চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আমাদের কৃষি উন্নয়ন এবং শাইখ সিরাজ

কোন কাজটা এখন জরুরী? এমন প্রশ্নের জবাবে নানা জনে নানান কথা বলছেন, বলেন। যা মানুষের বয়স, পেশা, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিশ্বাস, লোভ, হতাশা কিংবা উচ্চাভিলাষ পূরণের লক্ষ্যেও জরুরী নির্ধারণ হয়ে থাকতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে আছে নিজের মত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজেকে বড় করে দেখানোর একটা প্রচ্ছন্ন কিন্তু প্রাণান্ত চেষ্টা। আমি নিজেও হয়তো এর বাইরে না। শিশু বা গ্রামের সরলমতি শিশু মানসিকতার মানুষগুলোর কথা কিন্তু আলাদা।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্ররা ছিল মুক্তি আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি। তাই নিজেদের ছাত্র পরিচয় আড়াল করতে গিয়ে বাবার প্ররোচনায় কৃষি কাজ করেছি, শিখেছি। কর্মজীবনেও কৃষি আর পল্লী উন্নয়নের বিষয় নিয়ে সব চেয়ে বেশি কাজ করেছি। তাই এটার উপর আমার দুর্বলতা ভিন্ন মাত্রার। এটা জেনেটিক কারণ হতে পারে। আমার বাবা দাদার আয়ের প্রধান উৎস ছিল কৃষি। বাবা ছিলেন মূলতঃ ব্যবসায়ী। কিন্তু ১৯৭৪ সালের দিকে তিনিও মাঠের কাজে তদারক করেছেন কিছু সময়, যদিও মাঠের কাজ তিনি তেমন কিছুই জানতেন না। আমাদের ১৯৭১ এর অভিজ্ঞতা ১৯৭৪ এ এসে কাজে লাগিয়েছিলাম।

আমাদের দেশে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ খুব কম। তার উপর প্রতিবছর শতকরা ১% হারে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে নানা কারণে। তাই উৎপাদনশীলতা বাড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমাদের। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে বিষয়টি অবগত হয়েছে, তিনি পুরোপুরি কনভিন্সডও হয়েছেন। তাই শিল্প মন্ত্রণালয়ে অধীন ন্যাশনাল প্রডাক্টিভিটি অরগানাইজেশন (এনপিও) বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। যদিও তাদের কাজের ফল খুব কমই দৃশ্যমান।

তবে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, বেসরকারি পর্যায়ে মানুষ তাদের চেষ্টা কিন্তু করেই যাচ্ছেন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অনেক সাফল্য অর্জন করেছেন। এই সফলতার ছোট্ট ছোট্ট ক্ষেত্রগুলোর মাঝে এখন দরকার একটা কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করা, যা হয়নি। আমি কৃষি ক্ষেত্রের এমন অনেক উদাহরণ দিতে পারবো। কিন্তু স্থান সল্পতার কারণে সব না বলে কয়েকটির কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই।

মাংসের গরু: মুস্লিম প্রধান বাংলাদেশে গোমাংস খুব জনপ্রিয়। ভারত থকেই গরু আসে বেশি। ভারত নির্ভরতা কমাতে তাই গো মাংসের উৎপাদন বাড়ানো খুব জরুরী। পশুসম্পদ দপ্তরের বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে একটি মাংসের গরুর জাত বাংলাদেশে এডাপ্টেশন রিসার্চের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষকের মাঝে রিলিজ করেছেন। চ্যানেল আই অনলাইনে কৃষি ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ সাহেবের দেওয়া তথ্যে জানা যায় যে, সেটি হলো ব্রাহামা জাতের মাংসের গরু। মাত্র বছর দেড়েক আগে এর সিমেন দেওয়া হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের মাঝে। ব্রাহামা জাতের গরু ১৫ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে ৪৪০ থেকে ৪৬০ কেজি মাংস দিতে পারে পক্ষান্তরে একই সময়ে আমাদের দেশের অন্য জাতের গরু দেয় ৮০ কেজির মত মাংস। আনুমানিক দুই বছরেই এই গরু মাংস দিতে পারে ২০-৩০ মন।

