদিবাসী নারীকে হত্যা করা হয়েছে কিংবা নিখোঁজ রয়েছেন। ১৯৮০ থেকে ২০১২ পর্যন্ত প্রায় ১২০০ জনের কথা জানা যায়। এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর হার কানাডার অন্যান্য নারীদের তুলনায় প্রায় ৪.৫ গুণ বেশি। এতে আরো জানানো হয়, ২০১৩ সালের নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত আরো ১০৫ জন আদিবাসী নারী নিখোঁজ হন সন্দেহজনক পরিস্থিতি এবং অজানা কারণে। ২০১৫ সালের জাতিসংঘের রিপোর্টে দেখা যায়, আদিবাসী নারীরা অন্য কানাডীয় নারীদের তুলণায় ৫ গুণ বেশি ভায়োলেন্সের শিকার হয়ে মত্যুবরণ করে থাকেন।
জোডি উইলসন-রেবোল্ড, যিনি প্রথম আদিবাসী হিসেবে আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হবার আগে এসেম্বলী অফ ফার্ষ্ট নেশনস এর আঞ্চলিক প্রধান ছিলেন, তিনি ৮ ডিসেম্বরের সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এর আগের এই তদন্তের সব আহ্বান পূর্ববর্তী রক্ষণশীল হারপার সরকারের সময় উপেক্ষিত হয়েছে নীরবতার দ্বারা। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবার নিশ্চিতভাবেই এর চাইতে বেশি প্রাপ্য। ইন্ডিজিনাস অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রী ক্যারোলিন বেনেট জানান, এই মতামত নেয়ার পর্যায় ততক্ষণ চলবে যতক্ষণ না সঠিকভাবে লক্ষ্য অর্জিত হয়। তিনি বলেন, এই ঘোষণা, সবার অংশগ্রহণে যৌথ এবং সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে। তদন্তের প্রথম পর্যায় নির্ধারণ করবে এর লক্ষ্য, ফোকাস এবং প্যারামিটার। আর এই প্রথম পর্যায়ের পর ২য় পর্যায়ে হবে মূল তদন্ত, যার বিশদ জানানো হবে এই বছরের বসন্তে। এই তদন্তে দুই বছরে (২০১৬ থেকে শুরু) ব্যায় হবে ৪০ মিলিয়ন ডলার।
৮ ডিসেম্বরের ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায়, অন্তর্বর্তীকালীন রক্ষণশীল দলের প্রধান রোনা অ্যামব্রোস বলেন, লিবারেলরা খুব দারুণ সূচনা করেছে। ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (কেন্দ্রে ২য় বিরোধী দল) প্রধান টম ম্যালকেয়ার সরকারের এই পদক্ষেপে অভিবাদন জানালেও সুনির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ না থাকায় শঙ্কা প্রকাশ করেন। কেন্দ্রের হাউজ অব কমন্সে প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি এই জাতীয় সঙ্কটের অতি দ্রুত নিষ্পত্তির বিবেচনায় ২০১৬ সালের শেষের মধ্যে কোনো রিপোর্ট পাওয়া যাবে কিনা জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো সরাসরি এর উত্তর এড়িয়ে গিয়ে বলেন সঠিক এবং যথাযথ তদন্তই তার সরকারের মূল লক্ষ্য। সেক্ষেত্রে সময়টাই একমাত্র বিবেচ্য নয়। উল্লেখ্য, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টিরও অন্যতম আগ্রহের বিষয় এবং নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল আদিবাসীদের সব ধরনের সমস্যার সমাধান করা। এই ঘোষণাকে জাতীয় আদিবাসী প্রধান বেলগার্ডে অভিনন্দন জানান লিখিত বক্তব্যে। তিনি বলেন, বছরের পর বছর ধরে অস্বীকার এবং অন্যায়ের পর এটা তার আশা যে, হয়তো এখন সত্যিকার অর্থেই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো ন্যায্য বিচার পাবে এবং সব মানুষ সমানভাবে নিরাপত্তা এবং নিশ্চয়তা পেতে সক্ষম হবে।
ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ কানাডার আবাসিক বিদ্যালয় ব্যবস্থার ইতিহাস এবং উত্তরাধিকার নিয়ে ট্রুথ এন্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশনের চূড়ান্ত এবং পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এটি একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই রিপোর্ট আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন কমিশনের সভাপতি আদিবাসী বিচারপতি ম্যরে সিনক্লেয়ার। কমিশনের এই চূড়ান্ত রিপোর্ট ৬ বছরের ও বেশি সময় ধরে ছয় হাজারের ও বেশি আবাসিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ফার্ষ্ট নেশন, ইনুইট ও মেতিস