চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আলাদা একটি দিবস কেন নয়?

নারীদের প্রতি সম্মান জানানোর আলাদা একটি দিন কেন?- বেশ কয়েক বছর ধরেই এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে নারীদের। সহকর্মী, বন্ধুদের অনেকেই  বলেন, এটা  কি দেখানোর মতো কোনো বিষয়?

উত্তরটা যে তারা জানেন না, তাও না। তবুও প্রশ্ন তোলেন। প্রশ্ন তোলাই এই সমাজ ব্যবস্থার প্রথম কাজ। বিশেষ করে নারী সংক্রান্ত যে কোনো ইস্যু আর প্রশ্ন এ সমাজে সমার্থক শব্দ। দিবস পালন, যোগ্যতা, ন্যায্য মজুরিসহ আরো কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ করেছিলাম দেশের স্বনামখ্যাত বেশ কয়েকজনের সঙ্গে।

উদিসা ইসলাম: ঘটা করে দিবস পালনের একটা বড় উদ্দেশ্য হলো যে, নারীদের জন্য যে সামাজিক বাধা আছে, তা কাটানো। একদিনে তো আর হবে না, কিন্তু দিবস উপলক্ষে আয়োজনগুলো সমাজের মনোভাবটাকে কিছুটা হলেও পাল্টানো সম্ভব বলে মনে করেন সাংবাদিক উদিসা ইসলাম।

বাংলা ট্রিবিউনে জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করা উদিসা মনে করেন, অবশ্যই বাকীদিনগুলোতে এজন্য কাজ করতে হবে।

তিনি বলেন, অন্তত আমাদের সমাজ জানুক, নারীরা এগিয়ে আসার সুযোগ, সহযোগিতাটা চাইছেন। একই সঙ্গে নারীদের পদে পদে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। ফলে যতোটুকু সে অর্জন করছে, সে অর্জনটুকুকেও কোনোভাবেই  জাস্টিফাইড করতে চায় না। যেকারণে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মানুষেরা এই কনক্লুশনে পৌঁছান যে, নারীরা আসলে সুযোগ সন্ধানী।

পাশাপাশি যোগ্যতা অনুযায়ী নারীরা পারিশ্রমিক পান বলেও মনে করেন, জ্যেষ্ঠ এ সাংবাদিক। তিনি বলেন, সস্তা শ্রমিক হিসেবেই নারীদের নিয়োগ দেয়া হয় এখনও। এখনও এই মানসিকতার ঊর্ধ্বে আমরা উঠতে পারিনি।

শোষণ, নির্যাতন এবং অপরাধের সঙ্গে নারীদের সংশ্লিষ্টতা নিয়েও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা কাজ করে বলে জানান উদিসা। তিনি বলেন, কেবলি নারী  হওয়ার কারণে গণমাধ্যমেও এধরণের খবর বেশ ফলাও করে প্রচার হয়। কখনো কখনো আরো রঙ্গীন করে প্রচার করা হয়। কারণ আমাদের সমাজব্যবস্থা তার নিজের স্বার্থে নারীকে এখনও কোমল ভাবতে ভালোবাসে। তাই আগামীর নারীদের জন্য যোগ্যতাকে সম্মান করা এবং সে যোগ্যতা অনুসারে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান  তিনি।

তাসলিমা সুলতানা নিশাত: নারী ক্ষমতায়ন যতটুকু হওয়ার কথা ছিলো ততোটুকু হয়নি বলে মনে করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান তাসলিমা সুলতানা নিশাত। তিনি মনে করেন, আধুনিকতাকে অনেকে ক্ষমতায়ন মনে করে। তারা জানেন না, সত্যিকার অর্থে ক্ষমতায়নের মানে কি। তিনি বলেন, ক্ষমতায়ন হলো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা, মতামত দেয়ার স্বাধীনতা।

সহকর্মী, সহপাঠীদের দৃষ্টিতে সম্মান অর্জন, তারা একজন নারীকে দেখলে কি বলে, কিভাবে বলে তার মাপকাঠিকে ক্ষমতায়ন মনে করেন। তাদের মানসিকতার পরিবর্তন না হলে এসবের কোনো মানে নেই বলে মনে করেন তৃণমূলের এই নেত্রী। 

