২০১৭ সালে অর্থীতিতে নোবেল পেয়েছেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থীতির অধ্যাপক রিচার্ড থেলার। একাধিক অর্থনৈতিক বিকল্প থাকলে মানুষ কোন বিকল্প বেছে নিবেন সেই বিষয়ে গবেষণা করে নোবেল পেয়েছেন রিচার্ড। তার এই নোবেল প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গায়ো যুক্ত হলো নোবেলের আরও একটি পালক।
এই বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন প্রবাসী কলামিস্ট ও অর্থনীতিবিদ সাফকাত রাব্বি অনিক।
তিনি লিখেছেন: এবছর অর্থনীতিতে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছে এমন একজনকে যার গবেষণা মাত্র কয়েক দশক আগেও অর্থনীতির মেইনস্ট্রিম বা মূল ধারার বাইরে ছিল। প্রফেসর সাহেবের নাম রিচার্ড থেলার। তিনি ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগোর অধ্যাপক। মজার কথা হলো, থেলার সহ গত ৫০ বছরের অর্ধেকের বেশী অর্থনীতির নোবেল পুরষ্কার গিয়েছে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কম্পিউটারের ব্যাপক ব্যবহার একাডেমিক অর্থনীতিতে শুরু হবার পরে অনেক ধরণের ইকোনমিক মডেল বা অংকের মডেল বানানো হয়েছে। এই মডেলগুলো বানানোর সময় এটাই ধরে নেয়া হয় যে নিজের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো নেবার ব্যাপারে মানুষ মোটা দাগে যৌক্তিক বা র্যাশনাল।
অর্থনীতিবিদরা জানতেন এমন মানুষ অবশ্যই আছে যারা ফিন্যান্সিয়াল সিদ্ধান্ত নেবার সময় ইর-র্যাশনাল আচরণ করেন বা যুক্তি-তর্কের ধার ধারেন না। তবে মোটা দাগে ১৯৭০-২০০০ সাল পর্যন্ত অর্থনীতির মূল ধারার পপুলার সব থিউরিতেই ধরে নেয়া হয়েছে অধিকাংশ মানুষ যুক্তি মানেন এবং যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেন।
রিচার্ড থেলার গত কয়েক দশক ধরে বলে আসছেন যে মানুষ আসলে অনেকটাই অযৌক্তিক বা ইর-র্যাশনাল। তারা সবসময় যুক্তিতর্ক বুঝে ফাইন্যান্সিয়াল সিদ্ধান্ত নেয় না। তার এই আইডিয়ার কারণে রিচার্ড থেলারকে ইকোনমিক্স এর ফ্রিনজ বা মেইনস্ট্রিমের বাইরের মানুষ হিসেবে ধরা হতো। তবে আজ নোবেল কমিটি বলেছে, রিচার্ড থেলার তার বিগত কয়েক দশকের কাজ দিয়ে মানুষের অযৌক্তিকতার এই আইডিয়াটাকে ইকোনমিক্সের মেইনস্ট্রিম’এ ঢুকিয়েছেন।
রিচার্ড থেলার প্রমান করেছেন যে মানুষ যদিও অযৌক্তিক, তারপরেও মানুষের অযৌক্তিকতাকে প্রেডিক্ট করা সম্ভব। অর্থাৎ মানুষ কখন কখন অযৌক্তিক আচরণ করবে সেটা আগে থেকে অনুমান করা সম্ভব। ইংরেজিতে তিনি বলেছেন “পিপল আর প্রেডিক্টিভলি ই-র্যাশনাল”।
রিচার্ড থেলার অর্থনীতির যে ধারার পুরোধা তাকে বলে বিহেভেরিয়াল ইকোনমিক্স বা মানুষের আচার-ব্যবহারের ইকোনমিক্স। একটি গবেষণায় উনি দেখিয়েছেন, গাড়ি রেজিস্ট্রেশন করার চিঠি পাঠানোর সময় রেজিস্ট্রেশন অথরিটি যদি গ্রাহকের গাড়ির একটা ছবি চিঠির সাথে জুড়ে দেয়, মানুষ তাহলে দ্রুত গাড়ি রেজিস্ট্রি করে ফেলে।
মানুষ যখন মনে করে কেউ তার সাথে আনফেয়ার বা অন্যায্য আচরণ করছে, তখন সে অন্যায্য আচরণটার বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের অর্থণৈতিক সিদ্ধান্তগুলো নেয়। এখানে এমনও যদি হয় যে নিজের ক্ষতি হচ্ছে, মানুষ তারপরেও অন্যায্যতার বিরুদ্ধেই যায়। এর একটা ক্ল্যাসিকাল উদাহরণ হচ্ছে শ্রমিকের বেতন।
বিহেভেরিয়াল ইকোনমিক্স এ দেখা গেছে যখন অর্থনৈতিক মন্দা আসে বা যখন কোন কারখানার বেচা বিক্রি কমে যায়, তখন কারখানার মালিকের হাতে দুইটা অপশন থাকে। একটা হলো সব শ্রমিকের বেতন এমনভাবে কমিয়ে দেয়া যাতে করে কাউকেই চাকরিচ্যুত করতে না হয়। আর অন্য অপশন হলো শ্রমিকের সংখ্যা কমিয়ে ফেলা। অল্প কিছু শ্রমিককে তাদের আগের পারিশ্রমিকেই চাকরিতে বহাল রাখা। বাকিদের ছাটাই করে ফেলা।
গবেষণায় দেখা গেছে, শ্রমিকরা বেতন কমিয়ে দেবার ইস্যুটাকে অন্যায্য বা আনফেয়ার ভাবে। তারা ভুলে যায় বেতন কমে করে হলেও কাজটা কন্টিনিউ করতে পারলে তারা একেবারে বেকার হয়ে যাবে না। অর্থনৈতিক মন্দার সময় শ্রমিকরা নিজেদের স্বার্থ ও অর্থনীতির যুক্তিতর্কের ধার না ধেরে বেতন কমার প্রতিবাদ করে। একারণে অর্থনৈতিক মন্দায় কারখানাগুলো শ্রমিক ছাটাই করার অপশনটাই ব্যবহার করে, সবার বেতন কমানোর অপশনটা না নিয়ে।
রিচার্ড থেলারের নোবেল পাওয়ার মধ্যে আর একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে। সেটা হলো ওয়েস্টার্ন সিস্টেম’এ নিয়ম করে চিন্তা-চেতনার অর্থডক্সি বা মৌলবাদীতা নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে। আগে যারা ভাবতো থেলার একজন মেইনস্ট্রিম’র বাইরের লোক, তারাই এখন তার নোবেল সেলিব্রেট করবে। এই অর্থডক্সি ভেঙ্গে ফেলার ভালো এবং মন্দ উভয় দিকই আছে, তবে ভালোর অংশটাই বেশী বলে আমার ধারণা।