২৫শে মার্চ বাঙালীর এক কালো অধ্যায়ের নাম। আজ আমরা দিনটি স্মরণ করি কিন্তু অনুভব করি ক’জন। সেই কালো রাতটির কথাই এবার নিজের লেখায় তুলে ধরলেন কবি ও লেখক মুজতবা আহমেদ মুরশেদ। নিজের ফেসবুকে তিনি এই সংক্রান্ত একটি পোস্ট দিয়েছেন।
আজকাল মার্চের পঁচিশ তারিখ এলে মাঝরাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে সাংস্কৃতিক কর্মীরা ১৯৭১ এর কালরাত্রিকে স্মরণ করেন। পরদিন স্বাধীনতা দিবসে শুরু হয় সকলের ভেতর আনন্দ উৎসব। হুল্লোর। সেলফি তোলায় হিড়িক। কিন্তু কেমন ছিল ১৯৭১ এর পঁচিশে মার্চের রাত? কেমন থমথমে, বিষন্ন ও ভয়াবহ ছিলো ২৬ মার্চের সকাল, দুপুর আর বিকেল? সে মুহূর্তগুলো ছিল কলজে খামচে ধরা।
আমার তখন এগারো বছর বয়স। দিনাজপুর শহরে থাকি। আমার আব্বা এডভোকেট মোহম্মদ আজিজুর রহমান ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) এবং বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে দফায় দফায় নানা স্থানে, নানা জনের সাথে মিটিংএ ব্যস্ত। পঁচিশে মার্চের সারাটা দিনে কেউ কিছুই বুঝেনি রাতে কি হতে যাচ্ছে। বুকহিম করা সে সময়ের ঘটনা প্রবাহ নতুন প্রজন্মের জন্যে তুলে ধরলাম।
এরপর সেই রাতের ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরে মুজতবা আহমেদ মুরশেদ লিখেন, পঁচিশে মার্চের মাঝ রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। পাশে আব্বা। আমার কেমন জানি অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছে। বাসার সবাই কে কোথায় আছে চিন্তা করার চেষ্টা করছি। পাশের ঘরে আম্মা। আম্মার সাথে বুবু, হাসনাইন, তাসনীম আর জুই। বড়ভাই আর ছোটভাই? ওদের ঘরটা একটু দূরে। ওরা ঘরে আছে তো?
অন্ধকারেই চোখ মেলে ছাদের দিকে তাকালাম। হঠাৎ কানে খুব দ্রুত শ্লোগান ভেসে এলো। জয় বাংলা। জয় বাংলা। ব্যস সাথে সাথেই গুলি। অল্প গুলি। রাস্তাতে ভারি ট্রাক চলার শব্দ। আবার শ্লোগান আর গুলি। অবিশ্রান্ত গুলি।
আব্বা লাফ দিয়ে বিছানাতে উঠেই আবার শুয়ে পড়লেন। তারপর ক্ষিপ্রগতিতে আমাকে মেঝেতে নামিয়ে হামাগুঁড়ি দিয়ে পাশের ঘরে এগুচ্ছেন। আব্বা আমার হাতটা ধরে আছে। আমিও আব্বার গা ঘেঁষে হামা দিয়ে পাশের ঘরে গেলাম। এদিকে গুলির শব্দে অন্য সবাই জেগে গেছে। জুঁই আর নাজরিন কাঁদছে। আব্বা আম্মাকে বলছেন, ওদের চুপ করাও। এই চুপ চুপ।