সেইসব শিক্ষার্থীদের বীভৎস অভিজ্ঞতা ও বেদনাদায়ক সাক্ষ্যর উপর ভিত্তি করে রচিত, যাদেরকে জোরপূর্বক পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে বাধ্য করা হয়েছিল আবাসিক বিদ্যালয়ে পড়তে। রিপোর্টের প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে: ১) আবাসিক বিদ্যালয়গুলোতে মারা যায় ৩২০০ শিশু এবং ধারণা করা হয় এই সংখ্যা আসলে এর দশগুণ বেশি বাস্তবে। ২) ১৯৯৬ সালে আবাসিক বিদ্যালয় ব্যবস্থা বন্ধ হবার আগ পর্যন্ত মোট ১,৫০,০০০ ফার্ষ্ট নেশন, ইনুইট এবং মেতিস শিশু এ ব্যবস্থার অধীনে আসে। ৩) আজ পর্যন্ত প্রায় ৩৮০০০ শিশু আবাসিক বিদ্যালয়গুলোতে শারিরীক এবং লৈঙ্গিক নির্যাতনের কারণে নানান ধরনের ক্ষতির শিকার। এই আবাসিক বিদ্যালয় ব্যবস্থা একটা ভয়ঙ্কর উত্তরাধিকার রেখে গেছে যা আজও বয়ে বেড়াচ্ছে কানাডার আদিবাসীরা।
কমিশনের ৯৪ টি প্রস্তাবনার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ফার্ষ্ট নেশন, ইনুইট এবং মেতিস শিশুদের ক্যাথলিক পরিচালিত আবাসিক বিদ্যালয়গুলোতে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং লৈঙ্গিক নির্যাতনের জন্য, বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং তাদের পরিবারের কাছে পোপের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থণা। আর পোপের এই ক্ষমা প্রার্থণা আদিবাসী এবং রোমান ক্যাথলিক চার্চের মধ্যকার সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে দারুণ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলাই বাহুল্য। উল্লেখ্য, অন্যান্য চার্চ এবং প্রতিষ্ঠান ক্ষমা চাইলেও, এবং ক্যাথলিক চার্চের একেবারে সরাসরি ভূমিকা থাকলেও, তারাই এখনো পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা করেনি বলে জানান এসেম্বলী অফ ফার্ষ্ট নেশনস এর জাতীয় প্রধান পেরি বেলগার্ডে। আর যেহেতু কানাডা এবং সারা পৃথিবীর রোমান ক্যাথলিকরা পোপকে তাদের ধর্মীয়, আত্মিক এবং নৈতিক নেতা মানে, কাজেই সারা কানাডা জুড়ে ক্যাথলিক চার্চ পরিচালিত আবাসিক বিদ্যালয় ব্যবস্থার জন্য, আবাসিক বিদ্যালয় ব্যবস্থার শিকার আদিবাসী এবং তাদের পরিবারের কাছে পোপের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনার বিকল্প নেই। এখানে উল্লেখ্য, রোমান ক্যাথলিক কমিউনিটি এবং এসেম্বলী অফ ফার্ষ্ট নেশনের প্রাক্তন জাতীয় প্রধান ফিল ফনটেইন সহ আদিবাসী নেতাদের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিদের সাথে মত বিনিময়ের পর, ২০০৯ সালে ভ্যাটিকানের একটি লিখিত বক্তব্যে, চার্চের কিছুসংখ্যক সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের জন্য ষোড়শ পোপ বেনেডিক্ট তার দুঃখ প্রকাশ করেন। তবে এটি তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, শুধুমাত্র এ ধরনের দুঃখ প্রকাশ একেবারেই যথেষ্ট নয়।
প্রধানমন্ত্রী জাষ্টিন ট্রুডো, ট্রুথ এন্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রকাশের দিনই, অর্থাৎ ডিসেম্বরের ১৫ তারিখে কমিশনের চুড়ান্ত রিপোর্ট নিয়ে আলোচনার জন্য অটোয়ায় দুই ঘণ্টাব্যাপী এক সভা করেন এসেম্বলী অফ ফার্ষ্ট নেশন (পেরি বেলগার্ডে) সহ আরো চারটি জাতীয় আদিবাসী সংগঠনের প্রধানদের সাথে। অন্যান্য সংগঠনগুলো হচ্ছেঃ কংগ্রেস অফ অ্যাবোরিজিন্যাল পিউপলস (ডুয়াইট ডোরি) , ইনুইট টাপিরিট কানাটামি (নাটান ওবেড), মেতিস ন্যাশনাল কাউন্সিল (ক্লেমেন্ট কার্টিয়ার) এবং নেটিভ উইমেন্স এ্যাসোসিয়েশন অফ কানাডা (ডন লাভেল-হার্ভার্ড)। এ সভায় নিখোঁজ আদিবাসী নারীদের তদন্তে সম্পৃক্ত নেতৃস্থানীয় মন্ত্রীরা উপস্থিত ছিলেন: আইন মন্ত্রী জোডি উইলসন-রেবোল্ড, স্ট্যাটাস অফ উইমেন মন্ত্রী প্যাট্রিসিয়া হাজডু, ইন্ডিজিনাস এন্ড নর্দার্ণ অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রী ক্যারোলিন বেনেট। এ ছাড়াও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেইন ফিলপট, হেরিটেজ মন্ত্রী মেলানি জলি এবং এমপ্লয়মেন্ট মন্ত্রী