ড. নুর মোহাম্মদ তালুকদার: আমার লেখার অভ্যাস নেই একেবারেই। কেউ কিছু লিখতে বললে কৌশলে এড়িয়ে যাই। অজয় রায়- আমাদের অজয় দা’র উপর একটি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তার ৮৯ তম জন্মবার্ষিকীতে তা প্রকাশিত হবে। এজন্য কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে লেখা সংগ্রহের দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন উদ্যোক্তাগণ। আমাকেও একটা কিছু লেখার জন্য তারা বলেছেন। কারণ তার দীর্ঘদিনের পরিচিত ব্যক্তি যারা এখনও বেঁচে আছেন তাদের একজন আমি। তাই এ লেখার প্রয়াস। অজয় দা’র অনুপস্থিতির এক বছরে আজ অনুধাবন করতে পারি কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন আমাদের প্রিয় অজয় দা।
সাক্ষাৎ না হলেও অজয় রায় নামের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৬৩ সালে। ময়মনসিংহ শহরের অদূরে অবস্থিত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি কৃষি অনুষদের ছাত্র। তিনি তখন কারাবন্দী। ময়মনসিংহে নতুন এসেছি। ঢাকা থেকে আগেই খোঁজ খবর নিয়ে গিয়েছিলাম কার কার সাথে যোগাযোগ করতে হবে ছাত্র ইউনিয়নের কাজ-কর্ম ও সংগঠন করতে। আইয়ুব খার মার্শাল ল’। এরই মধ্যে ১৯৬২ সালে কুখ্যাত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে দেশব্যাপী এক সফল আন্দোলন হয়ে গেছে। রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনের কাজ-কর্ম নিষিদ্ধ। গোপনে ছাত্র সংগঠনের কাজ করতে হত। দেশে তখন ৩/৪টি ছাত্র সংগঠনের অস্তিত্ত্ব থাকলেও মূলতঃ ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নই ছিল প্রধান ছাত্র সংগঠন। কেন্দ্র ও জেলা পর্যায়ে সকল রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বস্থানীয় প্রায় সকলেই হয়তো জেলে নয়তো হুলিয়া মাথায় নিয়ে গোপনে কাজ-কর্ম ও আন্দোলন সংগঠিত করতেন। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনে বেত্রাঘাতে শ্রবণ শক্তি হারানো ন্যাপ নেতা কাজি আব্দুল বারীর ছোট ভাই আমার সহপাঠী কাজি আব্দুল মোতালিব (প্রয়াত) আমাকে নিয়ে যায় কাজি বারীর গোপন আস্তানায়। সন্ধ্যায় আরও কয়েকজন ছাত্র নেতার আগমন ঘটে সেখানে। ওখানেই উচ্চারিত হয় অজয় রায় সহ আরও অনেক ব্যক্তির নাম।
আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ১৯৬৩ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে মৌলিক গণতন্ত্র ঘোষণা করে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিল করে। ১৯৬৫ সালে অজয় দা মুক্তি লাভ করেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই পাক-ভারত যুদ্ধ বেঁধে গেলে তিনি আবারও কারারুদ্ধ হন। ১৯৬৫-৬৯ পর্যন্ত একের পর এক আন্দোলন চলতে থাকে। ১৯৬৯ সাল গণঅভ্যুত্থানের বছর। গণদাবির মুখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দেয়া হয়, অজয় দাও এই সময় মুক্তি লাভ করেন। আইয়ুব খানকে অপসরণ করে সেনা প্রধান ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা গ্রহণ করে।
অজয় দা জেল থেকে বের হয়েই দ্রুততার সাথে শ্রমিক-কৃষক ও ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের কমিউনিস্ট পার্টিতে সংগঠিত করার কাজে মনোনিবেশ করেন। গড়ে তোলেন বিভিন্ন পার্টি গ্রুপ। ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃস্থানীয় ৪জন কর্মীকে নিয়ে একটি গ্রুপ গঠন করেছিলেন যার আমিও একজন সদস্য ছিলাম। আমি তখন ময়মনসিংহ জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি। অন্য ৩ জন হলেন মকবুল হোসেন (প্রয়াত) ছাত্র ইউনিয়নের জেলা সাধারণ সম্পাদক, নজরুল ইসলাম সহ-সাধারণ সম্পাদক ও ফারুখ আনোয়ার (প্রয়াত) প্রাক্তন সভাপতি। অজয় দা আমাদের একটি রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রশিক্ষনের স্থান নির্বাচন করা হয়েছিল নিভৃতে। জামালপুর জেলার মেলন্দাহ উপজেলার