সপরিবার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর ঘাতকদের রোষানলে পড়ে শেখ কামাল প্রতিষ্ঠিত আবাহনী ক্রীড়া চক্র। সেদিনই আক্রান্ত হয় ক্লাবের আবাসিক ক্যাম্প। জীবননাশের হুমকি দিয়ে ক্যাম্প থেকে উচ্ছেদ করা হয় খেলোয়াড়, কর্মকর্তা এবং কর্মচারিদের।
তবে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু তনয় শেখ কামালের হাতে গড়া তারুণ্য ও আধুনিকতার প্রতীক আবাহনীকে নিঃশেষ করতে পারেনি ঘাতকচক্র।
বরং দিন দশেকের মাথায় বিপর্যয় কাটিয়ে খেলার মাঠে ফিরে লাখো দর্শকের মন জয় করে আবাহনী। এরপর সাফল্যের পথে এগিয়ে যাওয়া। স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন স্বপ্ন নিয়ে শেখ কামালের নেতৃত্বে একদল তরুণ মুক্তিযোদ্ধার প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা আবাহনীর খেলার মাঠের সাফল্য দেশের সীমানা ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক স্তরে ।
১৫ আগস্টের অভিশপ্ত ভোরের হত্যাকাণ্ডের পর আবাহনী ক্লাবও আক্রান্ত হতে পারে এমন আশংকার কথা বিভিন্নভাবে ধানমন্ডি এলাকায় বসবাসকারি ক্লাব কর্মকর্তাদের জানিয়েছিলেন ক্লাবের শুভাকাঙ্খী, ওইসময়ের সেনা কর্মকর্তা এবং শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের বর্তমান সভাপতি মেজর (অব:) মঞ্জুর কাদের।
তার সতর্কবার্তা পেয়ে কর্মকর্তারা জার্সি, ট্রফি, খেলার সরঞ্জামসহ ক্লাবের মূল্যবান সামগ্রী সরিয়ে ফেলেন।
এরপরই ঘাতকদের একটি দল বর্তমান ক্লাব ভবনের উল্টোদিকের রাস্তার শেষ মাথায় অবস্থিত খেলোয়াড়দের আবাসিক ক্যাম্পে হানা দেয়। তল্লাশি চালানোর পাশাপাশি তারা খোঁজ করে কয়েকজন খেলোয়াড়ের। তাদের না পেয়ে আক্রমণকারিরা অন্যদের লাঞ্চিত করে।
আক্রমণকারিরা চলে যাওয়ার পর হুমকির মুখে খেলোয়াড়রা আবাসিক ক্যাম্প ছাড়েন বলে জানিয়েছেন ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক এম. মোজাম্মেল ওমর।
মালয়েশিয়ার মারদেকা কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নেয়ার জন্য সেসময় বাংলাদেশ জাতীয় দলের সঙ্গে ছিলেন সালাউদ্দিন, অমলেশ, চুন্নুসহ ক্লাবের সাত ফুটবলার। হত্যাকাণ্ডের সপ্তাহখানেকের মধ্যে তারা ফিরে এসে যোগ দেন দলের অনুশীলনে।
আবাসিক ক্যাম্প উচ্ছেদ হওয়ায় খেলোয়াড়রা নিজেদের বাসা এবং অন্যান্য ক্লাবের ক্যাম্পে থেকে অনুশীলন চালিয়েছেন বলে জানান সাবেক ফুটবলার অমলেশ সেন। বছরের বাকি সময়টা ক্লাবের সাবেক অধিনায়ক আব্দুস সাদেক এবং তিনি খেলার পাশাপাশি যৌথভাবে ফুটবল দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেন।
১৫ আগস্টের দিন দশেক পর ঢাকা ফুটবল লিগে দিলখুশা স্পোর্টিং-এর বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচ খেলতে নামে আবাহনী। ভীত খেলোয়াড় এবং কর্মকর্তারা জার্সি, খেলার সরঞ্জাম লুকিয়ে সাধারণ পোষাকে সেসময়ের ঢাকা (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু) স্টেডিয়ামে হাজির হয়েছিলেন।
তবে দল মাঠে নামতেই পাল্টে যায় দৃশ্যপট ।
