চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আমেরিকান পরিচয়: ধারণা নির্ভর, নৃতাত্ত্বিক নয়

অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমেরিকার প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমেরিকানরা নিজেদেরকে বর্ণ, ধর্ম কিংবা জাতিগত পরিচয় দিয়ে নয় বরং তাদের মিলিত মূল্যবোধ ও ব্যক্তি স্বাধীনতার বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে নিজেদের সংজ্ঞায়িত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র আদমশুমারি ব্যুরো-র এক হিসাব অনুযায়ী নিউইয়র্ক মেট্রোপলিটন এলাকায় বসবাসরত মানুষের ২৮.২ শতাংশই জন্ম গ্রহণ করেছে অন্য দেশে।

আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র ছয় বছর পর ১৭৮২ সালে বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন আমেরিকাতে এসে বসবাসের ইচ্ছাপোষণকারীদেরকে কিছু নির্দিষ্ট তথ্য জানান দেন। যে সকল বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ইতিহাসকে ছাপিয়ে উঠেছেন, যাদেরকে আমেরিকানরা নিজেদের ‘প্রতিষ্ঠাতা জনক’ হিসেবে জেনে এসেছে, তাদের মধ্যে বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন ছিলেন সবচেয়ে বেশি আমেরিকান। জর্জ ওয়াশিংটন ছিলেন মহামহিম, থমাস জেফারসন ছিলেন বইয়ের পোকা আর জন অ্যাডাম্স ছিলেন জেদি। তাদের পাশে ফ্র্যাঙ্কলিনই ছিলেন বাস্তববাদী উদ্ভাবক, সুদক্ষ ব্যবসায়ী এবং নাগরিক জীবনে প্রভাব বিস্তারে সদাব্যস্ত। তিনিই সবচাইতে ভালোভাবে বুঝেছিলেন যে তার দেশের জনগণ আসলে উদ্যমী। ইতিহাসবিদ ওয়াল্টার ম্যাকডুগাল পরে এই জাতিকে এ নামেই আখ্যায়িত করেন। এরকমই একটি ভূমিতে ফ্র্যাঙ্কলিন ভবিষ্যত অভিবাসীদের নির্দেশ দেন এই বলে:‘মানুষ একজন আগন্তুকের কাছে জানতে চায় না, সে কে? তার বংশ পরিচয় কি? বরং তারা জানতে চায় সে কি করতে পারে। এবং তার এমন কোনো দক্ষতা আছে কিনা যার উপযোগিতা আছে- আর তাহলেই তাকে স্বাগত জানানো হবে। আর সে যদি তার সেই দক্ষতা কাজে লাগায়, ভালো আচরণ করে, তাহলে সে সবার সম্মানের পাত্রে পরিণত হবে।’

ফ্র্যাঙ্কলিন তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই এই মন্তব্য করেন। তার নিজ আবাসভূমি পেনিসেলভেনিয়াতে সেই ১৭৫০ সাল থেকেই জার্মান অভিবাসীদের সংখ্যা ইংরেজদের ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। নবাগতদের সকলেই পরিশ্রমী ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হিসেবে পরিচিত ছিলো। এই দক্ষ কৃষকরা সেখানকার জমির মানের উন্নয়ন ঘটায় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। ১৭৯০ সালে কংগ্রেস যখন প্রথমবারের মতো নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য জাতীয় মানদণ্ড নির্ধারণ করে, তখন এতে নাগরিকত্ব লাভ করতে কোনো জাতিগত বা ধর্মের পরীক্ষা দিতে হতো না, কোনো প্রকার শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হতো না কিংবা সম্পদের মালিকানাও থাকতে হতো না। নাগরিকত্ব লাভের জন্য যা প্রয়োজন পড়তো তা হলো দুই বছর যাবত বসবাস করা, সৎ চরিত্র এবং সংবিধান সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার। ফ্র্যাঙ্কলিনের মতে আমেরিকান সত্ত্বার ভিত্তি ছিল লোকেদের কার্যক্রম ও আচার-আচরণ, তাদের জাতি, ধর্ম কিংবা বংশ পরিচয় নয়। সাংস্কৃতিক পণ্ডিত মার্ক প্যাকটার যেমন বলেছেন যে এই জাতিতে অন্তর্ভুক্ত হবার জন্য দরকার ছিল আমেরিকান হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া।

আমেরিকান জনগোষ্ঠীর এই পরিচয়টি জাতি, ধর্ম ও বংশ পরিচয়ের ভেদাভেদ নির্বিশেষে একটি বহুতাত্বিক ধারণাকে আলিঙ্গন করে। ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি এবং সীমিত ও নির্দিষ্ট ক্ষমতাধারী একটি প্রতিনিধিত্বকারী সরকার যা এই ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সম্মান করবে তার প্রতিও এই জনগোষ্ঠীয় পরিচয়ে একটি দৃঢ় নাগরিক অঙ্গীকার নিবদ্ধ রয়েছে।

সালাদের বাটি নাকি আত্তীকৃত হওয়ার স্থান?

