গত কয়েক বছরের মধ্যে এবার বৃষ্টি হয়েছে বেশি। অবিরাম বৃষ্টি হয়েছে কোনো কোনো দিন। মুষলধারে বৃৃষ্টি হয়েছে। কয়েকদিনের বৃষ্টির অনেকটাই যেন পাওয়া যায় ‘আয়নাবাজি’ চলচ্চিত্রে। নায়ক ভিজছে, শহর ভিজছে, নায়িকা ভিজছে। ভিজতে ভিজতেই গল্প এগোচ্ছে, ভিজতেই ভিজতেই শেষ।
চিত্রনাট্যে আকাশ ফুঁড়ে এমন ঝমঝমে বৃষ্টি বারবার নামানোর ইঙ্গিত হয়তো ছিল না। বৃষ্টিমুখর দিনে চিত্রধারণের সময় চলে এসেছে, তাই কিছুই করার ছিল না। এটিই হয়তো ঠিক। বৃৃষ্টির মতো বাঁধাকে তুচ্ছ করে পুরো ছবির কাজটি সারতে গিয়ে অমিতাভ রেজা দারুণ এক ব্যঞ্জনা খুঁজে পেয়েছেন বৃষ্টি থেকেই। বৃষ্টিই যেন বাঁচিয়ে দিয়েছে অনেক অংক। কারণ, বৃষ্টি নিজেই অনেক বড় বড় গল্প। বৃষ্টি দুঃখের গল্প। বৃষ্টি সুখেরও গল্প। আমি বলবো বৃষ্টিতে দৃশ্যায়নের কিছু ভালো উদাহরণ পেতে চাইলে আয়নাবাজি দেখতে হবে।
আর পাঁচজন বাঙালি দর্শকের মতোই আমি সিনেমা দেখাকে বুঝি ‘বই দেখা’। গল্প দেখতে যাই। কাহিনীর বাঁকে বাঁকে মজা খুঁজি। এর মধ্যে নাচ-গান, মারামারি, খুনোখুনি সব বাড়তি পাওয়া। ঘটনাসূত্রে যা ঘটে। আয়নাবাজি’তে আয়নার চরিত্রটি নায়কের। ভিলেনের নয়। কিন্তু সেই ছদ্মবেশি। সে ভাড়াটে অভিনেতা। বড় বড় অপরাধীর রূপ ধারণ করে জেলে যায়। বিনিময়ে ভালো টাকা পায়। দৃশ্যত তার কাজটি দেখানো হয় অন্যরকম পেশা হিসেবে। অপরাধ হিসেবে নয়। এখানে সমাজের চোখটি বন্ধই থাকে।
আয়না দারুণ আদর্শে উজ্জল এক যুবক। তার মধ্যে ভাষা, শব্দ, চিন্তা কিংবা কল্পনা ব্যবহারে ভিন্ন এক জগৎ তৈরির ক্ষমতা রয়েছে। সে এক কক্ষের একটি নাট্যশিক্ষার স্কুুল চালায়। শিশুদের স্কুল। শিশুদের অতি আপনজন হয়েই তাকে কাজটি করতে হয়। মাঝে মাঝে নিরুদ্দেশে যায়। এই নিরুদ্দেশকে সবাই জানে জাহাজে যাওয়া। সে যায় অর্থের বিনিময়ে নিজেকে অপরাধীর ভূমিকায় দাঁড় করিয়ে ক’দিন জেলখানায় কাটাতে। এর জন্য তাকে বেশ প্রস্তুতি নিতে হয়। আরেক ব্যক্তির ভেতরে ঢুকে যাওয়ার প্রস্তুতি। তার মতো হয়ে ওঠার প্রস্তুতি।
আয়নাবাজি দেখতে গিয়ে মনে হয় আমাদের সমাজেও এমন আয়নাবাজি চলছে। যদিও এর কোনো তথ্য প্রমাণ সাধারণ মানুুষের হাতে থাকে না খুব একটা। তবে জেলখানার কয়েদি মাসের পর মাস নিয়মিত বাড়িতে যাতায়াত করা কিংবা কারাগারে থেকেই সন্তানের বাবা হবার ঘটনা আছে। জেলখানা থেকে নিয়মিত বের হয়ে অপরাধ-জগতের কাজকর্ম সেরে আবার জেলে যাওয়ার খবরও আছে। এসব খবর গণমাধ্যমেই এসেছে। বদলি কয়েদি বা বদলি হাজতির নজিরও আছে। কিন্তু সেগুলো অজানা অচেনা মানুষের ক্ষেত্রে। আজকের দিনে মানুষের পরিচয় নির্দিষ্টকরণের এন্তার ব্যবস্থার মধ্যে একজন আরেকজনের ছদ্মবেশ ধরা বেশ কঠিন। এই কঠিন কাজটি বাস্তবের মতো করেই তুলে ধরেছেন ‘আয়নাবাজি’র কারিগররা। চলচ্চিত্র তো এই জিনিসই।
