চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

‘এ সময় আমি কাকে দিয়ে যাব, মিশু?’

একাধারে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সাংবাদিক, চিত্রগ্রাহক এবং চলচ্চিত্র ভিডিও গ্রাহক আশফাক মুনীর চৌধুরী। মিশুক মুনীর নামেই যিনি বেশি পরিচিত। বাংলাদেশের টেলিভিশন সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ বলা হয় তাকে। ১৯৫৯ সালের এই দিনে নোয়াখালী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন বহু প্রতিভাধর প্রয়াত এ সাংবাদিক।

মিশুক মুনীরের জন্মদিনে তাকে স্মরণ করে ফেসবুকে লিখেছেন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের পরিচালক ড. সেলিম জাহান।

তিনি লিখেছেন,

“বেঁচে থাকলে আজ মিশুকের আটান্ন বছর হোত – ১৯৫৯ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর ওর জন্ম। ওকে প্রথম দেখেছিলাম আটচল্লিশ বছর আগে – ১৯৬৯ সালে যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তারপরের পর্বগুলোতো ইতিহাস। কিছুদিন আগে ওকে নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। ভাবলাম আজ ওর জন্মদিনে ঐ লেখাটাই আমার শুভেচ্ছা হয়ে থাকুক।

‘সাতচল্লিশ বছর আগের এক শীতের সকাল। বেড়ালের লোমের মতো নরম উষ্ণতা নিয়ে তেরছা রোদ এলায়ে পড়েছে কলা ভবনের তিনতলার বারান্দায়। জম্পেশ আড্ডা জমে উঠেছে অর্থনীতি বিভাগের সামনে দু’টো ক্লাশের মাঝখানে – একদিকে ছেলেদের জটলা অন্যদিকে মেয়েদের। হঠাৎ করে মেয়েদের জটলা থেকে বেরিয়ে একটা মেয়ে ডেকে উঠল, ‘ মি ই ই ই শু’।

তাকিয়ে দেখি, দোতালার বারান্দায় দাঁড়ানো ভারী মায়াময় চেহারার একটি কিশোর ঐ ডাকের লক্ষ্যবস্ত। দৃষ্টিকাড়া উজ্জ্বল চোখের কমনীয় অবয়বের কিশোরটি তিনতলার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। কিন্তু সব ছাপিয়ে আমার শুধু মনে হচ্ছিল এমন সুরেলা ঝংকৃত গলা আমি কোনদিন শুনিনি। সে গলা অবশ্য আমার জীবন, চেতনা আর হৃদয় ঝংকৃত করে রেখেছিল পরবর্তী চল্লিশ বছর।

ঐ প্রথম আমার মিশুককে দেখা। তারপর বৈবাহিক সম্পর্কের কারনে মিশুকদের বৃহত্তর পারিবারিক বৃত্তের সদস্য হয়েছি। সত্তুরের দশকে নানান সময়ে বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানে মিশুর (আমরা মিশুককে ঐ ছোট নামেই ডাকতাম) সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, কিন্তু ঘনিষ্ঠতা বলতে যা বোঝায়, তা মিশুর সাথে গড়ে ওঠে নি। তার একটিই কারন – মিশু আমাদের চেয়ে বেশ ছোট।

মিশুকে কাছে থেকে দেখার প্রথম সুযোগ পেলাম আশির দশকের একেবারে প্রথমে যখন আমরা মন্ট্রিয়ালে – আমি ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষায় রত। হ্যালিফ্যাক্সে ছোট ফুপুর ওখানে ক’দিন কাটিয়ে মিশু মন্ট্রিয়ালে এলো দু’দিনের জন্য বোনের ওখানে। মিশু তখন পুরো যাযাবর। স্নান সেরে চুল আঁচড়ায় না, জামা-কাপড় একটা হলেই হল, একটু বিভ্রান্ত – নিজেকেই খুঁজে ফিরছে যেন। তারের জিনিসপত্র দিয়ে আংটি দুল বানায়, বিক্রি করে।

