ঋতুর আবর্তনে প্রকৃতিতে এখন শীতকাল। শীত এই দেশে দুটি জিনিস নিয়ে আসে। একটি অতিথি পাখি, অন্যটি নানা রকমের মেলা। প্রকৃতির উপর বিরূপ আচরণের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে অতিথি পাখির আগমন কিছুটা কমে এলেও থেমে নেই মেলার আয়োজন।
নানা উৎসব আয়োজনে বাংলাদেশ এখন এক অবিরাম মেলা-প্রাঙ্গণ। ছোট-খাট অসংখ্য মেলার মধ্যে সবচেয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। পুরো জানুয়ারি মাস জুড়ে এই মেলা চলবে, মেলার বাণিজ্য চলবে। ক্রেতা দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়ে সফল সমাপ্তি ঘটবে প্রায় দুই দশক ধরে চলা এই মেলার।
বাণিজ্য মেলার অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিশ্চয়ই আছে। টাকার অঙ্কে বড় ধরনের বাণিজ্য হয় এখানে এবং আমদানি রপ্তানির নানা পথ ও প্রস্তাব উন্মুক্ত হয়। মানুষ রাজনৈতিক জীব। আবার কেউ কেউ বলেন, মানুষ অর্থনৈতিক জীব। দুটো বিরোধপূর্ণ নয়। মূলত রাজনৈতিক অর্থনীতিই (পলিটিক্যাল ইকোনমি) আজকের বিশ্বব্যবস্থায় বড় অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। এই রাজনৈতিক অর্থনীতি নির্মিত ‘বাস্তবতার’ বাইরে আর কোন বাস্তবতা আছে বলে মনে করতে দিতে চায় না আধুনিক পুঁজিবাদ। ক্ষমতা আর পুঁজির মিশ্রণে যে গোলক ধাঁধাঁর সৃষ্টি হয়, সাধারণ মানুষেরা তাতে হাবুডুবু খেতে খেতে মনে করে এই তো জীবন! তখন একটি ৩৬ ইঞ্চি এলইডি টেলিভিশন কেনার মধ্যেই সে সুখ খুঁজে বেড়ায়। রং ফর্সাকারী কোনো ক্রিমকেই মনে করে অন্যের কাছে নিজেকে আকর্ষণীয় করার সহজ উপায়। বছর ঘোরার আগেই বাসার পুরনো পর্দাগুলো পাল্টে নতুন ঝকঝকে পর্দা কিনে হয়ে যায় আধুনিক। পণ্যই হয়ে যায় জীবন! আমরা হয়ে যাই পণ্য-উপাসক।
অন্যদিকে এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই বিকাশ ঘটে পুঁজির, এবং সর্বোপরি রাজনীতির। কারণ সাধারণ মানুষকে মেকি জীবনবোধে এবং যাপনে উদ্বুদ্ধ করতে না পারলে রাজনৈতিক-ক্ষমতা চর্চার পথ প্রশস্ত হয় না। বাণিজ্য মেলাও তাই শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক অর্থনীতিরই বাৎসরিক উদযাপন।
এমন আরও কতো মেলা হয়। একমাত্র বই মেলা বাদে অন্য সব মেলারই উপজীব্য হয়ে দাঁড়ায় বাণিজ্য। বলছি না, বই মেলায় কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য থাকে না। নিশ্চয়ই থাকে। কিন্তু একমাত্র বাণিজ্যকে উপলক্ষ্য করেই একজন লেখক বা প্রকাশক বই বের করেন না। একটি বই তো শুধু একটি বই নয়; একটি চিন্তার/উপলব্ধির নির্যাস। একটি ভালো বই একদিকে যেমন বাণিজ্যিক, অন্যদিকে সৃজনশীল, মননশীল এবং মানবীয়। সুতরাং বই মেলায় বাণিজ্য থাকলেও সেটি মুখ্য হয়ে ওঠে না। অপরাপর সমস্ত মেলায় মুনাফাই শেষ কথা। শীতের এই সময়ে নানা জায়গায় অনুষ্ঠিত হয় পিঠা মেলা/উৎসব। পিঠা একটি সুস্বাদু ও আকর্ষণীয় খাবার। আবহমান বাঙ্গালি সংস্কৃতির অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে যাওয়া পিঠা খাবার হিসেবে যতো না কাঙ্খিত, তার চেয়েও এর সঙ্গে লেপটে থাকা একটি মোহনীয় ভাবই হয়ে ওঠে বেশি উপভোগ্য। সেই পিঠা উৎসবেও আঘাত হানে বাণিজ্যের হাতিয়ার। না হলে হোটেল লা মেরিডিয়ানের ল্যাটিচুড রেস্তোরাঁয় তিনটি পিঠা ও একটি মসলা চা এর প্যাকেজ মূল্য ৯৫০ টাকা হবে কী কারণে?
পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যের এই বিকাশ বাংলাদেশে ভয়ানকভাবে ডালপালা মেলছে। ২০ কোটি মানুষের এই দেশ লোভনীয় পর্যায়ের বড় একটি বাজার। পুঁজিবাদের চোখে ২০ কোটি মানুষ তাই শুধু মানুষ নয়; এ হলো ২০ কোটি ভোক্তা। বাজার ভরা পণ্যের ভিড়ে মানুষ নিজেকেই ভেবে নেয় ‘পণ্য’। সেভাবেই তৈরি হয় তার বোধ আর বিবেচনা। বাণিজ্যের খোলসে হারিয়ে যায় সমস্ত মানবিক বোধ। পণ্যের পেছনে ছুটে চলাই তার নিয়তি। সেটি সামান্য ডিম হলেও! গেল বছরের ১৩ অক্টোবর রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত ডিম মেলায় ছয়/সাত টাকার ডিম তিন টাকায় কিনতে হাজার হাজার মানুষ যে যুদ্ধটি করল এবং অনেকেই ডিম না পেয়ে যে বিশৃঙ্খলা আর হট্টগোল পাকালো, সে তবে কিসের ইঙ্গিত? একটি ডিম তাই একটি ডিম শুধু নয়; এ হলো একটি উদ্দিষ্ট, একটি অভীষ্ট, এ হলো “পণ্যের জন্য জীবন” এর অপ্রত্যাশিত অনুবাদ। যে মানুষগুলো ডিম না পেয়ে বিশৃঙ্খলা করেছে, ঐ মূহুর্তে ডিমই ছিল তাদের পৃথিবী! পুঁজিবাদ ডিম পাওয়া না-পাওয়াকেই সাফল্য ব্যর্থতার মানদণ্ড হিসেবে তাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এটিই পুঁজিবাদের সার্থকতা। আপনি তা নন যা আপনি; আপনি তা-ই যা আপনাকে বলা হয়। আপনাকে গড়ে তোলা হয়।
কখনো পিঠা, কখনো ডিম, কখনো সবজি, কখনো স্মার্টফোন- জীবন যেন মেলাময়! সব কিছুর মূলে সেই বাণিজ্য। উপর্যুপরি বাণিজ্যের আঘাতে আঘাতে আমাদের মনগুলো হয়ে গেছে প্রবল হিসেবী বস্তুগত এক জড় পদার্থ। ভোগের বাইরে এই মন আর কিছু ভাবতে চায় না। আর কিছু নিতে চায় না। অথচ মন কতো মোহনীয় একটি বিষয়! একটি সুকুমার মন, একটি আলোকিত মন কতো মানবিক একজন মানুষ গড়ে তুলতে পারে! কিন্তু সেটিও চর্চার বিষয়। হাজারটি বাণিজ্য মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার চেয়ে একজন ভালো মানুষ গড়ে তোলার উদ্যোগ বেশি প্রয়োজন।
আমাদের এখন একটি মানবিক মেলা দরকার। সত্যিকারর মানুষ হওয়ার পাঠ দরকার। এমন একটি ‘মেলা’ হওয়া দরকার যেখানে মানুষ ‘মানুষ’ হতে শিখবে। মানবিক এক সমাজ গঠনে নিজেকে নিয়োজিত করবে। একটি অবাণিজ্যিক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা না গেলে সেটি মানুষ হিসেবে আমাদেরই ব্যর্থতা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)