তবে রাজনীতিতে নারীদের অবস্থান এবং অংশগ্রহণ আগের চেয়ে ভালো বলে জানান তিনি। তাসলিমা মনে করেন, এই অবস্থান আরো ভালো করতে হবে। তৃণমূলে ভোট দেয়ার ক্ষেত্রেও নারী প্রার্থীকে ভোটাররা যোগ্য ভাবেন না জানিয়ে তিনি বলেন, এই যোগ্যতার প্রমাণ নারীদের দিতে হয়। এজন্য উপযুক্ত পরিবেশ দরকার। সেই পরিবেশটা এখনো তৃণমূলের নারীরা পাননা বলেও মনে করেন তিনি। এই পরিবেশ তৈরিতে সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

আঙ্গুর নাহার মন্টি: বিভিন্ন পেশায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন নিউজ টুয়েন্টিফোর এর যুগ্ম বার্তা সম্পাদক আঙ্গুর নাহার মন্টি। একই সঙ্গে তিনি বলেন, মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়লেও নারীদের জন্য ন্যায্য মজুরি  নিশ্চিত হয়নি এখনো।  এর কারণ হিসেবে তিনি ট্রাডিশনকে দায়ী করলেন। বললেন, নারীদের কম মজুরি দিতে অভ্যস্ত মালিকরা।

বলেন, গার্মেন্টস এর শ্রমিকের বিষয়টি আমরা জানি, তারা কম পান, তা নিয়ে আন্দোলনও করেন। এরা ছাড়া আর কোন কোন খাতের নারীর মজুরী বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তা এখন চিহ্নিত করতে হবে। কেন কম পাচ্ছেন-তাও খুঁজে বের করার সময় এখন এসেছে বলে মনে করেন আঙ্গুর নাহার মন্টি।

তাসলিমা মিজি: উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করা নারীদের জন্য এখন বেশ কঠিন বলে মনে করেন  নারী উদ্যোক্তা তাসলিমা মিজি। তিনি বলেন, ব্যবসাক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত অসম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয়। অনেকে এখনো ট্র্যাকেই উঠতে পারছেন না বলে জানান তিনি। সমাজ ব্যবস্থা নামক জগদ্দল পাথরের বাধাগুলো এতো বেশি যে, তা  পেরিয়ে ব্যবসায়িক সাফল্য ধরে রাখা আসলে অনেক কঠিন জানিয়ে মিজি বলেন, অনেক  বাধা আছে, যেগুলো দেখানো যায় না, বোঝানো যায় না।

বলেন, নির্যাতন, শোষণ ও বৈষম্যমূলক যে সমাজ ব্যবস্থায় একজন নারী যখন ছোটবেলা থেকেই ‘ছাড়’ দেয়ার মানসিকতা নিয়ে বড় হয়, তখন তাকে আসলে ব্যবসা হয় না। যারা এর মধ্যেও সফল হন, তারা অনেক লড়াই করেই যে সফল-তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

দিন দিন নতুন নতুন বাধাও তৈরি হচ্ছে জানিয়ে তাসলিমা মিজি বলেন, ব্যবসা এতোদিন একচেটিয়াভাবে পুরুষেরই দখলে ছিলো, এখনো আছে। সেখানে নারীদের জায়গা ছেড়ে দেয়ার মানসিকতা সকলের সমান না। এজন্য আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে নারীদের।

পড়াশুনা তো বটেই, পাশাপাশি নিজের মানসিকতাকে অনেক বেশি দৃঢ় করে তারপর ব্যবসায় নামার পরামর্শ দেন বিদগ্ধ এ উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, নারীকে ‘না’ কে ‘হ্যাঁ করার মনোবল নিয়েই বাণিজ্যে নামতে হবে, নচেৎ নয়।

সুলতানা রহমান: ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর সুলতানা রহমান। তিনি মনে করেন, সামাজিক কাঠামোর  মধ্যে থেকেও যখন কোন নারী নিজস্ব পরিচয় তৈরি করতে পারেন, তখন ওই একই সমাজ তাকে অন্য চোখে দেখে। তাকে কিছুটা সমীহ করে। তার মতের মূল্য দেয়। নারীদেরকে এই পরিচয়টাই তৈরি করতে হবে।