তাই দুই এক বছরের মধ্যেই সারা দেশে এটি ছড়িয়ে গেলে চাতক পাখির মতো ভারতীয় গরুর দিকে চেয়ে থাকার দিন শেষ হয়ে যাবে আমাদের। একই ধরণের আরেকটি জাতও আছে ইউরোপ, তার নাম ‘বেলজিয়ান ব্লু’। যার মাংস হয় ৮০০ থেকে ১২০০ কেজে। ৭০ কেজি ওজন নিয়েই জন্ম নেয় ঐ গরুর বাছুর। সেটি এনে আমাদের পরিবেশে এডপ্ট করাতে পারলে মাংসের জন্য গরু পালনে বিপ্লব হবেই।

মাছ: পুকুরে মাছ চাষেও আমাদের মৎস্য বিজ্ঞানীদের সাফল্য চরম। বাংলাদেশ মাৎস্য গবেষনা ইন্সটিটিউট (বিএফআরআই)এর বিজ্ঞানীরা মূলতঃ এই সফলতা দেখিয়েছেন। কেউ কেউ বলে সারা পৃথিবীতে একুয়াকালচারে মানে পুকুরের মিঠা পানিতে মাছ চাষে আমরা চতুর্থ অবস্থানে আছি। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ অর্থনৈতিক শুমারি বলছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ৩৪ লাখ ৫৫ হাজার টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে চাষ করা মাছের পরিমাণ প্রায় ২০ লাখ টন। নানা উদ্যোগের ফলে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাছ ইলিশের উৎপাদন ৫২ হাজার টন বেড়ে সাড়ে তিন লাখ টন হয়েছিল ওই সময়। এখন আর বেশি। এ বছর তো ইলিশের উৎপাদন অনেক বেশি মনে হচ্ছে। যা হোক, বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকায় মাছ চাষে বিপ্লব হয়েছে, তার মানে এই নয় যে দেশের অন্য এলাকায় মাছ চাষ হচ্ছে না।

ধান: সরকারীসহ বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার ঠিক পরে ১৯৭২ সালে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য ওই খাদ্য পর্যাপ্ত ছিল না। এর পরের ৪২ বছরে এখানে মানুষ বেড়েছে দ্বিগুণ, আর আবাদি জমি কমেছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। অথচ দেশে ১৯১৪-১৫ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে তিন গুণ বেশি; ভুট্টাসহ এর পরিমাণ প্রায় চার কোটি মেট্রিক টন। বিভিন্ন পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে যে, আর এভাবেই প্রধান খাদ্য-শস্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ। কেবল উৎপাদন বৃদ্ধিই নয়, হেক্টর প্রতি ধান উৎপাদনের দিক থেকেও অধিকাংশ দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। বাংলার কৃষকেরা এখানেই থেমে যাননি। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের জন্য পথিকৃৎ। দেশের উত্তর এলাকায় ধানের চাষ, চাষের পদ্ধতি তুলনামূলক উন্নত।

মাংসের ছাগল: বাংলাদেশে এখন পাটনাই ছাগল পালন হচ্ছে, সীমিত আকারে। এই ছাগল এক বছরে প্রায় ২০ কেজি, আর ২ বছরে ৩৫ থেকে ৪০কেজি মাংস দেয়, সাথে দুধ দেয়। এই উপখাতে হতে চলেছে আরেক বিপ্লব। কয়েক বছরের মধ্যেই এটি অন্য মাত্রায় দেখা যেতে পারে যদি এই ছাগল কুষ্টিয়া এলাকায় নেওয়া যায়।