মিশু বেনুর খুব প্রিয় ভাই – যত্ন করে রান্না করেছে সে। মিশু স্নান সেরে চুলে হাত বুলিয়ে চুলগুলোকে পেছনে ঠেলে খাবার ঘরে এসে বসল। চুল থেকে টপটপ করে জল গড়াচ্ছে। আমার মনে আছে, বেনু তোয়ালে এনে মিশুর মাথা মুছে দিয়েছিল একটি ছোট বাচ্চার মতো। ভারী ভালো লেগেছিল দেখতে।

মিশুর সঙ্গে আরেক সম্পর্ক গড়ে উঠল আশির দশকের প্রথমে যখন আমি দেশে ফিরে এলাম। মিশু তখন আমার সহকর্মী – জনসংযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বৃহত্তর পরিবারের প্রায় ১৬ জন আমরা শিক্ষকতা করি। মঙ্গল ও বৃহস্পতিবারে ও ২০২৪ এ আমার ক্লাশ থাকে – মঙ্গলবারে আমার পরেই ওখানে ক্লাশ নেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বৃহস্পতিবারে আশফাক মুনীর (মিশুকের পোশাকী নাম)।

মঙ্গলবার আমি সতর্ক থাকি। ঘন্টা বাজলেই ক্লাশ ছেড়ে দেই। স্যারকে যেন দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়। অনেক সময় স্যার এসে গেছে জানলে শিক্ষার্থীরাও আমাকে চোখ দিয়ে জানান দেয়। আমি মুখের বাক্য অসমাপ্ত রেখে বেরিয়ে আসি। একদিন স্যার আমাকে বললেন, ‘এতো তাড়াহুড়ো কর কেন? পড়ানোটা শেষ করেই বার হও’। ‘আপনি দাঁড়িয়ে থাকবেন!’ আমি নম্র স্বরে বলি। ‘তা’তে কি? আমি তোমার বক্তৃতা শুনি। কতকিছু শিখি অর্থনীতির’, হাসতে হাসতে বলে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী নির্ভুলভাবে ‘কেইনসের মূল্য তত্ব’ আউড়ে যান – তিনদিন আগে আমি যা বলেছি শিক্ষার্থীদের। আমি হতবাক।

বৃহস্পতিবারে দৃশ্যপট ভিন্নতর। পড়ানো শেষ করতে যতখানি সময় লাগে, তা আমি নেই – তাড়াহুড়ো করি না। মিশু ছাত্রদের নিয়ে এসে কক্ষের সামনে দাঁড়ায়। তারপর শুরু হয় তার খেলা। প্রথমে জানালার কাঁচের ফাঁক দিয়ে মুখ বানায়, তারপর ভেংচি কাটে। তাতেও যখন কাজ হয় না, তখন দমাদ্দম দরজায় ঘা মারে। আমি রেগে গিয়ে দরজা খুললে পরে একগাল হেসে বলে ‘কেমন আছেন? বেনু আপা কেমন আছে?’ আমি রাগ ভুলে হেসে ফেলি।

ইতিমধ্যে চিত্রগ্রাহক হিসেবে নাম ছড়িয়ে পড়েছে মিশুকের। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়েছে সে। আমি নব্বুইয়ে পাড়ি জমাই বিদেশে। তার কিছুদিন পরে খবর পাই মিশু, মঞ্জুলী আর সুহৃদ এসেছে টরেন্টোতে। মিশু টেলিভিশনের জন্য কাজ করে, ছবি বানায়। মাঝে মাঝে কথা হয়, তার কাজের অংশ পাঠায় আমাকে – মতামত জানতে চায় আমার। দীর্ঘ আলোচনা হয় আমাদের।

তারপর হঠাৎ করে গত দশকের শেষার্ধে একদিন এক মাঝ সকালে আমাদের নিউইয়র্কের বাড়ীর দরজায় হাজির মিশুক। কি হয়েছে? না। পাশের দালানে অগ্রজ ভাষনের বাড়ীতে এসেছে মিশুক। তাই ভেবেছে বেনুর সঙ্গে দেখা করে যাবে। বেনু বাড়ীতে ছিল না। দু কাপ চা হাতে নিয়ে দু’জনে বারান্দায় এসে বসলাম -আমাদের সেই মায়াবী বারান্দা।

