বাজেট পেশ হওয়ার পর বাজেট নিয়ে তর্ক-বিতর্ক নতুন কিছুই নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দেখা গেছে যে সরকার বাজেট উত্থাপন তারা বলে জনগণের বাজেট দেওয়া হয়েছে। এটিই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং ভালো বাজেট। বিপরীতে বিরোধী দলগুলো বলে এটি গণবিরোধী বাজেট। আর বিশ্লেষকরা বলেন, উচ্চবিলাসী বা অবাস্তব বাজেট।
প্রথম প্রথম বাজেট নিয়ে দু-চার কথা হয়। মিছিল, মিটিং সভা-সেমিনার হয়। পত্রিকাগুলোতে খাতওয়ারি বাজেটের ইতিবাচক-নেতিবাচক আলোচনা হয়। টিভি টকশোতে বিশেষজ্ঞরা মতামত দেন। এরপর আপন গতিতে বাজেট পাশ হয়ে যায়। বাজেট অধিবেশন সমাপ্ত হয়ে যায়। বাজেটের ভুল-ত্রুটিগুলো নিয়ে আর উচ্চবাচ্য হয় না। সাধারণ মানুষের স্মৃতি থেকে বাজেটের ভালো-মন্দ উড়ে যায় সহসাই।
তবে এবার খানিকটা ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে বললে ভুল হবে না। মাত্র একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাজেট নিয়ে জনগণের মাঝে চরম বিরুপ এক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। সেই প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা খুবই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বলেই দৃশ্যমান। বাজেট নিয়ে সাধারণ জনগণের মাঝে নেতিবাচক এই প্রতিক্রিয়া ও মনোভাবের কারণ হলো ব্যাংক হিসেবে বাড়তি আবগারি শুল্কের প্রসঙ্গটি।
এবারের ২০১৭-১৮ প্রস্তাবিত বাজেটে এক লক্ষ টাকার উর্ধ্বে হতে অনুর্ধ্ব ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আবগারি শুল্ক বাবদ ৫০০ টাকার স্থলে বাড়িয়ে ৮০০ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ পুরনো ধারাবাহিকতায় নতুন করে বাড়ানো হয়েছে ৩০০ টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকে আগে এক লক্ষ টাকার উর্ধ্বে সঞ্চিত থাকলে একজন গ্রাহককে আবগারী শুল্ক বাবদ ৫০০ টাকা দিতে হতো। কিন্তু এখন বাড়তি ৩০০ টাকাসহ দিতে হবে ৮০০ টাকা । বাড়তি ৩০০ টাকা নিয়েই তৈরি হয়েছে যত আতঙ্ক এবং ক্যাচাল।
সাধারণ জনগণের পার্সেপশন, নিজের অর্জিত এক লক্ষ টাকার উপরে ব্যাংকে রাখলে বছর অন্তে আবগারি শুল্ক, ট্যাক্স, ব্যাংক ফি-এসব কাটাকাটির পর দেখা যাবে একজন গ্রহীতা তার মূল টাকার চেয়ে কম টাকা পাচ্ছেন। জনগণের প্রবল আপত্তি এবং আতঙ্কটা এখানেই। সাধারণ জনগণের যুক্তি মতে, আগে এভাবে টাকা রাখলে জনগণ বছর অন্তে কিছুটা লাভ পেত, উল্টো এখন জনগণের গচ্ছিত টাকাই কমে যাচ্ছে। এটি হতে পারে না। এই প্রেক্ষিতে সবার প্রশ্ন তাহলে ব্যাংকে মানুষ টাকা কেন রাখবে? বিশেষজ্ঞরাও বলছেন এই আতঙ্ক দূর করতে না পারলে আগামীতে অবৈধ লেনদেন আরো বাড়বে।
আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি করায় মানুষ যে কতোটা ফুঁসে উঠেছে তা বুঝা যায় সামাজিক মাধ্যমে চোখ রাখলেই। বাজেট ঘোষিত হওয়ার পর এ বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে আলোচনার ঝড় বয়ে গেছে। সামাজিক মাধ্যমে প্রতিকী প্রতিবাদ হিসেবে বলেছেন ব্যাংকের চেয়ে মাটির ব্যাংক বা বালিশের তলায় টাকা রাখা ঢের নিরাপদ। এ দিকে এ বিষয়ে বারবারই বিপদজনক হয়ে উঠছে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিতের সতর্কবাণী উচ্চারণের কারণে। বারবারই রাগত কণ্ঠে তিনি বলতে চেয়েছেন আবগারি শুল্ক সম্পর্কে যা বলেছেন সেটাই বহাল থাকবে। কোনোকিছুই তিনি পরিবর্তন করবেন না।
কিন্তু না জনপ্রতিনিধিরা বিষয়টি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের মতো করে নেননি। তারা জনগণের মনের কথাটি বুঝতে পেরেছেন। জনপ্রতিনিধিরা তাই বিষয়টি বুঝেশুনেই সংসদে আলোচনা করেছেন। নিজেরা আবগারি শুল্ক প্রত্যাহারের পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন। ১ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ হওয়ার ৭ জুন সাধারণ আলোচনা শুরু হয়। এ যাবৎ যে সব সংসদ সদস্য বাজেটের উপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়েছেন দু একজন বাদে সবাই-ই আবগারি শুল্ক প্রত্যাহারের পক্ষে বলেছেন। ৭ জুন সরকারি দলের সংসদ সদস্য অধ্যাপক আলী আশরাফ, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনসহ অনেকেই আবগারি শুল্ক প্রত্যাহারের কথা বলেন।
