নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া আন্দোলন করেছেন নারীর শিক্ষা অর্জনে, ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায়। সমাজ বিশ্লেষক ও নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন, দেড়শ বছর পরে এসে বেগম রোকেয়া এখনো প্রাসঙ্গিক কারণ তিনি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তিনি নারী-পুরুষের সমতার কথা বলেছেন, কিন্তু সেই সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বেগম রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্ন আরো অনেক দূরের ব্যাপার, সেই জায়গাগুলো নির্মাণ হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: নারী অধিকার নিয়ে বেগম রোকেয়া যেসব কথা বলেছেন এখনও তার গুরুত্ব আছে। এখনো আমরা নারীর শিক্ষা নিয়ে কথা বলছি। ধর্মীয় কুসংস্কারের বিষয়ে কথা বলছি। যে বিষয়গুলো নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে সেগুলো নিয়েও আমাদের কথা বলতে হচ্ছে।
‘এখনও ঘরে-বাইরে নারী নির্যাতন চলছে। নারী এখনো গৃহবন্দী। ভাই-বোন এখনো সমান হয়নি। এ কারণে বেগম রোকেয়া প্রাসঙ্গিক। নারীকে এখনো অনেক দূর এগিয়ে নিতে হবে। আরো অনেক বছর রোকেয়া আমাদের উৎসাহ উদ্দীপনার উৎস হয়ে থাকবেন। তার চেতনা টিকে থাকা দরকার কারণ নারী অধিকার এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।’
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ওমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ’ বিভাগের শিক্ষক হুমায়ূন কবীর চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: বেগম রোকেয়া আন্দোলন করেছেন নারীর শিক্ষা অর্জন, ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায়। পরে আরো কিছু বিষয়ে তিনি বলেছেন যেগুলো আলোচনায় আসেনি। তার অপ্রকাশিত লেখা থেকে জানা যায়, তিনি পুরুষের অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন, বাঙালি জাতির জাতীয়তাবাদ নিয়েও কথা বলেছেন।
তিনি সমাজবিরোধী কথা বলছেন। সমাজ আসলে সেসময় যেভাবে চলছিলো তার বিরুদ্ধে কথা বলছেন। উনাকে উদারনৈতিক নারীবাদী হিসেবে দেখা যায় আবার র্যাডিক্যাল হিসেবেও দেখা যায়।
‘নিরীহ বাঙালী’ বইতে ‘বাঙালিদের ভিতরে অলসতা ছিলো, কাপুরুষতা ছিলো। যার কারণে বাঙালি জাতি মুক্তি পাচ্ছে না,’ বলেছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন: সে কারণে তিনি বলেছিলেন, বাঙালি জাতিকে কর্মঠ হতে হবে, সাহসী হতে হবে, অধিকার আদায় করে নিতে হবে, কথা বলতে হবে।
‘আরেকটা বিষয় হচ্ছে, যদি তাকে নারীবাদী হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাহলে দেখা যায়, ওনার লেখা অবরোধবাসিনী, স্ত্রীরপত্র-তে তিনি সেই সময়েই উদারনৈতিক নারীবাদী। আবার যদি সুলতানার স্বপ্নকে আমরা দেখি তাহলে আমূল নারীবাদী। তিনি সমাজবিরোধী কথা বলছেন। সমাজ আসলে সেসময় যেভাবে চলছিলো তার বিরুদ্ধে কথা বলছেন। উনাকে উদারনৈতিক নারীবাদী হিসেবে দেখা যায় আবার র্যাডিক্যাল হিসেবেও দেখা যায়,’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় এখনকার এজেন্ডা