বুবু ওদের চুপ করাচ্ছে। আমরা সবাই মেঝেতে। প্রচণ্ড গুলির শব্দ। মনে হচ্ছে আমাদের মাথার উপর দিয়ে গুলি চলছে। বাতাসে বুলেটের শিষ কেটে যাবার শব্দ। কোনাকুনি গুলিগুলো এসে বাসার ছাদের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। আব্বা আর আম্মা দোয়া পড়ছে। আমাদের ঠেলে বিছানার তলে ঢুকিয়ে দিলেন। প্রচণ্ড গরম। টিকা দায় বিছানার তলে। গলগল করে ঘাম ঝড়ছে। পাতলা শার্টটা ভিজে একসা। মুখটা প্রায় মেঝেতে গুঁজে ফেলেছি। মাথাটা কাত করে দরজার দিকে তাকাচ্ছি। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। দরজার নিচ দিয়ে অতি স্বল্প আলোর রেখা। আমার মাথাটা হাসনাইনের মাথার সাথে বাড়ি খাচ্ছে। চৌকির নীচে সরে যাওয়ার বাড়তি জায়গা নাই। কানে একটানা গুলির শব্দ। গুলির তীব্র শব্দে মেঝে থেকে মাথা তোলার কোনো সাহস হয় না।
কয়েক মিনিট পর দেখি আব্বা ছেঁচড়ে মেঝেতে হামা দিয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছেন। আব্বার দুশ্চিন্তায় রুদ্ধকণ্ঠ। দেখি তো সহিদ, মাসুদ কোথায়? ছেলেদুটোর ঘরে গুলি লাগলো কি না। ঠিক পর মুহূর্তে খটখট করে গোটা কয় গুলি যেন জানালার চৌকাঠের উপর এসে লাগলো। আমরা আতঙ্কে কুঁকড়ে গেলাম। বারবার মনে হচ্ছে একঝাঁক গুলি জানালা ভেদ করে এই এখুনি আমাদের ছিন্নভিন্ন করবে।
এ যেন কিয়ামত। গুলির একটানা আওয়াজ চলছে তো চলছেই। আর মাঝে মাঝেই শ্লোগান। জয় বাংলা। এতক্ষণে মনে হলো বাংলা উচ্চারণটা যেন ‘বোংলা’ শোনাচ্ছে। এই গুলির মধ্যেও আমার মনে হলো এটা বিহারিদের উচ্চারণ!
ট্রাক চলে যাবার শব্দ। জয় বোংলা শ্লোগান ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গুলি তখনো থামেনি। এর মাঝেই আব্বার কণ্ঠ। ঠিক আছে, ঠিক আছে, সহিদ মাসুদের কিছু হয় নাই। আমার মনে হলো বুকের উপর যে পাথরটা ছিল, তা সরে গেল। তবুও আমরা সবাই বিছানার নীচেই মেঝেতে কাঠের মতো পরে থাকলাম।
ঘরের ভিতর ধীরে ধীরে আলো আসছে। সকাল কি হলো? আর কি গুলি হবে? নানান দুর্ভাবনা মাথার ভিতর। আব্বা একে একে আমাদের বিছানার নীচ থেকে বের করতে শুরু করলেন। কিন্তু কাউকেই দাঁড়াতে দিচ্ছে না। আব্বা আস্তে করে জানালার একটা পাল্লা একটু ফাঁক করে বাইরে দেখলো। কেউ কোথাও নাই।
আমরা সবাই ধৈর্য ধরে মেঝেতে বসা। ভয়ানক ক্লান্ত। একটু পরেই মাইকে ঘোষণা ভেসে এলো। ভাই সব, আজ ছাব্বিশে মার্চ সকাল ১১টা থেকে দিনাজপুর শহরে কারফিউ বলবত করা হবে। কারফিউয়ের সময় কেউ ঘরের বাইরে যাবেন না। জানালায় উঁকি দিবেন না। ঘরের বাইরে দেখা মাত্র গুলির নির্দেশ জারি করা আছে। ভাই সব….
বিভীষিকাময় সেই রাতের পরের দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে এই লেকক আরো লিখেন, বিভীষিকাময় মৃত্যুর ভীতিকর ক্লান্তি ছেড়ে আমরা সবাই তড়াক করে উঠলাম। আব্বা বললেন, তোমরা যতটুকু পার কাপড় চোপড় গুছিয়ে নাও।
আমরা হন্তদন্ত হয়ে যে যার মতো সব গুছিয়ে নিচ্ছি। এমন সময় দরজায় জোড়ে কড়া নাড়ার শব্দ। সবাই সতর্ক হয়ে উঠলাম। বুবুকে খুবই ভয়ার্ত লাগছে। ফর্সা মুখটা ভয়ে আরও সাদা হয়ে গিয়েছে। ছোটরাও ভড়কে তাকিয়ে আছে আব্বা আম্মার দিকে। আব্বাই এগিয়ে গেলেন দরজা খুলতে। দরজা খুলেই দেখেন একজন অচেনা লোক। লোকটা সালাম দিল এবং আব্বার দিকে একটা চিরকুট বাড়িয়ে ধরলো।
