এমন একটা দেশ যেখানে চাইলে রাতারাতি বদলে যায় মানুষের জীবন। আজ পিয়ন তো কাল অফিসার, আজ খুনের আসামী তো কাল জননেতা। ছেড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা কোন ব্যাপারই না। তবে একটা কথা আছে, এগুলোর জন্য দরকার ক্ষমতায় সঙ্গত করা।
আজ চলছেন পথে বাটা কোম্পানির নীল ফিতের ক্ষয়ে যাওয়া সাদা স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে। তপ্ত রোদ থেকে বাঁচতে হাতের পলিথিন ব্যাগে মোড়নো ফাইল দিয়ে মাথা ঢেকে। ক্ষমতাবানদের সাথে খাতির থাকলে কালই চড়তে পারেন নিজের বিএমডব্লিউতে। গাড়ি থেকে নামার আগেই শোফার আপনার দরজা খুলে দিয়ে দাঁড়াবে দামী জাপানি ছাতাটা মেলে ধরে। আজ আপনি এক হাজার টাকার জন্য কেঁদে বেড়াচ্ছেন, কাল হয়তো আপনি একলাখ টাকা টিপস দিবেন। আজ চাকরি শুরু করলেন পিয়ন হিসেবে। কাল হয়ে গেলেন ইন্সপেক্টর।
বিশ্বাস হচ্ছে না? না হবার কী আছে! পড়ে দেখুন ২৬ নভেম্বরের একটা সংবাদ: কর কমিশনারের পিয়ন মাহাবুব আলম মিলন (৪৭), যার দেশের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার, গফরগাঁও থানায়। মিলন, কর্মজীবন শুরু করে কর কমিশনারের কার্যালয়ে একজন পিয়ন হিসেবে। দুদক অনেক দুর্নীতির তদন্ত করলেও এখানে এসে হোঁচট খেয়ে গেছে, ক্ষমতার বাম্পারে।
শুধু কি তাই! চাইলে দুই/চারটা খুন করবেন, জেলে গেলে অসুবিধা নাই। ফাঁসির আগের দিন অস্বাভাবিক করবেন আচরণে, ফাঁসি বন্ধ তো হবেই সাথে পেয়ে যাবেন কয়েক মাসের নামমাত্র সাজা। এরপর মিলবে মুক্তি। কি অবিশ্বাস্য লাগছে? আরে না, কল্পকাহিনী না, পড়ে দেখুন, প্রথম আলোর ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭’র সংবাদ।
পড়ে দেখুন সংবাদটা: ‘‘ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার মানিকদহ ইউনিয়নের আসলাম ফকির ২০০৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর একই ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান এ কে এম সাহেদ আলী ওরফে সাহেব আলী মিয়াকে হত্যা করেন। দু’জনই ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়ে আসছিলেন পর্যায়ক্রমে। জেলা ও দায়রা জজ আদালত আসলাম ফকিরকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। পরে হাইকোর্ট এ রায় বহাল রাখেন।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের ১৯ মে খুনের দোষ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন আসলাম ফকির। কিন্তু ২০১৪ সালের ১৩ অক্টোবর তা নামঞ্জুর হয়। ওই বছরের ১৩ নভেম্বর তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দিন ধার্য হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকার জন্য চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু ১২ নভেম্বর বন্দী আসলাম ফকির এমন আচরণ শুরু করেন, কারাগারের নথির ভাষায় যেটা ছিল ‘অস্বাভাবিক’ বা ‘অসুস্থতা’। এর ফলে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর স্থগিত করা হয় এবং ওই দিনই দ্বিতীয় দফায় রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করা হয়।
দ্বিতীয় দফায় প্রাণভিক্ষার আবেদন গৃহীত হলে আসলামের দণ্ড হ্রাস করা হয় ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। তাকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিশেষ দিবসে বন্দীদের সাধারণ ক্ষমা লাভের সুযোগ নিয়ে গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে তাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনানুষ্ঠানিক চিঠি (ডিও লেটার) দেন সাংসদ নিলুফার জাফরউল্যাহ। গত ২৫ আগস্ট গাজীপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে মুক্তি পান আসলাম। তিন দিন পর ২৮ আগস্ট তিনি ফিরে আসেন মানিকদহ গ্রামে। এরপর থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নিয়ে। গত বৃহস্পতিবার রাতেও টেলিফোনে কথা হয় আসলামের সঙ্গে। শারীরিক ও মানসিক অবস্থা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, তিনি পুরোপুরি সুস্থ আছেন। অনেকগুলো হাসপাতালে চেকআপ করিয়েছেন, কোনো সমস্যা নেই। এখন ব্যস্ত গণসংযোগ নিয়ে।”
