কবি আখতারুজ্জামান আজাদের বাবা মারা গেছেন। মৃত বাবাকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। তাতে মারাত্মক আহত হয়েছে বেশ কয়েকজন।
এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র, কবি আখতারুজ্জামান আজাদ একটি ফেসবুক পোস্ট দিয়েছে।
বেদনার্ত ভাষায় লিখেছেন,
“আমি আমার মৃত বাবাকেও বাঁচাতে পারিনি, পথে তাকে মরতে হয়েছে আরো একবার। মরদেহ ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে (বরগুনার কালমেঘা) নিয়ে আসার অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। শেষ দফায় বাবা পনেরো দিন হাসপাতালে ছিলেন। বাবাকে হাসপাতাল থেকে বাসায় আনার দুই দিনের মাথায়ই মা দুর্ঘটনার শিকার হলেন, আছাড় খেয়ে তার হাঁটুর হাড় দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে এনে দুর্ঘটনার সাত দিন পরে অপারেশন হলো। আঠারো দিন ধরে তিনি হাসপাতালে শুয়ে ছিলেন। মায়ের যখন আরও দুটো অপারেশন বাকি, হাসপাতাল থেকে যেদিন মাকে প্রথম দফায় বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা; এর ঠিক আগের দিন, ১২ জানুয়ারি বিকেল সোয়া পাঁচটায়, আমারই হাতের ওপর দিয়ে বাবা পরপারে পাড়ি জমালেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
আমার ইচ্ছে ছিল দুঃসংবাদটা মাকে আপাতত না জানানোর অথবা তাকে গ্রামে না নেওয়ার, কিন্তু দুটোর কোনোটিই সম্ভব হয়নি। মুহূর্তের মধ্যেই কার মাধ্যমে যেন তিনি সব জেনে গেলেন।
অ্যাম্বুলেন্স নিতে হলো দুটো। একটায় বাবার মরদেহ, অন্যটায় পায়ে-ব্যান্ডেজ-পরিহিত মা। বাবার সাথে থাকলেন আমার বড়বোন, ভগ্নীপতি, ফুফাতো ভাই, চাচাতো ভগ্নীপতি আর বয়োবৃদ্ধ বড়খালু। মেজো বোন, দুই বোনের চার ছেলে-মেয়ে আর আমি থাকলাম মায়ের অ্যাম্বুলেন্সে।
মাওয়া ফেরি পেরোনোর পর গাড়ি-চলাচল কঠিনভাবে বিঘ্নিত হলো। ওয়াইপার দিয়ে ঘনঘন কাচ মুছেও ঘন কুয়াশার কারণে দেখা যাচ্ছিল না সামনের কিছুই, গাড়ির স্টার্টও বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল বারবার। প্রতিমুহূর্তে আশঙ্কা করছিলাম দুর্ঘটনার। এরই মধ্যে অন্য অ্যাম্বুলেন্সে থাকা ফুফাতো ভাই ফোন করে জানালেন গাড়ি কোনো বাজারে বা পেট্রোল পাম্পে থামিয়ে রাখতে, সামনে ডাকাত পড়েছে। ফোনেই ডাকাতদের অশ্লীল গালাগাল আর যাত্রীদের শোরগোল শুনতে পাচ্ছিলাম। গাড়ি একটা পেট্রোল পাম্পে থামিয়ে রাখলাম আধঘণ্টা; ডাকাতি থেকে বাঁচতে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল আরো কিছু অ্যাম্বুলেন্স, মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কার। রিভলভারধারী পুলিশ এসে আশ্বাস দেওয়ার পর আমরা ফের যাত্রা শুরু করলাম একযোগে। জায়গাটার নাম সাগরদি অথবা ছাগলদি। যে গাছটি রাস্তায় ফেলে ডাকাতরা গাড়ি আটকেছিল, কিছু দূর এগোতেই সেই গাছটি চোখে পড়ল; চোখে পড়ল কাচের অজস্র টুকরো।