আব্বা চিরকুটটাতে চোখ রেখেই লোকটাকে বললো, আপনি একটু দাঁড়ান, আমি আসছি। এই বলেই আব্বা ঘরের ভিতর ঢুকলেন। আম্মাকে জানালো যে দিনাজপুরের ডিসি ফয়েজউদ্দিন তাকে অনুরোধ করেছেন ডিসি অফিসে যেতে। আম্মা বেদনার্ত মুখে আব্বার দিকে তাকিয়ে। আব্বাও পূর্ণ চোখে আম্মার দিকে, তারপর আমাদের সবার দিকে তাকালেন। এরপর একটু খুলেই বললো সবার উদ্দেশ্য। আমার সাথে আলোচনা করতে চায়। উনি আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদেরও ডেকেছেন।
কথাটা উচ্চারণ করলেন ঠিক, কিন্তু আব্বার সমস্ত মুখে দ্বিধা। আম্মা আব্বার দিকে তাকিয়ে। আব্বা আবার আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। তারপর দ্বিধা ঝেড়ে বলে উঠলেন, তোমরা নিরাপদ আশ্রয়ে এই মুহূর্তে চলে যাও। আমরা মনে হয় তোমরা বালুয়াডাঙ্গার শেষ মাথায় পানমোহম্মদ চৌধুরীর ছেলের সামু’র (শামসুদ্দিন চৌধুরী) বাসায় গিয়ে উঠো। ওখান থেকে নদী কাছে। তোমাদের যদি নদী পার হতে হয় তো কার্ফু শেষে তোমরা সহজে নদী পার হয়ে গ্রামে যেতে পারবে। আমি ডিসি অফিস হয়েই চলে আসবো। তোমরা কোনো চিন্তা করবে না। আমি ঠিকই চলে আসবো।
বড়ভাই স্থিরভাবে তাকিয়ে শুধু বললো, আব্বা তুমি যাও, আমরা পারবো।
আমার হঠাৎ করে মনে হল সদ্য কলেজ যাওয়া আমাদের বড়ভাইটা আর দুষ্টু নাই। অনেক দায়িত্ববান একটা বড় মানুষ। আম্মা স্থিরভাবে বললেন, আবার দেখা হবে।
আব্বা লোকটার সাথে বেড়িয়ে গেলো। এই প্রথমবারের মতো আব্বা যাবার সময় আর পিছন ফিরেও তাকালো না। আমরা সবাই বারান্দায়। মেজর রাজা’র বাড়ির (উমীয়কুঠি) দোতলার ছাদে অনেক পাকিস্তানি সৈন্য গিজগিজ করছে। মেশিনগানের নলটা ডান থেকে বামে, আবার বাম থেকে ডানে ঘুরাচ্ছে। আমি মেশিনগানের নলটা থেকে মুখটা ঘুরিয়ে অনেকক্ষণ ধরে আব্বার পথের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আম্মাই তাগাদা দিলেন, তোমরা আর দেরি করবে না।
আব্বা চলে যেতেই আমরা যতটুকু পারলাম সাথে করে জিনিস নিতে থাকলাম। মেট্রিক পরীক্ষা হবে না জেনেও বুবু ওর পড়ুয়া স্বভাবের কারণে ক’টা বইও বস্তাতে ঢুকিয়ে দিল। দুটো চটের বস্তা, আর চারটা ব্যাগ ভরে আমাদের এই পুরো সংসার। বাসার দরজায় তালা ঝুলানো হলো। রাস্তাতে কোনো কিছুই নাই। শুক্রবারের দিন। এমনিতেই ফাঁকা। তারপর রাতে গোলাগুলি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দুটা রিকশা পাওয়া গেল। রিকশাতে উঠতে গিয়ে আমার মনে হলো আমার প্রিয় মোরগটা বাসার ভিতর। আমি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই রিকশা থেকে এক লাফে নামলাম।
বড়ভাই ধমকে উটলো, এই কি হলো?
