মিয়ানমার থেকে আসা এইডস আক্রান্ত দুই রোহিঙ্গা নারীকে চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৪ সেপ্টেম্বর রোববার রাতে কক্সবাজারের উখিয়ার শরণার্থী শিবির থেকে তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেলে পাঠানো হয়। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা বিভিন্ন ধরনের রোগে ভুগছেন। এর মধ্যে ডায়রিয়া, শ্বাসতন্ত্রজনিত বিভিন্ন রোগে এখনও ২০০ রোহিঙ্গা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
গত ২৬ আগস্ট থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কক্সবাজার সদর হাসপাতাল, উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা হাসপাতালে তিন হাজার ১৪ জন রোহিঙ্গা ভর্তি হয়ে সেবা নিয়েছেন বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুম। এদিকে শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১৫ হাজারেরও বেশি অন্তঃসত্ত্বা নারী রয়েছেন বলে জানা গেছে। তাদের একাংশ সন্তান জন্ম দিচ্ছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিস। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিস সূত্র জানায়, দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা অন্তঃসত্ত্বা নারীদের মধ্যে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জন নারীর সন্তান ভূমিষ্ট হচ্ছে। সব ধরনের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট রয়েছে স্থানীয় হাসপাতাল ও দায়িত্বপ্রাপ্তরা। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের হাত থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের বাইরেও প্রতিদিন যোগ হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ নবজাতক।
শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১৫ হাজারেরও বেশি অন্তঃসত্ত্বা নারী রয়েছেন, তাদের একাংশ সন্তান জন্ম দিচ্ছে বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিস। সন্তানসম্ভবা নারীদের জন্য বিনা খরচে অ্যাম্বুলেন্সসহ সব ধরনের চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করে দেয় সরকার। ২৬ আগস্ট থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কক্সবাজার সদর হাসপাতাল, উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা হাসপাতালে তিন হাজার ১৪ জন রোহিঙ্গা ভর্তি হয়ে সেবা নেয়। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা বিভিন্ন ধরনের রোগে ভুগছে। এর মধ্যে ডায়রিয়া, শ্বাসতন্ত্রজনিত বিভিন্ন রোগে তখনও ২০০ রোহিঙ্গা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশ ১৬ কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারলে, আরও ৭ লাখ মানুষকেও খাবার দিতে পারবে। সে মোতাবেক বিভিন্ন উদ্যোগ ও ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত আছে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে। তবে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্মহার অনেক বেশি হওয়ায় সরকার কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপক প্রচারণা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এ লক্ষ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাঝে জন্মনিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত সব ধরনের উপকরণ বিতরণ করে, যার মধ্যে রয়েছে কনডম, জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়িসহ, ইনজেকশন ও অন্যান্য উপকরণ। এ ছাড়া জন্মনিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত অন্যান্য ব্যবস্থাও সরকারিভাবে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ নিজে দেশের নাগরিকদের চার বছর ধরে ভ্যাসেকটমি এবং কিউবেকটমি সেবা দিয়ে আসছে। এজন্য সেবা নেওয়া প্রত্যেক নাগরিককে ২৩০০ টাকা ও ঐতিহ্যবাহী লুঙ্গি, শাড়ি দেওয়া হয়। প্রতিমাসে কক্সবাজার জেলায় অন্তত ২৫০ জন এই সেবা নিয়ে থাকেন। তবে রোহিঙ্গাদের জন্য বিষয়টি একটু বেশি জরুরী ছিলো। কারণ প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারেই ৮ থেকে ১০ সন্তান। এক বা দুই সন্তান যে পরিবারের জন্য ভাল হয় এ ধারণা তারা মানতেই নারাজ। এ জন্য এ বিষয়টি নিয়ে তখনই ভাবা শুরু করেছে সরকার। কিভাবে রোহিঙ্গাদের জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়ে আগ্রহী করে তোলা যায়। এছাড়া যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ছোট ছোট সন্তান নিয়ে এসেছেন বা সন্তান প্রসব করবেন তাদের বিষয়টিও তখন ভাবছে সরকার। সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নিয়মিতই উখিয়া এবং টেকনাফের শরনার্থী ক্যাম্পগুলো পরিদর্শনে যাচ্ছেন। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের মধ্যে দেড় লাখ শিশুকে টিকা প্রদান করার লক্ষ্য নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় কাজ শুরু করে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম তখন বিষয়টি নিয়ে বেশ সচেতন ছিলেন। ইতোমধ্যে ৫৬ হাজার শরণার্থীকে এমআর টিকা, ২০ হাজার জনকে বিওপিভি এবং ১৫ হাজার জনকে ভিটামিন এ খাওয়ানো হয়। তাদের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের জন্য ১২টি স্বাস্থ্য সেবা ক্যাম্পে ৩৬টি টিম কাজ করে। কথা হয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। তিনি বলেন, রাখাইন রাজ্যে কোন উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। জন্ম নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নেই। এমনকি স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে যে নিরাপদে প্রসব করা যায় সে বিষয়েও তাদের কোন ধারনা নেই। অনেক রোহিঙ্গাই সন্তান প্রসবের জন্য স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যান না। এমনকি জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিয়েও সন্তুষ্ট নয় রোহিঙ্গারা।
মন্ত্রী রোহিঙ্গাদের জন্য পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদানের জন্য পৃথক ১০টি মেডিকেল টিম গঠন করে দেন। যারা ৮/১০ প্রকার ওষুধ এবং কনডম, খাবার বড়ি, তিন মাস মেয়াদী ইনজেকশন বিতরণ করে। এছাড়াও পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধিতি সম্পর্কে তাদের কাউন্সিলিং করতে ৮৬ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয়। ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রশিক্ষিত নার্স, মিডওয়াইফদের হাতে ১৭৩টি নরমাল ডেলিভেরির মাধ্যমে রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নেয়। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে ১৬ থেকে ১৮ হাজার গর্ভবতী নারী রয়েছে। তাদের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করা হয়। সেসময় নিয়মিতই রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো ঘরে দেখতেন সরকারী কর্মকর্তারা। সরকারী সহায়তার পাশাপাশি সরকারী কর্মকর্তারা এগিয়ে আসেন রোহিঙ্গাদের সেবায়। সেসময় সকল চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধিনস্ত কর্মকর্তা, কর্মচারীদের একদিনের বেতন রোহিঙ্গাদের সহায়তায় দিয়ে দেয় দেওয়া হয়। রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদার যোগান দেওয়ার পাশাপাশি সরকারের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ ছিলো রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা।
কনডমের মতো স্বল্প মেয়াদী জন্ম বিরতকরণ পদ্ধতিতে রোহিঙ্গাদের অনীহার কারণে ভ্যাসেকটমি, কিউবেকটমির মতো স্থায়ী পদ্ধতি শরণার্থী শিবিরগুলোতে চালু করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তবে শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সচেতনতা কম। কক্সবাজারে কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে এক রোহিঙ্গা নারীকে পাওয়া গেছে, যার ১৯টি সন্তান রয়েছে। তাদের মধ্যে এমন ধারণাও রয়েছে বেশি সন্তান নিতে পারলে জীবন সংগ্রাম সহজ হবে। ১৯৯০ দশক থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে জন্মবিরতি পদ্ধতি চালু করতে কাজ করছে সরকার। চলতি বছর নতুন করে রোহিঙ্গা ঢল শুরুর পর সেই কার্যক্রমে আবারও গতি আনা হয়। কক্সবাজার জেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য। এ বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয় ২২ সেপ্টেম্বর। তিনি জানান, অনেক চেষ্টার পর মাত্র ৫৪৯ প্যাকেট কনডম বিতরণ করতে সক্ষম হয়েছেন তারা। তবে তা ব্যবহারেও অনীহা রয়েছে রোহিঙ্গাদের। এই পরিস্থিতিতে পুরুষদের জন্য স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ভ্যোসেকটমি আর নারীদের জন্য স্থায়ী পদ্ধতি টিউবেকটমি চালু করতে সরকার কাজ শুরু করেছে বলে জানান তিনি।
রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে এমনিতেই মানুষের সংখ্যা বেশি। আর নতুন শিশুর জন্ম হতে থাকলে তা আরও বেড়ে গিয়েপরিস্থিতিকে জটিল করে তুলতে পারে বলে মনে করেন পিন্ট ভট্টাচার্য। তবে শরণার্থী শিবিরে তাদের টিকে থাকার জন্য বেশি মানুষ দরকার বলে মনে করেন রোহিঙ্গারা। অনেক রোহিঙ্গা নাগরিক আমাকে জানায়, বেশি সন্তান থাকলে নিত্যকার লড়াই চালাতে সুবিধা হয়। খাবার ও পানির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বেশি করে তা সংগ্রহ করা যায়। আবার অনেকেই মনে করেন জন্ম নিয়ন্ত্রণ ইসলাম বিরুদ্ধে একটি কাজ। রোহিঙ্গা শিবিরে কাজ করা পরিবার পরিকল্পনা স্বেচ্ছাসেবী ফারহারা সুলতানার সাথে কথা হয়। তিনি এমন অনেক রোহিঙ্গা নারীর সঙ্গে কথা বলেছেন; যারা মনে করেন জন্মনিয়ন্ত্রণ একটি পাপ কাজ।
রাখাইনে রোহিঙ্গারা পরিবার পরিকল্পনা ক্লিনিকে যায় না, কারণ তাদের আশঙ্কা, মিয়ানমার সরকার ওষুধ দিয়ে তাদের সন্তানদের ক্ষতি করতে পারে, বলেন ফারহানা। তবে স্বেচ্ছাসেবীরা জন্মনিয়ন্ত্রণের তাগিদ দিলেও রোহিঙ্গা নারীরা শুধুমাত্র গর্ভকালীন জটিলতা ও নবজাতকের সুরক্ষার জন্যই তাদের সাহায্য চান। সবুরা নামের সাত সন্তানের মা এক রোহিঙ্গা বলেন, তিনি এবং তার স্বামী মনে করেন, বড় একটি পরিবারের দেখাশুনা করার সামর্থ্য তাদের রয়েছে। (চলবে)