সে বছর সম্ভবত সুহৃদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে – আমার পড়ার ও কাজের এলাকার সঙ্গে তার উৎসাহ এলাকা সম্পৃক্ত। মিশুক জানতে চায় আমার মতামত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে। অন্যান্য নানান বিষয়ে। বুঝতে পারি একমাত্র সন্তানের জন্য এক পিতার উৎকন্ঠা। আশ্বস্ত করি তাকে।

তারপর আলোচনার বাঁক ঘুরে যায় অন্যদিকে। অভ্রান্তভাবে উঠে আসে ১৯৭১। ওর কিশোর মনের ভাবনা সে তুলে ধরে আমার সামনে। বলে চলে সে সময়ে লিলি চাচীর মানসিক অবস্হা এবং কেমন করে একটি কিশোর তার শোকাহত মা’কে ধরে রেখেছিলো মমতায়, বোধে এবং সহযোগিতায়। আমার সবচেয়ে লাগছিল সম্পূর্ন আবেগবর্জিত কন্ঠে, পরিপূর্ন বস্তুনিষ্ঠভাবে, যেন ঐতিহাসিকের দৃষ্টিকোন থেকে মিশু বলে যাচ্ছিল ওর কথা।

মিশু বলছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়ে মৌখিক পরীক্ষার কথা। পরীক্ষকবৃন্দের একজন মিশুকে বাবার নাম জিজ্ঞেস করায় মিশু জবাব দিয়েছিল, ‘মুনীর চৌধুরী’। সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষক জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি শহীদ মুনীর চৌধুরী বললে না কেন’? মিশুর তাৎক্ষনিক প্রত্যুত্তর ছিল, ‘সে তো আপনারা বলবেন’।

কি কারনে জানি না, সে দিন মিশুর হৃদয়ের অর্গল খুলে গিয়েছিল। এক কাপ চা চার কাপ পৌঁছেছিল – এক ঘন্টার গল্প তিন ঘন্টা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। প্রায় চার ঘন্টা পরে মিশু যখন উঠে যায়, তখন বলেছিল, ‘দূর্ভাগ্য যে আব্বার সঙ্গে আপনার পরিচয় হওয়ার সুযোগ হল না, আপনাদের দু’জনেরই দু’জনকে খুব ভালো লাগত’। বেনুও বহুবার আমাকে এ কথাটি বলেছে। মিশুকে আমি যা বলিনি তা’হল, আমার ছ’বছর বয়সে শহীদ মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল আমার পিতার সুবাদে এবং আমি তাঁর কোলে চড়েছিলাম।

মিশুর সঙ্গে বেনুর আর আমার শেষ দেখা হয় ও চলে যাওয়ার মাস খানেক আগে। মেট্রো স্টেশনে দেখা – ও ভাষনের ওখানে আসছে, আমরা ম্যানহ্যাটেনের দিকে যাচ্ছি। ঝলমল করছে মিশুর মুখ, চকচকে আলো জ্বলছে ওর চোখে – বদলে দেবে ও আমাদের দেশের গণমাধ্যমের খোল নলচে। কত পরিকল্পনা ওর, কত স্বপ্ন, কত ভাবনা ওর মাথায় গিজগিজ করছে।

‘সব ঘুরিয়ে দেখাব আপনাকে’, উত্তেজিত ওর কণ্ঠস্বর। ‘সময় রাখবেন কিন্তু আমার জন্যে’, বলেছিল ও। সময় আমি তোমার জন্য রেখেছিলাম, মিশু, কিন্তু তুমিই তো সময় দিলে না। কোন এক অমোঘ সময়ের ডাকে তুমিই তো চলে গেলে অন্য এক দেশে। যতবার দেশে আসি, তোমার জন্য আমি মনে মনে সময় তুলে রাখি, কিন্তু এ সময় আমি কা’কে দিয়ে যাব, মিশু?’”

বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিশুক মুনির শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনির চৌধুরীর ছেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের পাঠ চুকিয়ে ওই বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন তিনি। মিশুক মুনীর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিবিসি’র হয়ে কাজ করেন। একুশে টেলিভিশন চালু হলে সংবাদ বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন।

২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জে এক সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ আরও তিন জন প্রাণ হারান।