কাপাস হটিয়া গ্রামে বৃটিশ আমলের কংগ্রেস নেতা মহত্মা গান্ধীর অনুসারী নাসির সরকারের বাড়িতে। তখন ছিল বর্ষাকাল- বাড়ির চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। ঐ প্রশিক্ষণে অজয় দা দৈনিক ১২-১৪ ঘন্টা মানবজাতি তথা সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ এবং মার্কসবাদ ও অর্থনীতির উপর খুব সহজ ও সাবলীল ভাবে আলোচনা করতেন এখনও মনে হয় অজয় দা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয়ের শিক্ষক হতেন তা হলে অনেক বেশী অবদান রাখতে পারতেন। কিছুদিন আগে ঐ বাড়িতে গিয়েছিলাম একটা অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে। যে ঘরে অজয় দা আমাদের ক্লাশ নিতেন সেটি এখন গান্ধী আশ্রম। এর পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে ‘মুক্তি সংগ্রাম যাদুঘর’ যার উদ্যোক্তা ঐ নাসির সরকার সাহেবেরই সুযোগ্য তিন নাতি দোদুল, কল্লোল ও হিল্লোল। এরা ন্যাপ নেতা প্রয়াত মোয়াজ্জেম সাহেবের সন্তান। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী ও দর্শকের আগমণ ঘটে এই আশ্রম ও যাদুঘর দর্শনে। যাদুঘরটিতে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। যে টেবিলে অজয় দা আমাদের ক্লাশ নিতেন সেটি এখন ঐ যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
গণঅভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে অজয় দা মুক্তিলাভ করলেও বেশিদিন মুক্ত জীবন-যাপন করা হয়নি তার। ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন জারির কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আবার গ্রেফতার হন। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর ২৮ মার্চ ময়মনসিংহের ছাত্র-শ্রমিক জনতা জেলখানা থেকে অজয় দা এবং অন্যান্য বন্দীদের মুক্ত করে আনে। এই সময় ময়মনসিংহ শহরে উল্লেখযোগ্য একটা ঘটনা সংঘটিত হয়; তা হল বিহারি-বাঙালি দাঙ্গা। দুষ্কৃতিকারী সুযোগ সন্ধানীরা এ সময় বিহারীদের বাড়ি-ঘরে লুটপাট অগ্নিসংযোগ করে। পরিস্থিতি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আওয়ামী লীগের পক্ষ হতে বিদ্যাময়ী স্কুলে এবং ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ হতে মহাখালী গালর্স স্কুলে কন্ট্রোল রুম খুলে পরিস্থিতি শান্ত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। অজয় দা এতে মূখ্য ভূমিকা রাখেন। ১৭ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী ময়মনসিংহ শহরে প্রবেশের পূর্বক্ষণে আমরা ময়মনসিংহ শহর ত্যাগ করি। আওয়ামী লীগ আগেই কন্ট্রোল রুম বন্ধ করে দেয়। এপ্রিলের শুরুতেই কমিউনিস্ট পার্টিও ময়মনসিংহ জেলা কমিটির সেক্রেটারি জ্যোতিষ বসু এবং জেলা ন্যাপ সভাপতি জনাব আলতাব আলী ভারতের মেঘালয় রাজ্যের উদ্দেশ্যে তুরা জেলার বারেঙ্গা পাড়ায় গিয়ে শরণার্থীদের আশ্রয়ের এবং ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের ক্যাম্প স্থাপনের কাজ শুরু করেন। আমাদের কয়েকজন অজয় দা’র নেতৃত্বে প্রথমে কিশোরগঞ্জ হয়ে ভারতের আগরতলা ও পরে কোলকাতা হয়ে বারেঙ্গা পাড়া আসেন। আর আমি, প্রদীপ চক্রবর্তী ও শফিকুল ইসলাম ন্যাপের জেলা সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আজিজুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে নেত্রকোনা হয়ে মেঘালয়ে গমন করি এবং ক্যাম্পে অবস্থান করি। এখানে উল্লেখ্যযোগ্য এই যে অজয় দা এবার জেল থেকে মুক্তি লাভের পর জয়ন্তী রায় (পাল) কে বিবাহ করেন এবং নব বধুকে সঙ্গে নিয়েই ভারতে যান।