রোবায়েত ফেরদৌস মনে করেন, মেয়েদের আবার যে বন্দী করা হচ্ছে এই বিষয়টিই রোকেয়ার প্রধান এজেন্ডা হতো। হেফাজতে ইসলাম যে ১৩ দফা দিয়েছে তার বিরুদ্ধে তিনি মাঠে নামতেন। দেড়শ বছর আগে তিনি সম্পদের সমান অধিকারের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেটা প্রতিষ্ঠায় তিনি আরো সোচ্চার হতেন। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তিনি কথা বলতেন। যারা নারীকে আরো পিছিয়ে রাখতে চায় তাদের বিরুদ্ধে মাঠে নামতেন। মানববন্ধন, মিছিল করতেন, সেমিনার করতেন, গোলটেবিল বৈঠক করতেন, টক শোতে আসতেন এবং কথা বলতেন।
‘রোকেয়া নারী নির্যাতন নিয়ে কথা বলতেন। বাল্য বিবাহ নিয়ে কথা বলতেন। সরকার বাল্যবিবাহ নিয়ে যে বিশেষ বিধান করছে রোকেয়া এর বিরুদ্ধেও কথা বলতেন। রোকেয়া এর বিরুদ্ধে জাতীয় সম্মেলন করতেন,’ বলে নিশ্চিত গণযোগাযোগের এ শিক্ষক।
মেয়েদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক সময় মেয়েরা অনুধাবন করে না যে তারা নির্যাতিত হচ্ছে। নির্যাতনের চরম ধরণের মাত্রা আছে। কেবল মারলেই নির্যাতন হয় না। অধিকারটাই যদি চর্চা করা না যায় সেটাও একটা নির্যাতন।
বেগম রোকেয়া বেঁচে থাকলে তার এখনকার এজেন্ডা নিয়ে উন্নয়নকর্মী শাহানা হুদা বলেন: তিনি আজ থাকলে নারীদের ‘অসচেতনতা’ নিয়ে কাজ করতেন। তিনি বলেন, এখনো শিক্ষিত নারীকে উপার্জন করতে দেয়া হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, তোমার সব চাহিদা পূরণ করা হবে। তার মতে, এটাও নির্যাতন। মেয়েদের এটা বুঝতে হবে। নিজেদের অধিকার আদায়ে মেয়েদেরকেই ঘুরে দাঁড়াতে হবে।
‘বেগম রোকেয়া নিজে বুঝতে পেরেছিলেন তার অধিকার কী। তারপর তিনি আন্দোলন করেছেন। তিনি বুঝেছিলেন, শিক্ষা তার অধিকার তারপর তিনি নারী শিক্ষা নিয়ে কাজ করেছেন। এ সময়ে আমাদের ওই একই জিনিস বুঝতে হবে। আমার অধিকার কী সেটা আমাকে অনুধাবন করতে হবে।’
শাহানা হুদা বলেন: মেয়েদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক সময় মেয়েরা অনুধাবন করে না যে তারা নির্যাতিত হচ্ছে। নির্যাতনের চরম ধরণের মাত্রা আছে। কেবল মারলেই নির্যাতন হয় না। অধিকারটাই যদি চর্চা করা না যায় সেটাও একটা নির্যাতন।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘বেগম রোকেয়া সমাজ প্রথা নিয়ে কথা বলতেন। তিনি নারীশিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। বিশেষ করে বাল্যবিবাহ, ধর্ষণ নিয়ে কথা বলতেন। বেগম রোকেয়ার জন্মভূমি রংপুর অঞ্চলে বাল্যবিবাহ অন্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি। পায়রাবন্দকে বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা করা হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন।’
এখন খুব আলোচিত বিষয় হচ্ছে উত্তরাধুনিক নারীবাদ। নারীবাদ প্রতিষ্ঠা করতে ভাষার পরিবর্তন করতে হবে। পুরুষের ভাষায় নয় নিজের ভাষায় কথা বলতে হবে। রোকেয়া ১৯০৫ সালের দিকে এসব কথা বলে গেছেন। রোকেয়া বলেছেন, স্বামীকে আসলে অর্ধাঙ্গ বলতে হবে। ভদ্রমহিলাকে ভদ্রমহিলা না বলে ভদ্রলোকই বলতে হবে। তিনি সেগুলো চর্চাও করতেন।
