নারী-পুরুষের চিরন্তন সর্ম্পক ও সংসার জীবনের নানা বিষয়ের উপমা হিসেবে একজন উবার চালকের উদাহরণ টেনে ফেসবুকে একটি পোষ্ট দিয়েছেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ প্রশান্ত রায়।
তিনি ফেসবুকে লিখেছেন,
“ক’দিন আগে এক উবার চালকের ঘটনা বলছিলাম। যেখানে তার স্ত্রী রোজ তাকে রাত তিনটায় উঠে রান্না করে ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাথে দিয়ে দেয় যেন সময়মত খেয়ে নেয়। ফোন করে খবরাখবর নেয়, কোথায় আছে, এবং খেয়েছে কি-না।
এই ঘটনায় কেউ কেউ নারীবাদী ও পুরুষতান্ত্রিকতার কথা তুলেছেন। পুরুষতান্ত্রিক পুরুষরা তো এমনটা চায়। ইত্যাদি ইত্যাদি।
এখন আসি আরেকজন চালকের কথায়। গত মাসে মালয়শিয়া গিয়েছিলাম। সেখানে ট্যুরে যে গাড়ীতে দুদিন ঘুরেছি, গাড়ীর চালকের নাম মি. সাথিয়া।
সাথিয়ার আদি নিবাস ভারতের তামিল নাড়ু। প্রায় ১০০ বছর পূর্বে তার দাদামহ পরিবার সহ মালয়শিয়া সেটেল হয় তখনকার বৃটিশ আমলে। যখন বৃটিশ সরকার মালয়শিয়ার রেলপথ/সড়কপথ উন্নয়নের কাজ শুরু করে। তার দাদা মূলত শ্রমিক হিসেবেই এখানে আসেন।
সাথিয়াকে দেখলেই মনে হয় সে তার পেশায় যথেস্ঠ পরিশ্রমী, সৎ ও ডেডিকেটেড। তার প্রমান, হোটেলে বসে রাত ১২ টার সময় তাকে মেসেজ দিয়েছিলাম, আগামীকাল সকাল কখন আসবে। সে সাথে সাথেই প্রতিউত্তর দিয়েছে।
সাধারনত আমাদের বাংলাদেশীদের ধারনা যে গাড়ী চালায় সে শুধুই ড্রাইভার। তার অন্য কোন পরিচয় নেই।
মালয়শিয়া থেকে ঢাকা আসার দিন হোটেল থেকে পিক করার সময় অনেক গল্পের এক পর্যায় জানতে পারলাম, মি. সাথিয়া শুধু ড্রাইভার না, সে একটি ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেল ও ট্যুরিজমের এমডি ও সিইও। এবং এই গাড়ীটাসহ আরো তার নিজের ২০টা গাড়ী আছে।
এগুলো শুনে বাংলাদেশীদের ভিমরী খাওয়ার মত অবস্থা হয়। আমারও হয়েছিল। কারন এদেশে এমন কোন বিত্তশালী বা কোন কম্পানির এমডি নিজে ট্যুরিস্টদের নিয়ে ড্রাইভিং করবে, এটা ভাবা যায় না। কারন এদেশে কেউ কিছু টাকা খরচ করে একটা কম্পানী খুলে এমডি হতে পারলে টেবিলের উপর পা তুলে এসির বাতাস খাওয়া শুরু করে।
তাহলে কিসের স্বার্থে মি. সাথিয়া নিজেই ড্রাইভিং করে? কারন, গুডউইল ও ব্যাবসার প্রসার। কিরকম? এই যে নিত্য নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হয়। ভালো ব্যাবহার করে। দায়িত্বে সচেতন। ২৪ আওয়ার্স সার্ভিস। এই করে করেই সে তার ব্যাবসার প্রসার ঘটিয়েছে।
গুডউইল এমন এক জিনিস যা একজন মানুষের মাধ্যমে ১০ জন, দশ জনের মাধ্যমে ১০০ জন। এভাবে হাজারো হাজারো। এই সমীকরনের মাধ্যমেই এখন তার ২০ টি গাড়ী। তাই এই সহজ সমীকরনটা মি. সাথিয়া কোনভাবেই মিসইউজ করতে চায় না।
গল্পের এক পর্যায়ে সাথিয়ার পরিবারের কথা জানতে চাইলাম। এক ছেলে ও এক মেয়ে। এক সময়ে হতাশকন্ঠে বললেন, এখন বিকেল পাঁচটা, অথচ কি খেয়েছে, কেমন আছে, বউ এখনো কোন খবর নেয় নি।
বেচারা যে খুব কস্টে আছে, বুঝা গেল। সে শুধু একটা ফোনকলের আশা করেছিল। প্রিয়জন একটু খোঁজ নিবে, এটুকু তো আশা করতেই পারে। এই আশা করাটাও কি নারীত্বকে ছোট করা হয় বা পুরুষত্বকে জাহির করা হয়? কিন্তু এগুলোকে সে পাত্তা দেয় না। এগুলোকে পাত্তা দিলে তো আর দিন চলবে না। এন্ড অব দ্যা মান্থ সংসার সচ্ছলভাবে চলানোর জন্য টাকা দরকার।
একজন আরেকজনের প্রতি সহানুভূতি, শ্রদ্ধাবোধ দেখানোটাই সম্পর্ক। যারা একে অপরের প্রতি যতটা সহানুভূতিশীল, সহমর্মী তাদের সম্পর্কের ভিতটাও ঠিক ততটাই মজবুত।
একজন নারী তার সহযোগীর (স্বামী শব্দটায় আমার আপত্তি আছে। স্বামী অর্থ প্রভু। সহযোগী যদি প্রভু হয়, তাহলে আর সহমর্মীতা থাকে না) জন্য সহানুভূতি হয়ে ঘুম ভেঙে রান্না করে, ফোন করে খোঁজ খবর নেয়, তাহলে বোধ করি নারীত্বে টান পরে না বা স্মার্টনেসেও ঘাটতি ঘটে না। ঠিক তার সহযোগী পুরুষ মানুষটির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পুরুষ মানুষটি যদি তার সহযোগিনীর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়, শ্রদ্ধাবোধ দেখায় তাহলে তারও পুরুষত্বের স্মার্টনেসে টান পড়ে না।
একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা ছাড়া দুজন নারী-পুরুষ একসাথে বাস করা সম্ভব না। যদি বাস করে, সেটা মূলত ভোগের জন্য, তাদের সম্পর্কটাও মূলত ভোগের।
নারীবাদী-পুরুষতন্ত্র এগুলো মূলত ভোগবাদী তত্ব। প্রয়োজন মানবতাবাদী হওয়া, যা একে অপরের প্রতি সহযোগীতা, সহমর্মিতা ও শ্রদ্ধাবোধ বাড়াবে। সেটা ঘরে হোক আর বাইরের কর্মস্থলেই হোক।”