একই সঙ্গে যেকোন পেশায় নারীদের ঝুঁকি আছে বলেও মনে করেন তিনি।  কিছুটা বাড়তি সুবিধাও মেয়েরা পান বলে জানিয়ে সুলতানা রহমান বলেন, যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় ছেলে-মেয়ে দুজনকেই। বলেন, প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানের কাঠামোটাতে স্ট্রাকচারটা পিরামিড। যতো উপরের দিকে যাবেন, ততো নারীদের জন্য পজিশনগুলো কম থাকবে-এটা স্বাভাবিক।

তাই প্রতিযোগিতাটাও বেশ বন্ধুর। এক্ষেত্রে মেয়েদের কৌশলী হতে হয়। বিচক্ষণার পরিচয় দিতে হয়। টিকে থাকতে পারতে হয়। ধৈর্য থাকতে হয়, ডেডিকেশন রাখতে হয়। অর্জন করতে হয় যোগ্যতা। চেষ্টা করলে নারীরা যে পারে, তার বহু প্রমাণ আমাদের বর্তমান সমাজে আছে বলে জানান তিনি।

সমাজ এখনো নারী নেতৃত্ব কতখানি মেনে নেয়ার জন্য তৈরি তা নিয়ে কিছুটা সন্দেহ প্রকাশ করে সুলতানা রহমান বলেন, যোগ্য পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না মেয়েরা। সংসারের প্রধান বিবেচনায় রেখেই পুরুষদের মজুরি নির্ধারণ করা হয়, অন্যদিকে, মেয়েদের বেলায় তা ভাবা হয় না বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, এই চিন্তায় পরিবর্তন আনার সময় এসেছে। এজন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এতো গেলো বিভিন্ন পেশাজীবীদের কথা।

আমি এবারে পাঠকদের জন্য স্মরণ করিয়ে দেবো ঠিক কবে থেকে, কি কারণে নারী দিবস পালনের  প্রচলনটা শুরু হয়েছিলো?

১৮৫৭ সালের কথা। মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমে এসেছিলেন সুতা কারখানার শত শত নারী শ্রমিক। নারীদের এই প্রতিবাদ ঠেকাতে মিছিলে নির্যাতন, দমনপীড়ন চালিয়েছিলেন মার্কিন সরকারের আজ্ঞাবাহী সৈন্যরা। এটিই ছিলো অধিকার আদায়ে নারীদের  প্রথম প্রতিবাদ।

এর অর্ধশত বছর পরে ১৯১০ সালে নারীনেত্রী ক্লারা জেটকিন, ডেনমার্কের কোপেন হেগেনে ঘোষণা দেন নারী দিবস উদযাপনের। এরপর থেকে নারীর অধিকারের দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে  আন্তর্জাতিক নারী দিবস।

ক্লারা জেটকিন, ১৮৫৭ সালের ৫ই মে জার্মানের স্যাক্রোনি প্রদেশের ওয়াইডোরায়ুতে জন্ম নেয়া দারুণ প্রতিবাদী এক নারী। সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে রাজনীতিকেই বেছে নিয়েছিলেন বিপ্লবী  ক্লারা। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহাগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের জন্য প্রস্তাব করেন।

সিদ্ধান্ত হয়, ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে নারীদের সমঅধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। অবশেষে ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। এরপর থেকেই নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে সারা পৃথিবী জুড়েই দিবসটি পালিত হচ্ছে ।

১৮৫৭ সালে শুরু হওয়া এ আন্দোলনের ফসল নারীদের মতো করে পেতে আরো কত যুগ অপেক্ষা করতে হবে, আর কত দিবস, আর কত আন্দোলনের পর নারীরা ফিরে পাবে তার যোগ্য সম্মান, যোগ্য স্থান, তার কোনো হিসেব হয়তো এই মুহুর্তে মেলানো যাবে না। তবে দিন যে বদলেছে, বদলাচ্ছে তা তো ঠিকই। দ্রুত নারীদের জন্য বাসযোগ্য একটি বিশ্ব গড়ে উঠুক, নির্ভয় হোক নারীদের পথচলা, আনন্দের হোক বেঁচে থাকা-এমন প্রত্যাশা তো করতেই পারি।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)