মিঃ লি। মোরগটা।
লাগবে না।
আমি অসহায় ভাবে তাকালাম। বড়ভাই বললো, আচ্ছা থাম। আমি আনছি।
বড়ভাই দ্রুত বাসার ভিতর গিয়ে বিশাল সাইজের মিঃ লিকে আমার হাতে তুলে দিল।
রিকশা ছুটছে। পথের মধ্যেই দেখি রিকশাতে আড়াআড়ি করে গুলি খেয়ে পড়ে থাকা দুইটা লোক। আমরা ভীষণ ভড়কে গেলাম। মনে হলো চিৎকার করে উঠবো। এই রিকশাওয়ালা আরও জোরে চালাও। আমি রিকশাওয়ালাকে বারবার তাগাদা দিতে থাকলাম।
গলার ভিতর নাড়িভুড়ি উঠে এসেছে আমার। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই বুঝি মিলিটারি ছুটে আসবে আমাদের দিকে। গুলি করবে। আব্বার জন্যে খুব কান্না পেল। আব্বা কেন গেল? বুকটা মোচড় খাচ্ছে। আর বুঝি আব্বা ফিরবে না। কেন বাধা দিলাম না? কেন আমরা সবাই যেতে দিলাম? কেন আম্মা আব্বাকে যেতে দিল? প্রচণ্ড একটা কষ্ট।
বড়ভাইদের রিকশাটা আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল সামু’র বাসায়। ওর বাবা আমাদের সম্পর্কে ভাই হয়। জোতদার পরিবার। শামসুদ্দিন ভাস্তা এখানে লেখাপড়া করে। আমরা ওর বাসায় ঢুকেই প্রতিটা দরজা জানালা লাগিয়ে দিলাম। সামু বারবার সাবধান করলো, কেউ যেন জানালা ফাঁক করেও বাইরে না তাকায়। মিলিটারি তাহলে জানালাতেই গুলি করবে।
আমরা এবার খাঁচাতে ঢুকে থাকা মানুষের মতো হয়ে গেলাম। বাসাটা খুব একটা বড় না। তারপর দরজা জানালা সব বন্ধ। খুব অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাব। আব্বাও আসছে না। বারাবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি। ঘড়িটা যেন লাফ মেরে মেরে ১১টার দিকে দৌড়াচ্ছে। ১১টা তো বেজেই গেল। কই আব্বাতো আসছে না।
আম্মা একবার দরজার কাছে গেল। আবার ফিরে এলো। আমরা নিজেরাও এমন করছি। আমি জানালটা অতি চিকন করে ফাঁক করলাম। সেই আলোর রেখাতে দেখলাম একটা মিলিটারি জিপ আর লরি ছুটছে। ভারি পোশাক পরা সৈন্যগুলো রাইফেল তাক করে চারিদিকে তাকাচ্ছে। জিপ আর লরির উপর হালকা মেশিনগান বসানো।
আমার ঘাড়ে খামচি মেরে বুবু একটান দিল। ও নিজেও এই দৃশ্য দেখার চেষ্টা করেছে এবং মিলিটারি দেখে আমাকে টান মেরেছে।
কার্ফু শুরু হয়ে গেছে। আব্বা এলোনা। আম্মা স্তম্ভিত হয়ে বসে আছে। আমরা সবাই খাবারের কথা ভুলে গিয়েছি। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছি না। শামসুদ্দিন ভাস্তা আমাদের সবাইকে একবার সান্তনা দেবার চেষ্টা করলো। চিন্তা নাই, দাদা এত বড় নেতা। উনার কিছুই হবে না। ঠিক চলে আসবে। আপনারা খেয়ে নেন তো দাদি। আপনি খাওয়া শুরু করেন তো, তা না হলে তো বাচ্চাগুলা কেউ খাবে না।
ভয়ানক দুশ্চিন্তার মাঝে আমরা দুপুর পার করলাম। বিকাল হয়ে এলো। এখনো কোনো খোঁজ নাই আব্বার। এমন সময় বাড়ির পিছনের প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে ধুপ করে বাড়ির ভিতর বেটেখাটো কালোমতো একটা ছেলে লাফিয়ে নামলো। আমরা সবাই খুব চমকে গেলাম। কিন্তু দেখি আমাদের সুইপার দিনুয়া। আমাদের দিকে তাকিয়ে চকচকে দাঁত বের করে একটা নীরব হাসি। তারপর হাতের মুঠো খুলে আম্মাকে একটা চিরকুট।
আব্বা লিখেছে। ‘আমি ভালো আছি। একখানে আছি। তোমরা চিন্তা করবে না। আমাকে আর ইউসুফ আলীকে ডিসির বাংলোতে পাকিস্তানী মিলিটারি অফিসার লেঃ কঃ তারেক রসুল কোরেশী আমাদের আটকে রেখে মারতে চেয়েছিল। শেষে ছেড়ে দিয়েছে। ঢাকার খবর জানিনা। কারো সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। মুজিব ভাইয়ের খবরও জানিনা। দিনাজপুরেও আমরা নেতারা পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন। আমি দিনাজপুরের ইপিআরদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। কার্ফু উঠে গেলেই দেখা হবে। আমাদের দিনুয়া ডিসির বাংলোতে সুইপার জানতাম না। ওকে খেতে দিও।’