অজয় দা’র জন্ম ১৯২৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর মাতামহের কর্মস্থল ময়মনসিংহ জেলা ঈশ্বরগঞ্জে। ১৯৩৭ সালে ভারতের যুক্ত প্রদেশের বারাণাসীতে ৪র্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং ১৯৪৩ সালে এ্যাংলো বেঙ্গলী ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে মেট্রিক পাশ করেন অজয় দা। তার পিতা ড. প্রমথ নাথ রায় তখন বারাণাসী বিশ্বিবিদ্যালয়ে বিদেশী ভাষার অধ্যাপক। ১৯৪৪ সালে তার পিতা মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি বারাণাসী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইএসসি পাশ করেন এবং ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মাসী বিভাগে স্নাতক ক্লাশে ভর্তি হন। পিতৃ বিয়োগের এক বৎসরের মধ্যে তার মাতৃ বিয়োগ ঘটে। ফলে শিক্ষা জীবনের সাময়িক ছেদ ঘটিয়ে ছোট ৪ ভাই-বোন নিয়ে চলে আসেন পিত্রালয় কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি থানার বনগ্রামে। ভাই-বোনদের মধ্যে অজয় দা ছিলেন জ্যেষ্ঠতম। পিতামহ-মাতামহের তত্ত্বাবধানে ছোট ভাই-বোনদের পড়ালেখার ব্যবস্থা করে তিনি ভর্তি হন মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে। সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন বি, কম পরীক্ষা দিয়ে ১ম বিভাগে ১ম স্থান অধিকার করে উত্তীর্ণ হন।
হরগঙ্গা কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ঐ কলেজে এবং পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন স্কুলে কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠনের শাখা গঠনে সচেষ্ট হন। ঐ সময়ে তিনি ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সাব কমিটির সদস্য এবং ছাত্র ফেডারেশনের জেলা সম্মেলনে ঢাকা জেলা কমিটির অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন, যে কমিটির সভাপতি ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবি অধ্যাপক মুনির চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক দেব প্রসাদ মুখোপাধ্যায়। অজয় দা ১৯৪৮ সালে ছাত্রাবস্থাতেই কারাজীবনের স্বাদ গ্রহণ করেন। ভারত বিভক্তির পর পাক আমলে স্বৈরচারী আয়ুব-বিরোধী আন্দোলন, ৬ দফা, ১১ দফা আন্দোলন ও সর্বশেষ ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখার কারণে নিগৃহীত হয়েছেন বারবার; জেল খেটেছেন ১৫ বছর হুলিয়া, গ্রেফতারি পারোয়ানা মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে কাটিয়েছেন ১২ বছর। মূলতঃ পুরো পাকিস্তানি আমল তার কেটেছে জেলে। অজয় দা মুক্ত পরিবেশে অথবা আত্মগোপনে শিক্ষা জীবন শেষ করতে পারেন নাই; কারাবন্দী জীবনেই প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন ১৯৬৫ সালে। অজয় দা কারামুক্তি পেলেই সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছেন কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজে। তার পার্টি কার্যক্রম ছিল মূলতঃ টাঙ্গাইলসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা। আত্মগোপন অবস্থাতেই তিনি ময়মনসিংহ জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হলে স্থায়ীভাবে চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকায় এসে অল্প দিনের মধ্যেই রাজনীতিক অঙ্গনের বাইরে নিজের আসন করে নেন দেশের বুদ্ধিজীবি মহলে সমাজের একজন অগ্রণী মানুষ হিসেবে।
অজয় দা রেখে গেছেন অনন্য অবদান সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে। সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি বিষয়ে তিনি ১৮টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। বাঙলা ও বাঙালি বাংলাদেশের অর্থনীতির অতীত ও বর্তমান, বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থার সংকট ও সমাধান, বাংলার কৃষক বিদ্রোহ, শিক্ষাবিশীর হাতে খড়ি, রাজনীতির অ, আ, ক, খ, পূঁজিবাদী অর্থনীতি, গণআন্দোলনের একদশক, আমাদের জাতীয় বিকাশের ধারা, বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলন (১৯৪৭-৭১), সাম্প্রতিক, ছোটদের হোচিমিন, সত্যেন সেন, বীরকন্যা প্রীতিলতা, তীরের অন্বেষায়, তীরের অন্বেষায়-স্বাধীন বাংলাদেশ। তার লেখা সর্বশেষ গ্রন্থটি হল ‘বাঙালি মানস-সংশ্লেষণ ধর্মিতা ও সাম্প্রদায়িকতার জের এবং বিবিধি প্রসঙ্গ। এই বইটির ভূমিকা লিখেছেন যখন তিনি হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন শেষবার অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্য বিঘ্নিত করার জন্য বিএনপি- জামাত দেশে-বিদেশে নতুনভাবে ষড়যন্ত্র শুরু করলে অজয় দা নিজের গড়া প্রতিষ্ঠান সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ বিরোধী মঞ্চের মাধ্যমে দেশব্যাপী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বিচারের রায় দ্রুত সম্পন্ন করার আন্দোলন পরিচালনা করেন এবং সারাদেশ থেকে এক লক্ষ লোকের সাক্ষর সম্বলিত পোস্ট কার্ড মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর প্রেরণ করার ব্যবস্থা করেন যা ওই আন্দোলনকে এক নতুন মাত্রা যোগায়।
শেষবার অসুস্থ হওয়ার আগে বর্তমান সরকার প্রণীত এবং জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখে অজয় দা অস্বস্তিতে ভুগছিলেন। বৈষম্যহীন, বিজ্ঞান মনস্ক, অসাম্প্রদায়িক, সর্বজনীন তথা শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের প্রয়োজন অনুভব করেন এবং দেশব্যাপী এজন্য প্রচারনাভিযান পরিচালনা করেন তার প্রতিষ্ঠিত আর একটি সামাজিক সংগঠন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে। এই দাবিতে সারাদেশ থেকে লক্ষাধিক স্বাক্ষর সম্বলিত একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার বরাবর। সমাজ সভ্যতার বিকাশ ও জাতীয় মুক্তির যে প্রেরণা ও কর্মতাগিদ তার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল কৈশরে তার ছেদ বা ক্লান্তি দেখিনি কখনও। সেই কৈশর থেকে শুরু করে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সোভিয়েত তথা সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিপর্যয়ে তিনি থমকে গেলেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের শিখরে উঠেও নতুন পরিস্থিতিতে কোন তাত্ত্বিক ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে না পেরে সম্পর্ক ছেদ করেন এই পার্টির সাথে। নতুন চলার পথের অন্বেষণে ব্রতী হন, গড়ে তোলেন ‘কমিউনিস্ট কেন্দ্র’ নামে আর একটি প্লাটফর্ম। সেখানেও হোচোট খান। কৈশরে যে মার্কসীয় তত্ত্বে দিক্ষা নিয়েছিলেন তা আমৃত্যু আকড়িয়ে থেকেছেন তিনি, সক্রিয় থেকে গেছেন কর্মজীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। নাগরিক আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যোগ করেগেছেন অজয় দা। অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক কল্যানমুখী সমাজ বিনির্মাণ, মানবিক মূল্যবোধ তৈরী, উগ্র ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি লক্ষ্যে অজয় দা গত শতকের শেষ ভাগে গড়ে তুলেছিলেন ‘সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন’ নামে একটি সামাজিক সংগঠন। আবার যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের উগ্র সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদ মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টায় লিপ্ত, মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার বিঘ্নিত করার জন্য বিএনপি-জামাত এবং দেশী-বিদেশী চক্রের নানান ষড়যন্ত্র দৃশ্যমান তখন এর বিচার কার্য ও বিচারের রায় দ্রুত কার্যকর করা এবং যুদ্ধাপরাধীদের অর্থ ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার দাবিতে জনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শ্রমিক, নারী-যুব ও শিশু-কিশোর সংগঠন সমন্বয়ে ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ বিরোধী মঞ্চ’।