খুন, লুট, ধর্ষণ বা দুর্নীতি মামলার আসামী, সাজা কাটছে জেলে তো কি হয়েছে! চাইলেই পাবে বাড়িতে আরাম আয়েশে কয়েক ঘণ্টা থেকে সারাদিন সময় কাটানোর সুবিধা, কোর্টে হাজিরার আসা যাওয়ার পথে মিলবে নিজ আবাসে সময় কাটানোর মধুর সময়। জেলে ২/১০ বছর আটকা থাকলেও আটকে থাকবে না বাবা হবার পথ। কি! আবারো অবিশ্বাস! তাহলে পড়ে ফেলুন ঝটপট নিচের খবরটি:
“যুবদল নেতা মিজানুর রহমান মিজান হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজা ভোগ করছেন কাইল্যা পলাশ। ২০০২ সালের ২৯ মে রামপুরায় যুবদল নেতা মিজানকে গুলি করে হত্যার মামলায় বিচারিক আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। উচ্চ আদালত তার সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। কাশিমপুর, মুন্সীগঞ্জ, রাজশাহী, দিনাজপুর কারাগার ঘুরে পলাশ এখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। পলাশের স্ত্রী মাহমুদা খানম বলেছেন, খুনের মামলায় ২০০৩ সালে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে জেলে আছেন তার স্বামী। ২০১২ সালের অক্টোবরে মুন্সীগঞ্জ হাসপাতালে জন্ম হয় তাদের মেয়ে খাদিজার। তিনি স্বীকার করেন, কারাগার থেকে আদালতে হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে রামপুরার বাসায় দেখা করে যেতেন পলাশ। আগে মাসে দু-তিনটি হাজিরা থাকত, তখন বেশি আসতেন, এখন কম। কখনো কয়েক ঘণ্টা, কখনো সারা দিন পরিবারের সঙ্গে থাকেন।
বাড়ির বাইরে পাহারায় থাকতেন কারারক্ষীরা। কারা অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, পলাশ গত দুই বছরে মামলার হাজিরা দিতে ৫৩ বার ঢাকায় এসেছেন। কাশিমপুর থেকে ঢাকার বিভিন্ন আদালতে হাজিরা দেওয়ার সময় পুলিশি পাহারায় প্রিজন ভ্যানে যাতায়াত করেছেন তিনি। স্ত্রী মাহমুদা বলেছেন, পুলিশের সহযোগিতায় তার স্বামী রামপুরার বাসায় আসা-যাওয়া করতেন মাইক্রোবাসে। সূত্র জানায়, পুলিশ হত্যাসহ দুই ডজন মামলার আসামি তেজগাঁওয়ের সেলিম ওরফে রায়পুইরা সেইল্যা গ্রেফতার হন ২০০২ সালে। জামিনে ছাড়া পান ২০০৬ সালে। কিন্তু সেলিম কন্যাসন্তানের জনক হন ২০০৪ সালে। সন্তানের পিতা হওয়ায় তিনি কারাগারে মিষ্টিও খাইয়েছিলেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডনরা কারাগারে বন্দী থাকলেও কাটান মুক্তজীবনের মতোই। চাঁদাবাজির সিংহভাগই তারা খরচ করেন কারাগারের ভিতরে। রাজার হালেই কাটে তাদের দিনকাল। জানা গেছে, ভারতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত, দুর্ধর্ষ মামলার সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিরা কারাগারে তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতে পারেন। এমনকি তারা চাইলে সন্তান নিতেও পারবেন। যদিও এ সুযোগটি কয়েদিরা পাচ্ছেন এক বছর ধরে। কিন্তু বাংলাদেশে কয়েদিদের তাদের স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
এ সুযোগ তারা নিচ্ছেন অবৈধভাবে। লেনদেনের মাধ্যমে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বন্দী থাকা অবস্থায় কাইল্যা পলাশ আর রায়পুইরা সেইল্যা ছাড়াও বাবা হয়েছেন আমিনবাজারের মামুন, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মহাখালীর এক তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী।
কারাসূত্র জানায়, জেলখানার জীবন মানেই এক ভিন্ন জীবন। সেখানে শাস্তি হিসেবে অন্ধকার-অভিশপ্ত জীবন যাপন করতে হয়। কিন্তু আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডনদের ক্ষেত্রে এটি কার্যকর নয়। যখন তাদের যা ইচ্ছা হচ্ছে, তাই তারা পূরণ করছেন। ভিতরে বসে মোবাইল ফোনে কথা বলছেন। ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। ব্যবসায়ীদের হুমকি দিচ্ছেন, চাঁদাবাজি করছেন। চাঁদার টাকা সময়মতো তাদের কাছে কারাগারেই পৌঁছে যাচ্ছে। কারা কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই তারা বছরের পর বছর এই বিলাসী জীবন যাপন করছেন।”
সো ক্ষমতা থাকলে কী না হয়! আরও এমন হাজারো ঘটনার দেশ, আমার সোনার বাংলাদেশ। এমন ঘটনার বলতে শুরু করলে শেষ হবার নয়, আরব্য রজনীকেও হার মানাতে পারবে। সত্যি এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের সেরা (রানী) সে যে আমার জন্মভূমি।