সকাল আটটার দিকে অ্যাম্বুলেন্স যখন ঝালকাঠির রাজাপুরে, চালক ঘুমন্ত আমাকে ডেকে বললেন, ‘পথে ডোবার মধ্যে একটা অ্যাম্বুলেন্স পড়ে থাকতে দেখে এসেছি। আপনি একটু ফোন করে দেখুন আপনাদের অন্য অ্যাম্বুলেন্সটা কই আছে।’ ফুফাতো ভাইকে ফোন করলাম। ভাই তারস্বরে আর্তনাদ করে বললেন, ‘আজাদ, আমরা শেষ; আমাদেরকে বাঁচা!’ অ্যাম্বুলেন্স ঘুরিয়ে ঘটনাস্থলে গেলাম। গিয়ে দেখি জনা চল্লিশেক মানুষ ভিড় করে আছেন। তারা রাস্তায় শুইয়ে রেখেছেন ঐ অ্যাম্বুলেন্সের অচেতন চালককে। কেউ বাড়ি থেকে কাপড় এনে তাকে পরিয়ে দিচ্ছেন, কেউ পাতা জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে উত্তাপ তৈরি করছেন। ফুফাতো ভাইয়ের নাক রক্তে রঞ্জিত, রক্ত জমাট বেধে আছে তার মুখমণ্ডলের অন্যত্র। মাথায় বাড়ি লাগায় আমার বড়বোন ক্ষণে-ক্ষণে বমি করছেন। কেটে গেছে ভগ্নীপতির শরীরের বিভিন্ন স্থান। বয়োবৃদ্ধ খালু ভেজা কোট গায়ে কুঁজো হয়ে বসে কাঁপছেন রাস্তার ধারে। অক্ষত ছিলেন চাচাতো ভগ্নীপতি ও তার ছেলে।
বাবার কফিনটা ভেঙে কয়েক টুকরো হয়েছে। ডোবার এঁটো পানিতে ভিজে নোংরা হয়েছে কাফনের শ্বেতশুভ্র কাপড়। বাড়িতে এনে দেখেছি বাবার গাল, ঠোঁট, মাথা কেটে-ফেটে গেছে বাজেভাবে। কফিনটা জীবিতদের গায়ের ওপরে পড়েছিল।
কফিন অন্য অ্যাম্বুলেন্সটিতে তুললাম। মাকে আধশোয়া করে বসিয়ে রেখে আহতদেরকে ঠেসেঠুসে অ্যাম্বুলেন্সে বসালাম। অক্ষত ও অপেক্ষাকৃত কম আহতদেরকে তুলে দিলাম কালমেঘাগামী বাসে। চিকিৎসার টাকা দিয়ে আহত চালককে তুলে দিলাম বরিশালগামী বাসে। খোঁজ নিয়ে পরে জেনেছি ঐ চালক বেঁচে আছেন।
দুর্ঘটনাটা সকালে না ঘটে রাতে ঘটলে, লোকালয়ে না ঘটে জনহীন মহাসড়কে ঘটলে, এলাকাবাসী পেছনের কাচ ভেঙে আটকে-পড়াদেরকে বের না করলে আমাদের বাড়িতে কবর আরো কয়েকটি খুঁড়তে হতো। বাবার মৃত্যুর পর থেকে আমি এখনও কাঁদার সময় বা সুযোগ পাইনি। পথে যেসব ঘটনা ঘটল, তাতে আমি এখনও পাথর ও নিথর হয়ে আছি। অল্পেই-রেগে-যাওয়া অতি-বদমেজাজি আমি কী করে মহাসড়কের এই মহামড়ক সামাল দিয়ে এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছি, আবার ঘটনার বর্ণনাও দিচ্ছি; নিজেই জানি না।”
আখতারুজ্জামান আজাদের ফেসবুক পোস্ট: