চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘একুশে ফেব্রুয়ারি কেন পালন করা হয় জানে না তারা’!

বছর ঘুরে আবারও ফিরেছে  মহান একুশে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাংলাদেশের মতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের প্রতি পরম শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য দিবসটি পালিত হয়।
মহান ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারগুলো লোকারণ্যে হয়ে উঠে। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ দিবসটি উদযাপন করেন। একুশের প্রথম প্রহর থেকে শুরু করে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ চলে বিকাল পর্যন্ত।
একুশের এই উদযাপনে লাখো মানুষের ভিড়ে কিছু ভ্রাম্যমান হকারদের দেখা মিলে। যেকোন উৎসবে তারা উৎসবের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করেন। ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ, পহেলা বৈশাখ, পয়লা বসন্ত , বিশ্ব ভালোবাসা দিবসসহ নানা উৎসবে তাদের সরব পদচারণা চোখে পড়ে। কেউ ব্যাজ, স্টিকার্ড, হাতের বেসলেট বিক্রি করেন, কেউ বা হাইয়াই মিঠাই, গ্যাস বেলুন সহ আরও ভিন্ন রকমের জিনিস ফেরী করে বেড়ান।
একুশ উদযাপনের মানুষের ভীড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে ফেরি করা এমন কয়েকজন ভ্রাম্যমান হকারদের কাছ থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে তাদের অনুভূতি ও ধারণা জানতে মুখোমুখি হয়েছিল চ্যানেল আই অনলাইন।
ভ্রাম্যমান হকারদেরই একজন সজিব। গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী জেলায়। থাকেন ঢাকায়। গার্মেন্টেসে চাকরি করেন। ছুটির দিনগুলোতে নানা জিনিস ফেরি করেন। বিশেষ করে বিভিন্ন দিবসগুলোতে এই ব্যবসা বেশি করেন বলে জানান সজিব। এরকম বেশি লোকজন থাকলে দিনে ১৫ শ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয় সজিবের।
আজকের দিনটি কেন বিখ্যাত জানতে তিনি সরাসরি জানা নেই বলে উত্তর দিলেন! দ্বিতীয়বার প্রশ্নে বললেন, ’এই যে যুদ্ধ-মুদ্ধ কি যেন হইছিল নাকি। দেশ নাকি স্বাধীন হয়েছিল। ঠিক কইতে পারছিনো ভাই। এই জন্যি তো বলতে চাচ্ছি না। মনে নেই। আমি অশিক্ষিত মানুষ, এত কিছু কইতে পারবে না। ব্যবসা বাণিজ্য করি। খাই। এরচেয় বেশি কিছু জানিনে ভাই”-সজিবের সহজ-সরল কথ!
আজকের মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে কিছুই কি জানা নেই, এমন প্রশ্বে সজিব বলেন, “হ, মাতৃভাষা দিবস! তাই তো। টিভি দেখলে বুঝতে পারি আর কি! এই ডিস্টার্ব কইরেন না ভাই। মাল বিক্রি কইরতে হবে”- বলে সজিব দ্রুত প্রস্থান করলেন।
পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন ’মাহমুদুল হাসান, ২৪ বছরের তরুণ। তার মাথা ও হাতে ‘অমর একুশে’ লেখা ফিতা বাঁধা। ’একুশে ফেব্রুয়ারি, অ, আ, ক, খ’, মাতৃভাষা আন্দোলন’ প্রভৃতি লেখা ব্যাজ, ফিতা, বেসলেট ফেরী করছেন। এই যে আপনার মাথায় বাঁধা ফিতায় লেখা ’অমর অমর একুশে’ এ সম্পর্কে কি কিছু জানেন প্রশ্নে অসহায় উত্তর- ‘নাহ”! কেউ বলেনি, কারো কাছে শুনেনি কখনো? তাহলে আপনি কিছু না জেনে যে বিক্রি করছেন এমন প্রশ্নে মাহমুদুল হাসান চ্যানেল অনলাইনকে বলছিলেন, ‘এগুলা তো বুঝব তারা, যারা মনে করেন যে শিক্ষিত, পড়ালেহা করেছে।”
তাহলে এই যে এতো এতো মানুষ আসছে। বইমেলা হচ্ছে এর কারণ কিছুই জানা নেই আপনার, এমন প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে উঠলেন মাহমুদুল হাসান- “জানি নাহ। জানার কোন প্রয়োজন নাই। আমি এই যে বিজনেস করি।ব্যাজ বেছতেছি। টাকা পাইতাছি। সংসার চালাইতাছি! আমার জানার কোন প্রয়োজন নাই। এগুলো জাইনা আমার কোন লাভ নাই। যেই কাজ করলে আমার দুই টাকা আসবে, আমি সেই কাজই করি, সেটা আমি জানলে হয়’!