তথ্য আর খবরের যুগ এখন। মানুুষ তাই ঘটনা ও খবরের পেছনে ছুটতে ভালোবাসে। গান, বিনোদনও মানুষকে খুব বেশি টানে না। তথ্য বা ঘটনার সিঁড়ি দিয়ে মানুষকে অনেক গভীরে যেমন নামানো যায়, তুলেও দেয়া যায় ওপরে। মানুষ ঘটনার ভেতরেই পায় দরকারি রস।
সিনেমা দেখে বেরিয়ে হঠাৎ একবার মনে হয়েছে এটি ‘পাল্টা সিনেমা’। মনে হয়েছে বিকল্প সিনেমা। অপরাধ ও অপরাধীকে জয়ী করার প্রয়াসই রয়েছে এর শেষ পর্যন্ত। অর্থশালী নারী ধর্ষক, আলালের ঘরের অপরাধী দুলাল ও খুনী রাজনীতিক সবাই তার লক্ষ্য পূরণে সফল হয়। এর জন্য প্রতিবেশ ও পুলিশের পর্যাপ্ত সহযোগিতা থাকে। কার্যত আয়নাবাজও সফল হয়। তার জীবনে প্রেম থাকে। দুঃখবোধ থাকে, মানবিক পীড়ন থাকে। সুখ খোঁজার তুমুল আগ্রহ থাকে। এমন একটি চরিত্রকে একজন অপরাধীর মুখোশে সাফল্যের সঙ্গে মিলিত করার প্রয়াসটিকেই সম্ভবত বলা যাবে ‘ক্যারিশমা’। যা পরিচালক দেখিয়েছেন।
ঠিক এমন মুখোশধারী এর আগে অনিমেষ আইচ এর ‘জিরো ডিগ্রি’ সিনেমাতেও দেখা গেছে। সেখানে এক কাব্যপ্রেমী, কবিকে দেখানো হয়েছে নারীকে পণ্য হিসেবে বিক্রেতার চরিত্রে। লাম্পট্যকে দেখানো হয়েছে সুচারুভাবে। সেও সাফল্যের সঙ্গে কাব্যপ্রেমীর ছদ্মবেশে সমাজের অন্য মানুষের সঙ্গে মিশে থাকে। তার জীবনেরও গভীর বোধ থাকে। অপরাধহীন ধী শক্তি থাকে।
এই মানুুষগুলোর অপরাধ চর্চার কোনো জায়গাকে বিশেষভাবে দেখানো হয় না। এরা সংঘবদ্ধও থাকে না। বিশেষ করে ‘আয়নাবাজি’র আয়না’র কোনো গুরু নেই। নেই কোনো পথ নির্দেশক। শুধুু আছে কাজ জুটিয়ে দেয়া এক দালাল। যে একজন ফটোগ্রাফার। থাকতে পারতো এমন অপরাধের একটি খামার। যেখানে বহু আয়নাবাজ গড়ে তুলছে এক সংঘবদ্ধ চক্র। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ও আয়োজন থাকতে পারতো সেখানে। থাকতে পারতো মেকাপ কক্ষ। সেখান থেকে একেকজন ছদ্মবেশ ধারণ করে বেরুচ্ছে একেকটি বড় বড় কেইস হাতে নিয়ে।
এই চক্রের পরিচালক হয়তো বিরাট আয়নাবাজ। সে হয়তো সমাজের সুপরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত কোনো মানুষ। সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনীতিক অথবা মন্ত্রী। তার সমাজচিন্তা, মানবচিন্তার পাশাপাশি নিখুঁত অপরাধের হাত। চলচ্চিত্র দর্শন পরবর্তী এসব কল্পনা কাজ করেছে। সংযমের সঙ্গেই হয়তো পরিচালক এগুলো এড়িয়ে গিয়ে আলো ফেলতে চেয়েছেন একটি একক চরিত্রের দিকে। আর এই চরিত্রের সঙ্গে একের পর এক ঘটনা গেঁথেছেন একজনের অনুসন্ধানী চোখকে সঙ্গে নিয়ে। সে এক সাংবাদিকের অনুসন্ধানী অভিযান।