অধ্যাপক আলী আশরাফ এমপি ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারী শুল্ক বৃদ্ধি এবং ভ্যাটের শুল্ক বৃদ্ধির সমালোচনা করে অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ্যে করে বলেন, ব্যাংক আমানতের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি করে কয় টাকা পাবেন? কিন্তু এটা নিয়ে সারাদেশে যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে তা মোটেই কাম্য ছিল না। ১২ জুন সংসদে দঁড়িয়ে বাজেট আলোচনায় সরকার দলীয় সংসদ কৃষিবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, ব্যাংক আমানতে আবগারি শুল্ক নিয়ে অর্থমন্ত্রী যেনো জেদ না ধরেন। আলোচনায় তিনি বলেন, মানুষ এই আবগারি শুল্ক চায় না।
সরকারি দলের আরেক সংসদ একেএমএ আউয়ালও একই কথা উল্লেখ করে বলেন, এটি বাজেটে রাখা হলে নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ওর্য়াকার্স পার্টির সাংসদ ইয়াসিন আলীও একই কথা বলে স্পীকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জাতীয় পার্টির আব্দুল মুনিম চৌধুরীও আবগারি শুল্ক বাড়ানোর বিপক্ষে যুক্তি দেন।
এই ধারাবাহিকতায় ১৩ জুন অর্থপ্রতিমন্ত্রী এম. এ মান্নান দীর্ঘ বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে আবগারি শুল্কের বিষয়ে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান আসবে বলে ইঙ্গিত দেন। তিনি আলোচনায় উল্লেখ করেন ব্যাংক আমানতে ১৯৪৭ সাল থেকে আবগারি ছিল। জাতীয় সংসদে এনআরবি থেকে যে ইনফরমেশন সেন্টার খোলা হয়েছে সেখান থেকে ২০০৪-০৫ অর্থবছর হতে ব্যাংকিং সেবার বিপরীতে আবগারি শুল্কের হারের উপর একটি তুলনামূলক চিত্র সরবরাহ করা হচ্ছে। সেখানেও দেখা যায় এ বছর ১ লক্ষ টাকার উর্ধ্বে হতে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত যেমন ৩০০ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে তেমনি আবার ২০ হাজার টাকার উর্ধ্বে হতে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ১৫০ টাকা কমানো হয়েছে। অর্থাৎ এক লক্ষ টাকার নিচে থাকলে কোনো আবগারি দিতে হবে না।
সংসদে বাজেটের উপর সংসদ সদস্যদের সাধারণ আলোচনা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় বাড়তি আবগারি শুল্কের পক্ষে কোনো সংসদই নেই। কেউই এ বিষয়টি মানতে পারছেন না। কেননা সংসদ সদস্যগণ নিজ এলাকা আর পত্রপত্রিকা পড়ে বুঝতে পেরেছেন-বিষয়টি মানুষের মাঝে মারাত্মক নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করেছে। ১৩ জুন সংসদে অর্থপ্রতিমন্ত্রী যে ইঙ্গিত ও আশ্বাস দিয়েছেন তাতে করে বুঝা যাচ্ছে বাড়তি আবগারি হয়ত আর থাকবে না। কিন্তু অর্থমন্ত্রী পরের দিনই ১৪ জুন অর্থপ্রতিমন্ত্রীর উপর একহাত নিতে ভুল করেননি। সচিবালয়ে ক্রয়সংক্রান্ত কমিটির সভা শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি আগের মতোই চোট দেখিয়েছেন। উল্টো প্রশ্ন তুলেন, অর্থপ্রতিমন্ত্রী আবগারি শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়ে যেভাবে বলেছেন সেভাবে বলার মতো দায়িত্বশীল অবস্থানে তিনি নেই।
আসলে বাড়তি ৩০০ টাকা নেওয়াটাকে কেন মানুষ জুলুম হিসেবে নিচ্ছে এটি আওয়ামী লীগের নেতাদের বুঝার যে সক্ষমতা নেই তা কিন্তু নয়। প্রথমত: এই অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব থাকা অবস্থায় ব্যাংক সেক্টরে যে ব্যাপক চুরি-ডাকাতি বা লুটতরাজের ঘটনা ঘটেছে তা সামাল দিতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনাকে তিনি টাকা হিসেবেই গণ্য করেননি। এসব কারণে ১ লক্ষ টাকার উর্ধ্বে হতে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ৩০০ টাকা আবগারি শুল্ক বৃদ্ধির ঘটনাটি সাধারণ মানুষের মাঝে খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত প্রায়শই জিদ ধরেন। তিনি মানুষের কথা শুনতে চান না। প্রায়শই দাম্ভিকতার সঙ্গে নিজের মতামতটাকেই তুলে ধরেন। আবগারি শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়টি নিয়ে তিনি জিদ ধরে যেভাবে পানি ঘোলা করছেন এতে করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের যে ক্ষতি হবার তা হয়ে গেছে। সেই ক্ষতি ও ক্ষত প্রশমন করা এখন অনেকটাই কঠিন। অর্থমন্ত্রী এখনও বুঝতে পারছেন না, পাবলিকের কাছে যে বার্তা গেছে সেটা কতোটা ভয়াবহ। আসলে সবকিছুই জিদ দিয়ে হয় না। পাবলিকের মনের কথাটি বুঝতে হয়।
আবগারি শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়টি নিয়ে (যে অংশটি নিয়ে জনগণের আপত্তি) আর জিদ নয়। আমার মনে হয় এ বিষয়টি নিয়ে অর্থমন্ত্রী আরও যত বেশি জিদ দেখাবেন ততই সেটা ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে যাবে। জিদ খুব ভালো কিছু নয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)