বাংলাদেশের অভিভাবকদের মধ্যে বর্তমানে তার সন্তানটিকে নিয়ে যে মূল প্রতিযোগীতাটা কাজ করে তা হলো এ+ পাওয়ার প্রতিযোগীতা। আর তাদের এ অসুস্থ প্রতিযোগীতাটাকে এগিয়ে নিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে কোচিং সেন্টারগুলো। স্কুলের চেয়ে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা এখন বেশি মাত্রায় কোচিং সেন্টার মুখী। অভিভাবকদের মধ্যে এখন বদ্ধমূল ধারণা এ+ যারা পায় তারাই শুধু ভালো শিক্ষার্থী। সন্তানটি আদৌ কিছু শিখছে কিনা বা তাদের মেধার বিকাশ ঘটছে কিনা সেদিকে আদৌ সচেতন নন অভিভাবকরা।
যার কারণে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ফল বিপর্যয়ের মতো ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন শিক্ষা ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ জিয়া হাসান। আর এ প্রজন্মের হাতে দেশ চালনার দায়িত্ব যখন বর্তাবে তখন কী বিপর্যয় ঘটতে পারে তা নিয়েও শঙ্কিত তিনি।
এ বিষয়ে তিনি ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন,
বাংলাদেশের কোচিং সেন্টারগুলো গত ১০ বছরে কিংবা তার কিছু বেশী সময়ে চরম সফলতার সাথে একটি কাজ করেছে, সেটি হল সারা বাংলাদেশের অভিভাবকদের মধ্যে শক্তভাবে এই ধারণা ঢুকিয়ে দেয়া যে তার সন্তান পরীক্ষায় এ+ পেলেই কেবল ভাল ছাত্র বা ছাত্রী, বাকী যে কোন রেজাল্ট ফেইলের সমতূল্য।
এ বছরে জানুয়ারীর ১ তারিখের একটি ঘটনা বলি, ঢাকা থেকে করটিয়ায় আমাদের স্কুলে গিয়ে শুনলাম, সদ্য পিএসসি তে কৃতকার্য হওয়া একটি ছেলেকে তার বাবা আমাদের স্কুল থেকে অন্য স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে। আমি অভিভাবকটির সাথে দেখা করে জানতে চাইলাম বাচ্চাটিকে কেন নিয়ে যাচ্ছেন? সে বলল, “ও তো বিজ্ঞানে ফেল করসে, তাই।” আমি বললাম, “ও তো ফেইল করে নাই, ‘এ’ পেয়েছে, তার মানে হল ৭০ থেকে ৭৯ এর মধ্যে পেয়েছে।” উত্তরে সে বলল, “ওইটা ফেলই”। বাচ্চাটি আমার পাশে দাঁড়িয়ে হাপুস-হুপুস করে কাঁদছিল। সে কিছুতেই আমাদের স্কুল ছেড়ে যাবে না।
বাবার কাছে জানতে চাইল, “তুমি তাহলে আমাকে ইংলিশ ভার্সনে পড়ালে কেন?” বলে আবার কাঁদতে লাগল। আমি ওর কাঁধে হাত রেখে বসে ছিলাম, অনেক কষ্টে আমি চোখের পানি সামলালাম। বাচ্চাটিকে সত্যিই বাবা নিয়ে চলে গেল। রাফিনের সহপাঠী ছিল বাচ্চাটি এবং খুব প্রিয় বন্ধুও ছিল ওর। ছোটবেলা থেকে ইংরেজী ভার্সনে পড়াশুনা করেছে, চমৎকার, স্মার্ট, মেধাবী একটি শিশু। ওকে হারিয়ে ক্লাস ফাইভের সব ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকদের সবারই ভীষণ মন খারাপ ছিল। গ্রামের বৈরি পরিবেশে আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করি একটা শিশুকে সুস্থ পরিবেশ উপহার দিতে এবং তার মেধার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটাতে। একট বাচ্চা চলে যাওয়া মানে একটি সম্পদ হারানো। বাংলা ভার্সনের তুলনায় ইংরেজী ভার্সন দ্বিগুন কঠিন। এই দ্বিগুন কঠিন মাধ্যমে সে ছয় বিষয়ে জাতিয় পরীক্ষা দিয়ে পাঁচটিতে এ+ পেয়েছে এবং একটিতে এ পেয়েছে, কিন্তু বাবা-মার কাছে সে ফেইল। এবং শাস্তি স্বরূপ তাকে তার অতি প্রিয় স্কুল থেকে কোচিং সেন্টারে স্থানান্তরিত করা হল কারণ তারা কথা দিয়েছে পরের সব পরীক্ষায় তার এ+ নিশ্চিত।
এই বাবাটি একজন প্রতিকী বাবা। প্রতি বছর যে প্রায় ২৫ লক্ষ বাচ্চা পিএসসি দেয় তাদের অভিভাবকদের ৯৮% এর । মনেই থাকে এই স্বপ্ন, তার ১০ বছরের শিশু সন্তানকে যে কোন ভাবে এ+ পেতেই হবে। তার জন্য যা খরচ করতে হয় তারা করবে এবং শিশুর উপর মানসিক-শারিরিক যা চাপ দেয়া দরকার সেটা দেবে। আর এই ২৫ লাখের মধ্যে যখন ২২ লাখই এ+ পায় না তারা তখন হয়ে যায় ফেইল পর্যায়ের ছাত্রছাত্রী। সমস্ত অভিভাবকের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য না হলেও সিংহভাগ অভিভাবকের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। তাই বলছিলাম বাংলাদেশের কোচিং সেন্টারগুলো খুবই সফল। প্রতি বছর বন্ধ করি করি বলেও পিএসসি বন্ধ হচ্ছে না কারণ এখানে আছে হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য। আর হাজার কোটি টাকা আমরা অভিভাবকরা সাগ্রহে কোচিং সেন্টারের হাতে তুলে দিচ্ছি নিজেদের সন্তানকে তোতা পাখি বানানোর বিনিময়ে। এর রেজাল্ট ঘটতে শুরু করেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ৫৮ হাজার পরীক্ষার্থীর ৯৫% শতাংশ ইংরেজীতে ফেইল করে। বাকী রেজাল্ট পাওয়া যাবে আর দশ বছর পরে। এই জেনারেশন যখন দেশের চালকের আসনে বসবে। আল্লাহ্ আমাদের রক্ষা করুন।