এ দুটি সংগঠনের ব্যানারে অগণিত জনসভা, পথসভা, গণসাক্ষর অভিযান, মানববন্ধন, গোলটেবিল বৈঠক, মিছিল ইত্যাদি একটার পর একটা পরিচালনা করে কর্মীদের অবিরাম ক্লান্তিহীন প্রেরণা যুগিয়ে গেছেন অজয় দা। প্রতিদিন বিকেল ৪টায় শাহবাগ সংগঠনের কার্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিতি, তরুণ সমাজকে উজ্জীবিত করা, অনুপ্রেরণা যোগানো, উৎসাহিত করা ছিল তার নিত্যদিনের নিরলস প্রচেষ্টা।
অজয় দা দেশ, দেশের মানুষ এবং মাটিকে কেমন ভালবাসতেন তার প্রমাণ রেখে গেছেন মৃত্যুর আগে মুহুূর্ত পর্যন্ত। তিনি ছিলেন প্রকৃতই দেশ প্রেমিক। মৃত্যুর আগে তিনি বলে গেছেন মৃত্যুর পর যেন তাকে দেশের মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়। হিন্দু ধর্ম অবলম্বনে অগ্নিদাহ করতে বারণ করে গেছেন পুত্র ও স্বজনদের। তার অন্তিম ইচ্ছা অনুসারে সবাই মিলে কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলার বনগ্রামে পিত্রালয়ের কাছেই পৈত্রিক ভূমিতে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজন অনেকেই সুযোগ মতো ভারতে চলে গেলেও তিনি রয়ে গেলেন মাতৃভূমে। কী বিরল দেশপ্রেম! অজয় দা ১৭ অক্টোবর ২০১৬ ভোর ৫টায় নিজ বাস ভবনে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
এর আগে ১৫ মে বিকেলে নিয়মিত ডাক্তার দর্শনের অংশ হিসেবে ইস্কাটনে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. মাহামুদুর রহমানের কাছে গেলে ক্লিনিক্যাল টেস্ট করে তিনি তাকে তাৎক্ষনিকভাবে বারডেম হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। অজয় দা বাসায় গিয়ে ২/১ দিন পর হাসপাতালে যাওয়ার কথা বললে চিকিৎসক তা অগ্রাহ্য করেন এবং তাকে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। বারডেম হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগে নেয়ার সাথে সাথে তাকে স্থানান্তর করা হয় আইসিইউতে। অবস্থার একটু উন্নতি হলে হাসপাতালের কেবিনে পরে নিজ গৃহে, আবার অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালে এভাবে পাঁচমাস মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে আমাদের মায়া-মমতা ত্যাগ করে অজয় দা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। এবার হাসপাতালে ভর্ত্তি হয়ার পর তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন শেষ বিদায় আসন্ন; তাই ঘনিষ্টজনদের বলতেন ‘আমাকে এবার বিদায় দিন।’ কথা বলা বন্ধ হয়ে গেলে কাগজে লিখে সবার কাছে বিদায় চাইতেন অজয় দা।
জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরী, অধ্যাপক ড. সালাহউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম, অধ্যাপক ড. মোশাররফ হোসেন প্রমুখ প্রয়াত হলে প্রায়ই অজয় দা আক্ষেপ করে বলতেন এবার ‘আমার যাওয়ার পালা’। ‘কথা বলার তো কেউ রইল না।’ এদের সাথে অজয় দা’র ঘনিষ্টতা ছিল, নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। অজয় দা ছিলেন অপরিসীম জীবনীশক্তির অধিকারী সৃজনশীল লেখক, সমাজ গবেষক ও সংগঠক।
আগেই বলেছি, অজয় দা ১৯৭১ সালে কারামুক্তির পরপরই বিয়ে করেন জয়ন্তী রায়কে। জয়ন্তী দি তখন ছাত্র ইউনিয়নের ময়মনসিংহ জেলার নেতৃত্বস্থানীয় কর্মী। অজয় দা’র প্রতিষ্ঠার পেছনে জয়ন্তী দি’র অবদানও অনস্বীকার্য। জয়ন্তী দি’ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত। তাদের পরিবারে তিন সন্তান অনিন্দিতা, অমিতাভ এবং অদিতি। অনিন্দিতা সুইজারল্যান্ডে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত, অমিতাভ রায় পদার্থ বিজ্ঞানী, যুক্তরাষ্ট্রে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় নিয়োজিত এবং সর্বকনিষ্ঠ অদিতি বিবাহিতা ২ সন্তানের জননী, গৃহিনী যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী।
অজয় দা আজীবন বাঙালি জাতির মুক্তি প্রয়াসে যে অবদান রেখে গেছেন তা আমাদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। তার স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা, তার আত্মার শান্তি কামনা করি। লাল সালাম অজয় দা।