ম্যারি এন মিথচুক ও সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভার পরপরই তারা অংশগ্রহণ করেন সংবাদ সম্মেলনে। প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো পোপকে জানাবেন কিনা ক্ষমা চাইবার ব্যাপারে, এ প্রশ্নের জবাবে ট্রুডো বলেন কমিশনের প্রস্তাবনার বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে নিশ্চিতভাবেই তিনি আবাসিক বিদ্যালয়গুলোতে রোমান ক্যাথলিক চার্চের ভূমিকার জন্য পোপ ফ্রান্সিসের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থণার বিষয়টি সরাসরি পোপকে জানাবেন। যদিও এর কোনো নিশ্চয়তা দেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয় কিংবা সম্ভব নয় পোপকে বাধ্য করানো, তবুও তিনি সরাসরি পোপের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করবেন এবং পোপকে ফলপ্রসূভাবেই সম্পৃক্ত করতে চেষ্টা করবেন বলে জানান। এর পাশাপাশি তিনি আদিবাসী এবং অন্য কানাডীয়দের মধ্যকার দীর্ঘদিনের বৈষম্য বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবার কথাও জানান। আর কমিশনের প্রস্তাবনার বাস্তবায়নে আদিবাসী সংগঠনের নেতা, প্রভিন্স এবং টেরিটোরির প্রধান, ‘ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুলস এগ্রিমেন্টে’র সাথে যুক্ত সব ব্যক্তি এবং সংগঠনের সাথে একসাথে কাজ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
অন্তর্বর্তীকালীন রক্ষণশীল দলের নেতা রোনা এমব্রোস বলেন, যদিও পোপের ক্ষমা প্রার্থণায় প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, এবং পোপ আদৌ আগ্রহী হবেন কিনা এ বিষয়গুলো রয়েছে, তারপর ও তাকে যুক্ত করানোর উদ্যোগ প্রশংসনীয় এবং ক্যাথলিক চার্চের মূখ্য নেতিবাচক ভূমিকা ও তো ঐতিহাসিক সত্য। উল্লেখ্য, প্রাক্তন রক্ষণশীল প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার গত বছরের জুনে ভ্যাটিকানে পোপ ফ্রান্সিসের সাথে সাক্ষাৎ করেন ট্রুথ এন্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের ৯৪ টি প্রস্তাবনা এবং ক্ষমা প্রার্থণার বিষয়গুলো নিয়ে। কিন্তু পরবর্তীতে হারপার ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন এ প্রক্রিয়ায় সরাসরি যুক্ত না হওয়া এবং যথাযথ ও কার্যকর ভূমিকা না পালন করার জন্য।
লিবারেল সরকারের ইতিমধ্যে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ চতুর্দিকে ভীষণভাবে প্রশংসিত হলেও এর কতগুলো দিক নানান সমালোচনার ও জন্ম দিয়েছে। যেমন: কোনো বিস্তারিত প্রভাব পর্যালোচনা করা হয়নি; পূর্ণাঙ্গ বাজেট প্রণয়ণ ছাড়াই একপাক্ষিকভাবে লিবারেলরা কমিশনের সব প্রস্তাবনা গ্রহণ করেছেন; ৯৪ টি প্রস্তাবনার সবগুলো বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি অতিমাত্রায় উচ্চাভিলাষী; আবার লিবারেলরা এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্প গ্রহণ করে দায়িত্বজ্ঞানহীণতার পরিচয় দিয়েছেন ইত্যাদি। আর এ সমালোচনাগুলো নানান সময়ে ঘুরেফিরে জানান দিয়েছেন রক্ষণশীল দলের ইন্ডিজিনাস ক্রিটিক ক্যাথি ম্যাকলিওড ও।
আদিবাসীদের দীর্ঘ বঞ্চনা এবং নিগ্রহের বিপরীতে রাষ্ট্রের সাম্প্রতিক সদিচ্ছা এবং গৃহীত ইতিবাচক পদক্ষেপসমূহের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সময়কালের নিগ্রহ, অন্যায়, বঞ্চনা ও বৈষম্যের অবসান ঘটবে এই আশাবাদই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পুরো কানাডা জুড়ে। আর এর জন্য বর্তমানের ক্ষমতাসীন লিবারেল সরকার নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ পাবার যোগ্য।
(কানাডায় আদিবাসীদের অর্থাৎ ফার্ষ্ট নেশন, মেতিস এবং ইনুইটদের বুঝাতে ইংরেজী অ্যাবোরিজিনাল এবং ইন্ডিজিনাস শব্দদুটি ব্যবহার হয়। তবে সরকারী এবং অফিসিয়াল কাগজপত্রে এখনো রয়ে গেছে ইন্ডিয়ান শব্দটি। এবং মাঝে মাঝে সব আদিবাসী গোষ্ঠীকে বুঝাতে শুধুমাত্র ফার্ষ্ট নেশন ও ব্যবহৃত হয়।)
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)