ঋণ বিতরণে অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ব্যাংকগুলোতে দিন দিন বেড়েই চলছে খেলাপির পরিমাণ। বর্তমানে ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এর অর্ধেকই অর্থাৎ ৩৫ হাজার ৭১৬ টাকা হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ব ছয় ব্যাংকের।
এরপরও ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি মেটাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা। বিশ্লেষকরা বলছেন, খেলাপি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা হচ্ছে অর্থমন্ত্রীর ব্যর্থতা। এর মধ্যে এই বরাদ্দের ঋণ খেলাপিরা আরো উজ্জীবিত হবে। বলা চলে, তাদের জন্যে সুখবর দিলেন অর্থমন্ত্রী।
খেলাপি ঋণের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি করা সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ হচ্ছে ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে এই খেলাপির পরিমাণ ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। সে হিসেবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা।
আর এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। ২০১৬ সালের মার্চ প্রান্তিক শেষে খেলাপির পরিমাণ ছিল ৫৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক- এই ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩৫ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা। এছাড়া বেসরকারি খাতের ৪০টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। আর বিদেশি ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২ হাজার ২৮২ কোটি টাকা এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ঋণ ৫ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা।
এছাড়াও ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এ তথ্য খেলাপির হিসাসে নিলে মোট খেলাপির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। খেলাপির এই চিত্রে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, যাচাই-বাছাই না করেই ঋণ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া বিশেষ সুবিধায় নিয়মিত করা ঋণ আবারও খেলাপি হয়ে পড়ছে। সেসব খেলাপিরাই আবার ঋণ নিচ্ছে। এসব ঋণ দেয়া হচ্ছে ব্যাংকের এমডি-চেযারম্যানদের সুপারিশে, রাজনৈতিক বিবেচনায়। আর এসব কর্মকাণ্ড হচ্ছে সরকারের একটি শীর্ষ মহলের ছত্রছায়ায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডিপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, খেলাপি ঋণ বাড়ছেই, যা উদ্বেগজনক। বেসরকারি ব্যাংকে মাত্র ৫ শতাংশ হলেও রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকে এর পরিমাণ ৩০ শতাংশ। এসব ব্যাংকে সরকারের নিয়োগ দেয়া এমডি-চেয়ারম্যানের মাধ্যমেই ঋণ বিতরণ করা হয়। ফলে দুর্নীতি করলেও তারা থেকে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
তিনি বলেন, ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা হয়ে থাকে অর্থনৈতিক সর্ম্পক বিভাগের (ইআরডি) অধীনে। যা অর্থমন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে খেলাপি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার জন্য সরাসরি দায়ী অর্থমন্ত্রী।
এতো পরিমাণ ঋণ খেলাপির পরও ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি মেটাতে এ বছরের (২০১৭-১৮) বাজেটে ২ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যা মেটানো হবে জনগণের পকেটের টাকায়। এ বিষয়ে তিনি বলেন, উদ্বেগজনক খেলাপির পরও ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকগুলোকে বরাদ্দ দেয়ার মানে হচ্ছে, খেলাপিদের জন্য আরো সুসংবাদ বয়ে আনা।
ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ দিচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকেরা নিজেদের মধ্যে ঋণ আদান-প্রদান করছেন। ঋণের সঠিক ব্যবহার না করে এসব অর্থ পাচার হচ্ছে। এর সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও জড়িত রয়েছেন।
উদ্বেগজনক হারে খেলাপির সংখ্যা বাড়ছে তা জানিয়েছেন খোদ অর্থমন্ত্রীও। গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছেন, বর্তমানে দেশে ঋণ খেলাপি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দুই লাখ দুই হাজার ৬২৩।
লোকসান না কমিয়ে ব্যাংকে বরাদ্দ দেয়াকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে বিশ্বব্যাংক। ওই দিনই বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেশি বেশি ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। আর তারা বছরের পর বছর লোকসান করে যাচ্ছে। বাজেটে লোকসান কমানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। উল্টো এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে আরও মূলধন দেওয়া হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেসরকারি ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের যে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে তা কার্যকর হলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কয়েকজন পরিচালকের তৈরি করা সিন্ডিকেট আরও শক্তিশালী হবে। কারণ এই সিন্ডেকেটই নির্ধারণ করে, কারা ঋণ পাবেন আর কারা এমডি হবেন। মূলত এদের সুপারিশে দেয়া ঋণই বেশি খেলাপি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
অর্থনীতিদদের আশঙ্কা, খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতি নামের মারাত্মক ব্যাধির সঙ্গে সুশাসনের অভাব ও রাজনৈতিক প্রভাব যুক্ত হওয়ায় ব্যাংকিং খাতে ভেঙ্গে পড়তে পারে। তারা বলছেন, অর্থঋণ ও দেউলিয়া আদালতের মাধ্যমে ঋণখেলাপিদের কোনো বিচার হচ্ছে না। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচারের আওতায় এনে তাদের জেলে পাঠিয়ে সম্পত্তি জব্দ করলে খেলাপি ঋণ কমে আসবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর শাখায় বলতে গেলে ঋণ খেলাপি হয় না। এসব শাখাকে টিকিয়ে রাখতে মূলধন ঘাটতি মেটানোর জন্য বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে পুরো ব্যাংক খাতে।
ব্যাংকগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, খেলাপি আদায়ে প্রয়োজনে আইনের আশ্রয় নিয়ে অপরাধীদের জেল-হাজতে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না এবং ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়তে হবে।
তিনি বলেন, খেলাপির বিপরীতে ব্যাংকগুলোতে প্রভিশন রাখতে হয়। আর প্রভিশন রাখা হয় মুনাফা থেকে। যা শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।