কারণ কুষ্টিয়া ছাগল পালনের জন্য বিশ্ববিখ্যাত। কুষ্টিয়া গোটের চামড়া বিশ্ব বাজারে সব সময় ১ ডলার বেশি দামে বিক্রি হয়। কুষ্টিয়ার জলবায়ু আর আবহাওয়ার কারণে এখানে পালিত ছাগলের চামড়া আর মাংস উন্নত হয়। তাইতো গোট ডেন্সিটি কুষ্টিয়া এলাকায় বেশি। বিখ্যাত ব্লাক বেঙ্গল গোট এখানেই হয় বেশি।

শাক সবজি/ ফলঃ এখন সারা বছর নানা জাতের শাক সবজি পাওয়া যায় যা আগে বাংলাদেশে পাওয়া যেত না। বিভিন্ন কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান নানা ধরণের গবেষণার মাধ্যমে এসব সবজি চাষের উপযোগী করেছেন। এখন সারা বছর কিছু কিছু সবজি, পেয়ারাসহ নানা দেশী-বিদেশী ফল (দেশে উৎপাদিত) পাওয়া যায় যা আগে পাওয়া যেত না।

এর বাইরেও বৃহত্তর কৃষিতে অনেক কিছু উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। দেশে এখন আর প্রাচীন পদ্ধতিতে চাষাবাদ নেই বললেই চলে। শুরু হয়েছে ম্যাকানাইজড ফারমিং, অনেক জায়গায় শুরু হয়েছে আধানিবিড় কৃষি চাষ পদ্ধতি। দেশের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা ব্যাবহারের চেষ্টা চলছে, সারা বছর ধরে। তাই লবনাক্ততা সহনীয় বা কম বা বেশি পানিতে জন্মানোর উপযোগী বা সারা বছর উৎপাদন উপযোগী ধান, গ্রীষ্মকালীন নানা সবজি, ফল নিয়ে হয়েছে, হচ্ছে অনেক কাজ। আরো গবেষণা চলছে উৎপাদিত ফসল ঘরে আনতে প্রয়োজনীয় উন্নত যন্ত্রপাতির, যাতে উৎপাদন পরবর্তী ক্ষতি (যার পরিমান ৫%) কমানো যায়।

সম্ভাবনাময় কৃষিঃ এখনো সম্ভাবনাময় কৃষি নির্ভর এই বাংলাদেশ সরকারের শক্তিশালী কৃষিতথ্য দপ্তরে অনেক তথ্য সরবরাহের কৌশল রয়েছে। তবু কৃষিবিজ্ঞানী না হয়েও শাইখ সিরাজ দক্ষ কৃষিবিজ্ঞানীর মত শুধু কৃষিবিষয়ক তথ্য আদান প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদশের কৃষি উন্নয়নে বিশাল অবদান রেখেছেন। উনি কৃষির নানা সমস্যা আর সম্ভাবনা চিহ্নিত করে গবেষণা আর সম্প্রসারণের মাঝের বিদ্যমান দূরত্ব কমাতে গিয়ে উন্নয়ন সাংবাদিকতার উজ্জ্বল উদাহরন হয়েছেন। যা এখন অনেকেই অনুসরণ করছেন। আমাদের দেশের সীমিত জমিতে ফসলের অধিক ফলন আনতে দরকার উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, আর দরকার নতুন প্রযুক্তি আর কৌশল প্রয়োগের ব্যাপক প্রচার।

সব চেয়ে কম বয়সে একুশে পদকসহ নানা পুরস্কারের ভূষিত শাইখ সিরাজ এর মত মাত্র ১০ জন মানুষ দরকার আমাদের দেশের সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি, বলে আমার মনে হয়েছে। যারা প্রচার বিমুখ “খামোশ” কৃষিবিজ্ঞানীদের নানা আবিষ্কারের তথ্য আদান-প্রদানে সহায়তা করে আমাদের প্রিয় দেশটার কৃষিতে আনবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)