আমেরিকান প্রতিচ্ছবিতে সর্বদাই বহুত্ববাদিতা ও আত্তীকরণের মধ্যে একটি সৃষ্টিশীল টানাপোড়েন রয়েছে। একদিকে, অভিবাসীরা নিজেদের আমেরিকান ধারণার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে বলে আশা করা হয়। এই আত্তীকরণের ধারণাটি ১৯০৮ সালে ইসরায়েল জ্যাংউইল রচিত ‘দ্য মেল্টিং পট’ মঞ্চনাটকে জনপ্রিয় হয়। সেই নাটকের একটি চরিত্র বলে, ‘আমেরিকা সৃষ্টিকর্তার সব এক করে তোলবার স্থান। এটি হচ্ছে আত্তীকরণের একটি শ্রেষ্ঠ স্থান যেখানে ইউরোপের সকল জাতি এক হয়ে যাচ্ছে। জার্মান ও ফরাসীরা, আইরিশ ও ইংরেজরা, ইহুদি ও রাশিয়ানরা- সবাই এখানে আসছে এবং সৃষ্টিকর্তা তাদেরকে আমেরিকান হিসেবে তৈরি করছে।’

জ্যাংউইলের এই মতবাদ নতুন কিছুই নয়। জে. হেক্টর সেন্ট জন দ্য ক্রেভ্কোর ছিলেন একজন ফরাসী অভিবাসী ও আমেরিকান জীবনযাত্রার একজন বিচক্ষণ পর্যবেক্ষক। তিনি ১৭৮২ নিজের নতুন সঙ্গীদের বর্ণনা দেন এভাবেই: ‘ইংরেজ, স্কট, আইরিশ, ফরাসী, ডাচ, জার্মান ও সুয়েডদের সংমিশ্রণ। তাহলে এই নতুন মানুষ, এই আমেরিকান কি? সে ইউরোপীয়ো না, অথবা ইউরোপীয়ো বংশোদ্ভূতও না। এজন্যই তার রক্তের অদ্ভুত মিশ্রণটি অন্য কোনো দেশে পাওয়া যাবে না। আমি এমন একটি পরিবার দেখাতে পারি যেখানে দাদা ছিলেন একজন ইংরেজ, তার স্ত্রী ছিলেন ডাচ, তাদের ছেলে বিয়ে করে একজন ফরাসী নারীকে এবং তার চার পুত্রের প্রত্যেকের স্ত্রী ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্র থেকে আগত। এই হচ্ছে একজন আমেরিকান, যিনি নিজের থেকে ঝেড়ে ফেলেছেন পুরনো সব সংস্কার এবং আচার আচরণ’

এই আত্তীকৃত স্থানটি সর্বদাই একটি প্রতিযোগী আদর্শের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলেছে। এই আদর্শে প্রত্যেক অভিবাসী জনগোষ্ঠী তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে আমেরিকান পরিচয়কে আরো সমৃদ্ধ করেছে।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও সহনশীলতা

আমেরিকান সত্ত্বা সব ধরনের মানুষকে আলিঙ্গন করলেও এসব মানুষ যাতে নিজেদের নতুন করে তৈরি করতে পারে সেটার জন্যও অসংখ্য সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়।যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধানের প্রথম ধারাটি কোনো ব্যক্তিকে তার মর্যাদার স্মারক হিসেবে কোনো উপাধি প্রদান করা থেকে সরকারকে বিরত করেছে। আর যারা নিজ সঙ্গী আমেরিকানদের সঙ্গে দাম্ভিক আচরণ করা শুরু করে তারা সাধারণত এই দম্ভের জন্য অপমানিত কিংবা আরো নিকৃষ্ট কোনো ফলাফল ভোগ করে।

যে নারী বা পুরুষ নিজের চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আমেরিকানরা তাদের সম্মান করে। বিশেষ করে তাদের যাদেরকে সফলতা অর্জনের পথে অনেক বাধা-বিপত্তি পার হতে হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তি নিজেই নিজের সাফল্যকে সংজ্ঞায়িত করে।

আমেরিকানরা ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী, ভিন্ন ভিন্ন জীবনধারাকে আলিঙ্গন করে এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর জোর দেয়। তবে, এসবই তারা করে পরস্পরের প্রতি এক অনন্য সহনশীলতা বজায় রেখে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সরকারি হস্তক্ষেপ থেকে সকল আমেরিকানদের সুরক্ষিত করার নিশ্চয়তাগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুমোদন হওয়ার পর পরই আমেরিকানরা নাগরিক অধিকার বিলের দাবি তোলে এবং সেটা অনুমোদিত হয়। এই ‘বিল অব রাইট্স’ সংবিধানের ১০টি সংশোধনীর সংকলন যেগুলো নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করে।

একজন আদর্শ আমেরিকানের নির্দিষ্ট কোনো প্রতিচ্ছবি নেই। সাদা পরচুলা পরিহিত জাতির জনকদের থেকে আরম্ভ করে বহুজাতিক গলফ চ্যাম্পিয়ন টাইগার উড্স পর্যন্ত সকল আমেরিকানের সম্মিলিত সত্ত্বার ভিত্তি হলো একটি বিষয়- আর তা হলো স্বাধীনতা, যা অন্যদের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা সদা বজায় রাখবে এবং নিজ ইচ্ছা অনুসারে জীবন যাপন করবে। এর ফলাফলগুলো অনেককে হতবুদ্ধি করে তুলবে, অনেকের কৌতূহল উদ্রেক করবে এবং অনেককে অনুপ্রেরণা যোগাবে। ওয়াল্ট উইটম্যান নিজ জাতি সম্বন্ধে লেখেন, ‘আমি বিশাল, আমার রয়েছে বহুজাতিক জনগোষ্ঠী।’

লেখক: যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতরের আন্তর্জাতিক তথ্য কর্মসূচি ব্যুরোর ইতিহাসবিদ ও লেখক

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)