হুমায়ূন কবীর বলেছেন, এখন খুব আলোচিত বিষয় হচ্ছে উত্তরাধুনিক নারীবাদ। নারীবাদ প্রতিষ্ঠা করতে ভাষার পরিবর্তন করতে হবে। পুরুষের ভাষায় নয় নিজের ভাষায় কথা বলতে হবে। রোকেয়া ১৯০৫ সালের দিকে এসব কথা বলে গেছেন। রোকেয়া বলেছেন, স্বামীকে আসলে অর্ধাঙ্গ বলতে হবে। ভদ্রমহিলাকে ভদ্রমহিলা না বলে ভদ্রলোকই বলতে হবে। তিনি সেগুলো চর্চাও করতেন।
‘তিনি বিশ্বমানবতা নিয়েও কথা বলতেন।’
যে কারণে নারীরা অগ্রসর হচ্ছে না
রোবায়েত ফেরদৌস মনে করেন, সমাজের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে সঠিক এজেন্ডাগুলো নিয়ে কাজ হচ্ছে না। ধর্ম এবং ধর্মীয় উন্মাদনা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ধর্মীয় মৌলবাদের প্রধান শিকার নারী।
তিনি বলেন: এতগুলো বছর পরে আমাদের হেফাজতের ১৩ দফা শুনতে হয়। যে ১৩ দফার একটিতে বলা হচ্ছে, নারীকে কেবল নারী ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে। এটা কিন্তু স্ববিরোধিতা। রোকেয়া এই স্ববিরোধিতাগুলো দেখিয়ে দিতেন। রোকেয়া ধর্মগ্রন্থ নিয়েও কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, ধর্মগ্রন্থগুলো পুরুষের তৈরি। এত বছর পরও রোকেয়া দেখতেন যে ধর্মকেই ব্যবহার করা হচ্ছে নারীদের পিছিয়ে রাখার জন্য। দ্রুত বিয়ে দিয়ে দাও। পর্দার মধ্যে নারীকে ফেলে দেয়া হচ্ছে। রোকেয়া এটা পছন্দ করতেন না। তখনকার সময়ে হয়তো সেটা ঠিক ছিলো কিন্তু এখন যেভাবে পোশাকের রাজনীতি করা হচ্ছে এবং পোশাকের রাজনীতির মূল শিকারও নারী। সেহেতু এটা নিয়ে মাঠে নামতেন রোকেয়া। একুশ শতকে এসে নারীর কেবল চোখ দেখা যাচ্ছে, এটা রোকেয়া মানতেন না।”
এসব বাধা না থাকলে নারীর উন্নয়ন আরো দ্রুত ঘটতে পারতো বলে মনে করেন রোবায়েত ফেরদৌস।
একইরকম কথা উল্লেখ করে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সমন্বয়কারী শাহানা হুদা বলেন: বেগম রোকেয়ার সময়ের তুলনায় নারীরা অনেকদূর এগিয়ে গেলেও তারা যেন আরো অগ্রসর হতে পারে, সেজন্য এখন আমাদের বেগম রোকেয়ার মতো আরেকটা শক্তি দরকার। তার মতো শক্তি এখন আমরা পাচ্ছি না যার আহ্বানে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াবো।
নারী আন্দোলনকারীদের বিভক্তির কারণে নারীরা ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামছে না বলে মনে করেন তিনি। নিজের প্রতিষ্ঠানের হয়ে নারী নেত্রীদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, নানা কারণে নারী নেত্রীরা বিভক্ত। একজনের কাজকে আরেকজন শ্রদ্ধা করেন না, মূল্যায়ন করেন না। তাদের মধ্যে বিভক্তি এমনই যে তারা একটা ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতেও এগিয়ে আসেন না।
তারপরও আশাবাদী শাহানা হুদা। ‘আলাদা আলাদাভাবে অনেকেই কাজ করে যাচ্ছেন। সেগুলো একসময় এক জায়গায় হবে। আমরা অনেক দূর এগিয়েছি, আরো অনেক দূর যাবো।
শামসুন্নাহার শতাব্দীর মতো একটা দুটো সাহসিকতার উদাহরণও আছে। সে মন্ত্রীর কাছ থেকে বাস সার্ভিস আদায় করলো। যারা বেরিয়ে আসছে, সাহসিকতা দেখাচ্ছে। বাল্য বিবাহ নিয়েও কাজ করছে অনেক সাধারণ মেয়ে।’
তিনি মনে করেন, বেগম রোকেয়ার সময়ে কোনো আলো ছিল না। অন্ধকারে থেকে প্রথম আলোটা তিনি জ্বালিয়েছিলেন। এখন অনেক মোমবাতি জলছে। এখন এই মোমবাতিগুলো যেন জ্বলতেই থাকে এবং আমরা যেন আরো অনেক মোমবাতি জ্বালাতে পারি।