চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আমার মায়ের কথা সত্য নয়!

প্রতিদিন পথ চলতে কত বোন-মা-মেয়েদের উদ্দেশ্যে কালো শব্দ ভেসে আসে, কালো চোখের চাউনি উড়ে আসে। কিন্তু তারা তো নেহাত অশিক্ষিত নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে, কর্মস্থলে, চলাচলের পথে, আড্ডায় নানা সময়ে এমন কথা শুনতে হয় আমাদের। তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ প্রতিদিন যে প্রবল রুচিহীনতার মধ্যে নিজেদের ডুবিয়ে দিচ্ছে তার দায় কার?

সমাজের প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের নানা দিক নিয়ে কলামিস্ট ও উন্নয়নকর্মী চিররঞ্জন সরকার ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন,

‘‘আমার মা গৃহবধূ। মাত্র তের বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আমার মা বাবার বাড়ি চলে আসেন। মা বারবার একটি কথা বলেন যে আমাদের পৃথিবীতে এখনো ভালো মানুষ রয়েছে, খারাপের থেকে বেশি পরিমাণে রয়েছে। নইলে পৃথিবীটা নাকি চলত না!

মায়ের যাতায়াতের পরিধি খুব একটা বেশি নয়। অন্তত বাড়ির কাজকর্ম সামলানোর পর এদিক ওদিক একটু ঘুরে আসার সময় কখনও পাননি। এমনকি কোনো আত্মীয় বাড়িতেও না। মা কোনোদিন তেমন ভাবে ঘোরেননি আশপাশ। মায়ের জগতটা এমন ভাবে ছড়িয়ে আছে তাতে করে হয়ত অনেক কিছু মায়ের চোখে পড়ে না। আমি বলতে পারি না। কিভাবে ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে সবকিছু। দ্রুত। খুব দ্রুত। বোঝাতে পারি না কি অসহায় হয়ে, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করতে হয় প্রতিদিন। বুঝতে দিই না। মা কেও, হয়ত কোথাও গিয়ে নিজেকেও। ছোটবেলা থেকে আমার অনেক বন্ধু-বান্ধবী। তাদের সঙ্গে আমার অবাধ সম্পর্ক। বাসা অব্দি যাতায়াত। কিন্তু যত বড় হয়েছি, তত অনেক সহজ চোখকে আমি জটিল হয়ে যেতে দেখেছি। দেখেছি মানুষের কথা, মানুষের বিশ্বাস কি ঠুনকো। দেখেছি মানুষের মন কি বিকৃত। জীবনের নানা সময়ে বান্ধবী, প্রেমিকা, বোন, দিদিকে নিয়ে নানাপ্রকার কটূক্তি শুনতে হয়েছে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে বাঁধা পেয়েছি প্রিয় মানুষদের কাছ থেকেই। যেন কিছু করার নেই, প্রবল অসহায় একটা জীবন। আমরা ক্রমাগত শিক্ষিত হই, বড় হই, জ্ঞান অর্জন করি, সার্টিফিকেট অর্জন করি। কিন্তু…।

এই একটা ‘কিন্তু’ সারাজীবন ঠুকরে যায়। কিন্তু? কি মূল্য এই শিক্ষার? বিশ্ববিদ্যালয়ে, কর্মস্থলে, চলাচলের পথে, আড্ডায় নানা সময়ে শুনতে হয়েছে মেয়ে বন্ধুর সম্পর্কে কটূক্তি। কি করতে পেরেছি? একবার কড়া ভাবে তাকানো? তাতে কি হয়? তারা তো নেহাত অশিক্ষিত নয়। এই সমাজের নানা কার্যক্ষেত্রে তাদের উচ্চ আসন। উচ্চ পদ। উচ্চ মাইনে। তারাই শিক্ষিত। বহুদিন বহু জায়গায় কত না কুরুচিকর ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে, কতভাবে সঙ্গিনীদের স্পর্শ করার চেষ্টা হয়েছে, তার প্রত্যেকটার গভীর ক্ষত আমার গা থেকে যে এখনো শুকিয়ে যায়নি। মাঝে মধ্যে দু একটা খবর সামনে চলে আসে। যেমন এসেছে গত শুক্রবার নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় সংঘটিত ঘটনাটি। মামাত বোনকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় সুলতান আহমেদ মিন্টু (৩৫) নামে এক যুবককে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। 