অমলেশ সেনের ভাষায়: সেই ম্যাচের আগে কর্মকর্তা ছাড়া নতুন ক্লাব আবাহনীর নিজস্ব তেমন সমর্থক ছিলো না বললেই চলে। কিন্তু সেদিন আমরা জার্সি পরে মাঠে নামতেই পুরো গ্যালারি ভর্তি দর্শক প্রবল হাততালিতে আমাদের স্বাগত জানায়। দুই পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুর রকিব ও নবি চৌধুরী মাঠে এসে বলে যান, নির্ভয়ে খেলো, তোমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমাদের।
‘সেদিনের পর থেকেই আবাহনীর সমর্থক সংখ্যা বাড়তে শুরু করে,’ বলে জানান অমলেশ সেন।
‘এরপরের ঘটনা তো ইতিহাস,’ বলার সময় প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক এম. মোজাম্মেল ওমরের কণ্ঠ আবেগে কেঁপে উঠে। ‘কঠিন সময়ে দর্শকদের এই ভালোবাসা দেখে চোখের পানি আটকে রাখতে পারিনি। শেখ কামালকে হত্যা করলেও তার সৃষ্টি বাঙ্গালি বাংলাদেশের অন্তরে চিরদিনের জন্য ঠাঁই করে নিয়েছে। এই ভালোবাসা আমাদের আবাহনীকে এগিয়ে নেয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছে।’
শেখ কামালের সহযোদ্ধা অমলেশ, হারুন, বাচ্চু, ওমর, মোমিনুল, সেন্টু, মন্টু, তারেক, শাহান, সালাউদ্দিনদের হাত ধরেই এরপর অস্তিত্বের সংকট কাটিয়ে আবাহনী বিকশিত হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৫-এ ঢাকা ফুটবল লিগে তৃতীয় এবং ক্রিকেট লিগে চ্যাম্পিয়ন হয় আবাহনী।
১৯৭৬ এ ফুটবলে রানার্সআপ আর পরের বছর অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অনন্য রেকর্ড। এভাবেই এগিয়ে চলে ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক আসরে নিয়মিত সাফল্যে উদ্ভাসিত শেখ কামালের স্বপ্নের আবাহনী ক্রীড়া চক্র।
পঁচাত্তর পরবর্তী কঠিন সময়ে বিএনপির সাবেক দুই মন্ত্রী আকমল ইউসুফ, শামসুল ইসলাম খান, শিল্পপতি ও ক্রীড়া সংগঠক লে. কর্নেল (অব:) কাজী শাহেদ আহমেদ এবং রাজনীতিক আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর মতো প্রভাবশালীদের অকৃপণ সহায়তা পেয়েছে আবাহনী।
তাদের অনেকেই আওয়ামী রাজনীতির বিপরীত ধারার হলেও শেখ কামালের সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখতে তারা পিছপা হননি।
তাদের অবদানের কথা স্বীকার করার পাশাপাশি সংগঠকরা বলেছেন, রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান আর ছাত্র রাজনীতির সক্রিয় কর্মী হয়েও শেখ কামাল আবাহনীকে রাজনীতিমুক্ত সংগঠনে পরিণত করতে পেরেছিলেন বলেই সংকটের সময় বিপরীত প্লাটফর্মের রাজনীতিবিদদের উদার পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে তার গড়া ক্লাব।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং আবাহনীর মতো একটি দেশসেরা ক্রীড়া সংগঠন গড়ার স্বপ্ন শেখ কামাল একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলার সময়ই দেখেছিলেন বলে জানালেন এম. মোজাম্মল ওমর।
‘মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়ই শেখ কামাল বলতেন, স্বাধীন দেশে একটা ক্লাব গড়বো, যেখানে স্বাধীন বাংলা দলের ফুটবলাররা ছাড়াও তরুণ প্রতিভাবান খেলোয়াড়, দেশী-বিদেশী যোগ্য প্রশিক্ষক আর অনুশীলনের সর্বাধুনিক সুযোগ সুবিধা থাকবে।’
শুরু করেছিলেন শেখ কামাল। স্বপ্ন পূরণের বাকি পথটা এগিয়ে নিয়ে গেছে তার অনুসারীরাসহ তারই সৃষ্টি আবাহনী।