দেখা যায়, সংবাদপত্রের উর্দ্ধতন সম্পাদক ‘আয়নাবাজ’ অনুসন্ধানে আগ্রহী নন। তার দৃষ্টিতে এসব বিষয় প্রতিকারবিহীন। সমাজে এমন বিষয়গুলোর শেষ নামানো সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরও সাংবাদিক লেগে থাকেন বিষয়টির পেছনে। গ্রহণ করেন নিজস্ব এক মিশন হিসেবে। শয়নে স্বপনে এই অভিযানটি শেষ করার গভীর ভাবনায় নিমজ্জমান সে। সাংবাদিকের অনিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন নিঃসন্দেহে সিনেমাটিক। একটি মোটর সাইকেল নিয়ে চলে তার অভিযান। রোদ-বৃষ্টি কোনো কিছুই রোধ করতে পারে না তার পথ। আজকের বাস্তবতার সঙ্গে কিছুটা অমিল মনে হলেও এই সাংবাদিকতা অবাস্তব নয়। এটিও ইতিবাচক। অ্যাসাইনমেন্ট ছাড়াই সাংবাদিক যদি একটি ঘটনার পেছনে এভাবে দিনের পর দিন লেগে থেকে সত্য বের করে আনতে পারতো, তাহলে তো আমাদের সমাজে সাংবাদিকদের অবস্থান আরও ওপরেই থাকতে পারতো।
চলচ্চিত্রের শেষে এসে সাংবাদিকই হয়ে উঠেছেন এর কেন্দ্রীয় চরিত্র। দর্শক, হতাশ নেত্রে চেয়ে থাকেন তাহলে কি কারোরই বিচার হবে না? কেউই ধরা পড়বে না? অপরাধীরা তো এক আয়নাবাজকে টাকার বিনিময়ে ব্যবহার করেই আইনী শাস্তি থেকে নিজেদেরকে সাফল্যের সঙ্গে বিরত রেখেছে, এটিই কি আজকের সমাজের চরম সত্য? এখানেই সাংবাদিকের ওপরই সব ভরসা রেখে সিনেমা হল থেকে বেরুতে হয়। শেষ খবরটি পত্রিকায় বেরিয়ে যায়। তার মানে অপরাপর সব খবরই এর সঙ্গে আছে। কান টানলে মাথা আসার মতো অপরাধগুলো আইন-শৃংখলা রক্ষাকারীদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সাংবাদিকতা দারুণভাবে জয়ী হয়। আমরা ইতিবাচক এক তৃপ্তি ও আশা নিয়ে সিনেমা হল থেকে বের হই।
সবদিক দিয়েই ‘আয়নাবাজি’ ভালো একটি বই। তবে চলচ্চিত্র হিসেবে বিনোদনের জায়গাগুলিও অনেক গুুরুত্বপূর্ণ। চলচ্চিত্রে সাংবাদিকের বাসার কাজের ছেলের দুয়েকটি কথা ছাড়া হাসি রসের কোনো জায়গা নেই। একইভাবে নেই গ্ল্যামার উপস্থাপনের বাগাড়ম্বর। কয়েকটি জায়গায় সঙ্গীত আয়োজন, দারুণ নাচের ঝংকার যুক্তিযুক্ত হতে পারতো। অবশ্য, দর্শকের কল্পনাপ্রবণতার সঙ্গে এখন চিত্রকাট্যকাররা এক রকমের ইঁদুর-বিড়াল খেলেন। দর্শক ভাবে এক, আর চলচ্চিত্রের কাহিনী তার ধারে কাছ দিয়েও যায় না। এখানেই ভিন্নমাত্রা বা ব্যতিক্রম স্বাদ।
