নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, সুইডেনের মতো দেশগুলোর শিক্ষার্থীরা মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণের পর উচ্চশিক্ষা নিতে বিদেশ যায়। তারা মাতৃভাষাতে অর্জিত জ্ঞান উচ্চশিক্ষায় কাজে লাগায় আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি শিখে। অথচ বাংলাদেশে তথাকথিত ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা আদৌ কতটুকু মানসম্পন্ন হচ্ছে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
দেশের একশ্রেণীর মানুষ কেবল সস্তা সম্ভ্রান্ত হওয়ার জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মাতৃভাষা ঠেলে যে ইংলিশ মিডিয়াম, ইংরেজি ভার্সন জাতীয় শব্দের অলঙ্কার পরছে। বৈশ্বিক বাস্তবতায় দেশের এই শ্রেণীর অবস্থা তুলে ধরে ফেসবুকে লিখেছেন প্রবাসী শিক্ষক আমিনুল ইসলাম।
ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন,’মাতৃভাষা ইংরেজি নয়, এমন দেশগুলোর ইংলিশ প্রফেসিয়েন্সি ইনডেক্স প্রতি বছর তৈরি করা হয়। অর্থাৎ যারা ইংরেজিতে কথা বলে না, কিন্তু ইংরেজিতে বেশ ভালো, সে সব দেশগুলোর একটা তালিকা তৈরি করা হয়। ওই তালিকায় বর্তমানে এক নাম্বারে আছে নেদারল্যান্ডস।
এরপর দুই নাম্বারে আছে ডেনমার্ক, তিনে সুইডেন, চারে নরওয়ে, পাঁচে ফিনল্যান্ড।
প্রথম তিনটা দেশে বেশ অনেকদিন থাকার অভিজ্ঞতা আমার আছে।
নেদারল্যান্ডে গিয়ে আপনি ডাচ যে কারো সাথে ইংরেজিতে কথা শুরু করলে, আপনার হয়তো মনে হতে পারে হয় আপনি আমেরিকা কিংবা ইংল্যান্ডে আছেন! এদের ইংরেজি এতোটাই ভালো!
নেদারল্যান্ডস এমন একটা দেশ যার ৬০ ভাগ ভূমি আসলে সি-লেভেলের নিচে। অর্থাৎ সমুদ্রের নিচে! কিন্তু এরজন্য এদের দেশ ডুবে যায়নি। ওদের প্রযুক্তি এতোই উন্নত যে-এরা সমুদ্রের নিচে চলে গিয়েও দিব্যি নিজদের ভূমি’কে রক্ষা করতে পেরেছে।
গতকাল’ই পড়লাম সুইডেনে প্রতি তিন জনের একজন বিদেশে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হিসেবে পড়তে যায়! চিন্তা করে দেখুন- একটা দেশের প্রতি তিন জনের একজন বিদেশে পড়তে যায়! তাও আবার এমন দেশের কথা বলছি-যেই দেশটাকে পৃথিবীর স্বর্গ বলা যেতে পারে। যেখানে এমনকি ইংল্যান্ড আমেরিকা থেকে মানুষজন এসে থাকতে চায়!
পৃথিবীর কল্যাণমূলক রাষ্ট্রগুলোর জন্য সুইডেন হচ্ছে একটা আদর্শ দেশ। মানবাধিকার সুচকেও এরা সব সময়ই প্রথম সারির দেশ। আর অর্থনৈতিক ভাবেও এরা অনেক এগিয়ে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা বললে, নোবেল প্রাইজের কথা তো বলতেই হয়।
ইংলিশ প্রফেসিয়েন্সি ইনডেক্সে এরপরের তালিকায় আছে লুক্সেমবার্গ, অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ডের মতো দেশ গুলো।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এইসব দেশগুলোর মানুষ কি নিজেদের পড়াশুনা ইংরেজিতে করে?
অবশ্য’ই না। এরা এদের প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল পড়াশুনা নিজেদের ভাষা’ই করে। নিজ ভাষায় পড়াশুনা করলে আপনি একটা বিষয় যত ভালো ভাবে বুঝতে পারবেন, পৃথিবীর আর কোন ভাষায় পড়ে সেটা বুঝা কোন দিন’ই সম্ভব না।
এরা নিজদের পড়াশুনা’টা নিজ ভাষায় পড়ার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা’টাও শিখে নেয় আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে। যেহেতু তাদের শিক্ষাব্যবস্থা চমৎকার, তাই যে কোন কিছু দখলে নিতে এদের সমস্যা হয় না।
অথচ দেখুন, আমাদের বাংলাদেশে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আছে, আছে ইংলিশ ভার্সন, তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিশেষ করে বিজ্ঞান কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে যারা পড়ে, তারা সবাই ইংরেজিতে পড়াশুনা করে! এরপরও আমাদের ইংরেজি তেমন ভালো, না আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে আছি!
আজীবন ইংরেজিতে পড়েও আমি অনেক বাংলাদেশিকে দেখেছি-ভালো মতো ইংরেজি বলতে পারে না! আর জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা বাদ’ই দিলাম!
না আমরা একটা ভাষা ঠিক মতো শিখতে পারছি, না আমরা পারছি জ্ঞান-বিজ্ঞানও ভালো ভাবে শিখতে বা জানতে! আমরা কেবল পারি ভাব দেখাতে এই বলে:
-আমি ইংরেজি মাধ্যমে পড়ি; আমি সায়েন্সে পড়ি, আমি ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ি, আমাদের পড়াশুনা ইংরেজিতে, আমি ইংরেজি ভার্সনে পড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি। দেশ সমুদ্রের পানিতে ডুবে যেতে লাগলে অবশ্য এইসব ইঞ্জিনিয়ার’রা কিছুই করতে পারবে না!
যখন কোন তালিকা করা হয়, তখন আমাদের দেশের নাম গন্ধ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ আমরা আসলে কখনোই কোন কিছু সত্যিকার অর্থে শিখতে চাই না। আমাদের পড়াশুনার মূল লক্ষ্য হচ্ছে- ভালো চাকরি পাওয়া, কারো ভালো একটা বিবাহ হওয়া, কারো আবার পড়াশুনার মাধ্যমে স্ট্যাটাস অর্জন করা, কারো লক্ষ্য নানান ব্র্যান্ড স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে ভাব নেয়া!
সত্যিকারের শিক্ষা বলে যে কিছু একটা আছে, যেটা মন থেকে কিংবা অন্তর থেকে শিখতে হয় কিংবা জানতে হয়, সেটা আমাদের মাঝে নেই।’