’যে আপনি বললেন ’যে কাজ করলে আমার দুই টাকা আসবে’ তা যদি বাংলায় না বলে উর্দুতে বলতে হতো তখন কি করতেন এমন মাহমুদেলর অদ্ভূত যুক্তি “ইংরাজিতে যারা কথা বলে তাদের কাছে ইংলিশটা পানির মতো সহজ। যারা বাংলায় কথা বলে তাদের কাছে বাংলা পানির মতো সহজ। আমরা যদি তখন উর্দুতে কথা বলা শুরু করতাম। তাহলে কি হইতো আমাদের? উর্দু ভাষাটাও সহজ হইয়া যাইত। মানুষ যেই কাজটা করে সেটা তার জন্য সহজ।বাংলায় বা উর্দু কোনটি জানি না। যে কাজটি সহজ, আমি সেই কাজটাই করি। যে ভাষা সবাই বুঝতে পারে সেটা আমি বলবো।
আপনি কোন ভাষা সহজে বুঝতে পারেন জানতে চাইলে চ্যানেল অনলাইনকে মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘বাংলা বুঝতে পারি। আমার ফ্যামিলিতে সবাই বাংলায় বলে। শিক্ষাও দিছে বাংলায়। সেই জন্য বাংলায়ই বুঝতে পারি।
টিএসসি চত্বরে হাওয়াই মিঠাই বিক্রেতা মো. খোকনও দিলেন অদ্ভূত উত্তর।” আজকে একুশে ফেব্রুয়ারি। এই দিনে মাতৃভাষার জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছিল”। মুক্তিযোদ্ধারা নয়, ভাষা শহিদরা বলে সংশোধন করে দিতেই ভিষণ লজ্জিত হলেন খোকন!”
এই যে সজিব, মাহমুদুল হাসান কিংবা খোকনদের মতো তরুণদের এমন করুণ অবস্থা কেন, তারা এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ তিন সম্পর্কে কিছু না জানার জন্য দায়ী আসলে কে বা কারা জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেজবাহ কামালের কণ্ঠে দু:সহ সূর।
তিনি বলেন, আমাদের অনেক শিক্ষিত তরুণ-তরুণী একুশে ফেব্রুয়ারি আর বিজয় দিবস গুলিয়ে ফেলে এখন। সেই জায়গায় এদের তো কোন অপরাধ আছে বলবো না আমি! বড় কষ্ট হয় এসব দেখে”!
“আমাদের সমাজ শ্রেণি বিভক্ত। এই সমাজে সবকিছু অপরিকল্পিতভাবে চলছে। আমাদের সবকিছু এখন একটি জায়গায় আবদ্ধ। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে লাখো মানুষ আসেন। নানা সংগঠন দেখি। কিন্তু কখনো দেখিনি একটি কৃষক সংগঠন, শ্রমিক সংগঠনকে। আমরা চাইলে গার্মেন্ট কর্মীদের শহীদ মিনারে নিয়ে আসতে পারি। তাদেরকে পরিচিত করাতে পারি। কখনো কি দেখেছেন, রিক্সা চালকদের কোন সংগঠনকে শহীদ মিনারে আসতে। আসলে এটি তাদের দোষ না। আমরা তাদের সচেতন করতে ব্যর্থ হচ্ছি। শিক্ষিতদের এটির দায়িত্ব নিতে হবে। দিবসটির সম্পর্কে বেশি বেশি প্রচারণা প্রয়োজন। বিভিন্ন স্কুল-কলেজে আজকের দিনটি নিয়ে আলোচনা সভা হতে পারতো। কিন্তু আমরা তা দেখছি না বললেই চলে।”
তিনি বলেন, মাতৃভাষা আন্দোলনের সময় শিক্ষিত শ্রেণি থেকে শুরু করে একেবারে গ্রামের সহজ-সরল মানুষও যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ সব শ্রেণির মানুষের কাছে মহান একুশের সত্যিকার বার্তা যাচ্ছে না। মাতৃভাষার সত্যিকার মর্যাদা তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে যখন সব শ্রেণির মানুষ এই দিবসটি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখবে এবং সচেতন হবে। নয়তো এর দায়-ভার আমাদের সবাইকে বহন করতে হবে-বলছিলেন অধ্যাপক মেজবাহ কামাল।