বহুদিন ধরেই বাংলাদেশে দর্শকপ্রিয়তার শীর্ষে যাচ্ছে ছোট ক্যানভাসের ছবি। বিশাল ক্যানভাসে, চলচ্চিত্রের সবগুলো উপকরণ নিয়ে খেলা করার মতো কাজ হচ্ছে না। এক্ষেত্রে এফডিসিনির্ভর বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রগুলো ব্যতিক্রম। ওরা বড় ক্যানভাসে খেলতে যায় কিন্তু গল্পের দুর্বলতা, পরিবেশনের দৈন্যে তা পুরোপুরি সফল হয় না। আমরা যে একটি সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, তা মনে করিয়ে দিচ্ছে ‘আয়নাবাজি’।
তবে মনে করার কারণ নেই যে, চলচ্চিত্র নির্মাণে আমাদের সফলতা এসে গেছে। মনেই হয়, আমাদের চলচ্চিত্রকারদের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগোতে হয়। সিনেমা হলে দর্শক টেনে আনার চ্যালেঞ্জটি থাকে সবার সামনে। তারপরে পর্যায়ক্রমে থাকে লগ্নি করা পুঁজি দ্রুত তুলে আনার মিশন, থাকে নানামুখি সমাজচিন্তাকে পাশ কাটিয়ে চলচ্চিত্রকে প্রথার মধ্যেই রেখে দেয়ার প্রবণতাও। তুমুল ভাংচুর করার সুযোগ এখনও আসেনি। কারণ ঝুঁকিটা নেবে কে?
আয়নাবাজিতে হাতে গোনা কয়েকটি চরিত্রের খেলা। এর মধ্যে মূল চরিত্র ‘আয়না’ করেছেন চঞ্চল চৌধুরী। অপেক্ষাকৃত কম সিরিয়াস অভিনয়ের ক্ষেত্র থেকে গিয়াস উদ্দিনের সেলিমের মনপুরা সিনেমায় যাকে আমরা সিরিয়াস অভিনয়ে পাই। এ যাত্রায় চূড়ান্ত সাফল্য আসে ‘আয়নাবাজি’তে। এমন একটি চলচ্চিত্র ভাবনার বেশ সফল পরিস্ফুটন ঘটেছে তার অভিনয় দক্ষতায়। বিশ্বব্যাপী বাস্তবাশৃত, আজগুবি, সায়েন্স ফিকশন, অদৃশ্য ভবিতব্য আর কৌতুহলের নানা গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র যেমন হচ্ছে, একইভাবে চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে সমস্ত অঙ্গ কাঠামোকে অস্বীকার করে শুধু দর্শককে সুরসুরি দেবার জন্যও।
এ যাত্রায় সফলতাও আসছে না তা নয়। তবে বাস্তবাশৃত চলচ্চিত্রে মূল চরিত্রের অভিনয় দক্ষতার ভেতর দিয়ে দর্শক অনেক কিছু পান। কল্পনা ও বাস্তবে বোঝাপড়া করতে পারেন ভালোমতো। নায়িকা ‘নাবিলা’ নতুন। তাকে অন্য কোনো সিমেনায় দর্শক সম্ভবত পাননি। গল্পের বুননে, ক্যামেরার গভীর অভিনিবেশে তিনিও ফুটে উঠেছেন অন্য এক মহিমায়। সিনেমায় নায়িকার কাছ থেকে দর্শক যতখানি চান, এখানে নায়িকার ভাগে ততখানি খোলামেলা হওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি। এখানে পরিচালকের চিন্তার রক্ষণশীলতা নয়, বরং ব্যতিক্রম উপস্থাপনার সাহস দেখাতে হয়েছে। চলচ্চিত্রে যেখানে শরীর দেখানোকে আমরা ‘সাহস’ বলছি, সেখানে এই বিপরীতটা তো দুঃসাহস। সেই দুঃসাহসে সাফল্য আর্জনও তো অনেক বড় কথা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)