এ ধরনের ঘটনা হামেশাই ঘটছে। প্রতিদিন কত বোন-মা-মেয়েদের উদ্দেশ্যে কালো শব্দ ভেসে আসে, কালো চোখের চাউনি উড়ে আসে তার খবর কে জানে? এমন ঘটনা হামেশাই ঘটছে। ৬৮ হাজার বর্গমাইল জুড়ে শহর, নগর মফঃস্বল, গ্রাম, প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। এবং না, তারা যে সমাজের অপরাধী, দুষ্কৃতি নয়, তারা সমাজের তথাকথিত শিক্ষিত লোক। তারা শিক্ষিত বাড়ির সন্তান। বিবাহিত, সুখী দাম্পত্য তাদের। তবু, এ এক আদিম উল্লাস। এ জীবনের সবথেকে বড় রঙ্গ। তাই বাসে, ট্রেনে, অফিসে সর্বত্র একটু খুচরো মজা করে নেওয়া গেলো। এসব দেখে তীব্র অবিশ্বাস জন্মায় শিক্ষার উপর, তীব্র অবিশ্বাস জন্মায় নিজের অস্তিত্বের উপর। শক্ত হতে চাই, কিন্তু কত শক্ত হওয়া যায়?

এই ভণ্ড সভ্যতায় যখন ছেলেমেয়েদের ছোটবেলা থেকে শুধু প্রথম হওয়ার মুখস্থ শিক্ষাই দেওয়া হয়, তাদের চরিত্র গঠনের কোনও দায় কোনও শিক্ষকের এমনকি বাবা মায়েদেরও নেই তখন কার কাছ থেকে কি আশা করবো। শিক্ষকদের কি সেই নৈতিকতা বা সেই দায় নেই? বাবা মায়েরা কি প্রবল নম্বুরে অসভ্য অবাধ্য ছেলে মেয়েকে নিয়েই সন্তুষ্ট? তাদের হঠাৎ কোনও ভুল করে ফেলা তো সহজে টাকা দিয়ে চাপা দেওয়া যায় কিন্তু চাপা দেওয়া যায় কি অপর মানুষের ক্ষতি? চাপা দেওয়া যায় অন্যের ক্ষতি করবার, অন্যকে অপমান করার তীব্র ইচ্ছে? যদি সন্তানকে নিজের সংস্কৃতি না শেখালেন কি লাভ এমন শিক্ষার যা কেবল অর্থ দেয়? কি লাভ এমন শিক্ষার যা মনকে সুস্থ রাখতে পারে না। তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ প্রতিদিন যে প্রবল রুচিহীনতার মধ্যে নিজেদের ডুবিয়ে দিচ্ছে তার দায় কে নেয়? পুলিশ এখন নিজেই আক্রান্ত, প্রশাসন বলে একটা বায়বীয় বস্তু আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়ায় যা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সামলাতে এতো ব্যস্ত যে বাকি-দিকে তেমন চোখ যায় না। সমাজ এখন এতো ডিজিটাল যে ক্ষুদ্র প্রতিবাদ করার থেকে শখের প্রতিবাদ ভেসে আসে ফেসবুকে। প্রতিদিন প্রতিদিন আমাদের চোখের সামনে মা বোনেরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ধর্ষিত হচ্ছে আমরা শুধু বই পড়ি, শখের বই, সিরিয়াল দেখি, পাশের বাড়ির লোকের গাল মন্দ করি, অথবা নিজস্ব সম্পত্তি রক্ষা। নিজেদের উচ্চ আসনে বসাই মাইনের নিরিখে। নিজেদের সম্পর্কে উচ্চ ভাব পোষণ করি ব্যাঙ্ক ব্যাল্যান্স দিয়ে। ছোঁক-ছোকানিটাই আমাদের প্রিয় শখ। এসব দেখে একটা বিষাক্ত কান্না গলার কাছে চেপে বসে। মনে হয় পালিয়ে যাই, অথবা অস্ত্র ধরি। কিন্তু কতজন? কতজনকে রক্ষা করতে পারবো? আমার মা কে?

স্ত্রীকে? বোনকে? আর বাকি? প্রতিদিন রাত্রিতে তাই বাড়ি ফিরি অবসন্ন হয়ে, একগাদা ক্লান্তি নিয়ে। শরীরের নয়, মনের ক্লান্তি। মা কে বোঝাতে পারি না যে মায়ের ধারণাকে এখন আর তেমন ভাবে বিশ্বাস করতে পারি না, মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবীটা আর চলছেই না, কোনদিন ঘোরা বন্ধ হয়ে গেছে, শুধু এই গোপন সত্যই টা আমরা আর তেমন ভাবে প্রকাশ করছি না। চুপ করে ব্যাপারটা চেপে যাচ্ছি কোনও ব্যবসায়িক স্বার্থে। একেকটা ভোর হয়, আর ভাবি একদিন সত্যই কোনও ভোর আসবে যেদিন এই আবেগ বর্জিত, পোশাকি, ভণ্ড, কুরুচিকর জীবন থেকে আমরা মুক্ত হতে পারবো, কোনও একদিন। ততদিন আমরা সকলেই বিপন্ন, খুব বিপন্ন। হ্যাঁ আপনিও।’’