‘কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে, ভাই বলে ডাকো যদি দেব গলা টিপে, হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা, কেরোসিন শিখা বলে, এসো মোর দাদা’। গতকাল থেকে বারবার ঘুরে ঘুরে শুধু এই কথাগুলো মনে পড়ছে। কেনইবা পড়বে না! সোশ্যাল মিডিয়া ফলো করলে মনে আসতে বাধ্য।
২০১০ সালের যুক্তরাজ্যে সাধারণ নির্বাচন জয়ী হয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এমপি হন রুশনারা আলী। বিভিন্ন পত্রিকার পাতায় রুশনারার ছবি ও তিনি বাঙালী তা নিয়ে সংবাদের ছড়াছড়ি। সাংসদ নির্বাচিত হবার পর রুশনারাকে বাঙালী বানিয়ে ফেলল মিডিয়া। বাংলাদেশিদের উচ্ছাস মাত্রা ছাড়া হল। বলেই বসল যে, হাউজ অফ কমন্সে রুশনারা প্রথম বাঙালী। রিয়েলি! তিনি প্রথম বাঙালী! রুশনারা কি বাঙালী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন না ব্রিটিশ নাগরিক হয়ে হাউজ অফ কমন্সে নিজের আসন পাকা করেছিলেন?
একই কথা বাকি দুই জনের ক্ষেত্রে। তারা হলেন: টিউলিপ সিদ্দিকী ও রুপা আশা হক। তিন বাঙালী কন্যার সাফল্যে বাংলাদেশের মিডিয়া পাগল প্রায়। একটু থামেন। এরা কেউ নিজেদের বাংলাদেশি মনে করেন না। ব্রিটেনের নাগরিক হিসেবেই গেছেন সে দেশের পার্লামেন্ট নির্বাচনে। উনাদের পূর্বপুরুষের দেশ বাংলাদেশ। তারা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক।
বাংলাদেশের বাইরে যখন কোনো আমেরিকান, অস্ট্রোলিয়ান, রোমানিয়ান, কানাডিয়ান, ব্রিটিশ, এমন কি ইন্ডিয়ান (যাদের পূর্বপুরুষ বাংলাদেশি) সাফল্য অর্জন করে। ওমনি আমরা হামলে পড়ি, বাংলাদেশির সাফল্য বলে। তাহলে যখন একজন বাংলাদেশি।
বিদেশের মাটিতে এসে কোন অন্যায় কর্ম করে তাকে কেন অস্বীকার করছেন? আপনার আমার অস্বীকার কি তার অপরাধ কমিয়ে দিচ্ছে? নাকি আমাদের ডিনাইল সোসাইটির উপকারে আসবে।
গত ৯ ডিসেম্বর, সোমবার, বিকট আওয়াজে কেঁপে ওঠে পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনাল। পাইপ বোমা হামলায় হামলাকারী আকাইদ উল্লাহ নামের বাংলাদেশি অভিবাসী, সাত বছর আগে এদেশে তার আগমন। পোর্ট অথরিটি টার্মিনালটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও ব্যস্ততম বাস টার্মিনাল। গড়ে প্রতি দিন এই বাস টার্মিনাল দিয়ে আড়াই লাখ যাত্রী যাতায়াত করেন।
আকাইদ উল্লাহ যা করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। তার যথাযোগ্য শাস্তি পেতেই হবে। আকাইদের তৈরি বোমাটি নিম্নমানের। না হলে কত জন হতাহত হত তা কল্পনাতীত। লো গ্রেড হওয়াতে বেঁচে গেছে আকাইদ নিজেও। চিকিৎসা সেবা নিচ্ছে বেল্ভ্যু হাসপাতালে। জীবিত থাকায় এখন তার কাছ থেকে জানতে হবে, কেন সে উগ্র ইসলামী গ্রুপের অনুসারি? কেন সদ্য জন্ম নেয়া তার শিশু সন্তান, বউ, বাবা-মা, ভাই বোন, বন্ধু ও আত্মীয় সবার মায়া ত্যাগ করে নিজের জীবন এভাবে হেলায় নষ্ট করল। কে কীভাবে তার ব্রেইনওয়াশ করল। মাত্র ২৭ বছরের টগবগে যুবক কেন এমন হীন কাজে নিজের অমূল্য জীবন হেলায় হারাতে চাইল?
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ভবন উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টার অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ অক্টোবর নাফিসকে নিউইয়র্কে গ্রেপ্তার করা হয়। শিক্ষার্থী ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর গোয়েন্দাদের পাতা ফাঁদে আটকা পড়ে নাফিস। তাকে ৩০ বছরের কারাদন্ড দিয়েছে কোর্ট। ২২ বছরের এই ছেলে জিহাদের পথে কেন গেছে? তার সম্ভাবনাময় জীবন জেলের চার দেয়ালের মধ্যে কেটে যাবে। কোন মন্ত্রে তারা জীবনকে হেলায় হারাতে চায়!। ওই মন্ত্রদাতাদের খুঁজে বের করা জরুরী। ওদের বিষদাঁত নির্মূল না করা গেলে, আমাদের ভাই, ছেলে, স্বামী, বন্ধু, পরিজন, যারা তেলাপোকা দেখলে ভয়ে চিৎকার করে, তারা নির্দ্বিধায় মানুষ খুন করবে। যারা নিজের হাতে ভাত খেতে পারে না তারা জোশিলা জোসে নাঙ্গা তরবারি চালিয়ে জবাই করবে।
একদল মানুষ দিনে দিনে স্মুথলি খুনী, বোমাবাজ হয়ে উঠছে। আগে বলা হত অভাবে স্বভাব নষ্ট। ঢাকার আর্টিজান হামলা কিন্ত প্রমাণ করেছে, অতিধনীর দুলাল, মধ্যবিত্ত পরিবার কেউ পিছিয়ে নেই সন্ত্রাসের পথে।
আকাইদ উল্লাহের সন্ত্রাসী হামলার পর আমরা তাকে বাংলাদেশি বলতে চাইছি না। এমনকি অনেকে নিজেকে বাংলাদেশি ভাবতে লজ্জা পাচ্ছেন। অনেকে নিজের এথনিক উৎসে লজ্জিত। দেশের মান সম্মান সব এক আকাইদ নষ্ট করে দিল বলে হায় হায় করছেন। ভিসা কঠোর হবার আশংকায় গালাগালি দিচ্ছেন। কিন্তু একবারো ভাবছেন না এক আকাইদ পুরো বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে না। এই দেশকে আপনার ভালবাসার দরকার নেই, তাহলে তো ঘৃণা করারও দরকার নেই। ভাল না লাগলে কেউ আপনাকে মাথার দিব্বি দেয়নি এখানে থেকে যাবার। এইদেশের সমস্ত সামাজিক সুবিধা নিয়ে, এদেশে থেকে খেয়ে, এদেশের ক্ষতি করার অধিকার কারো নেই ।
পুলিশ বরাতে জানা যায়, সে প্যালেস্টাইনে ইসরায়েলের আগ্রসন মানতে পারছিল না, তার মানবিক মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। সে জিহাদী জোশে আক্রমণ চালায়। এতে প্যালেস্টাইনীদের কোন উপকারে আসলো সে! আসলে আকাইদরা চরম স্বার্থপর এক গোষ্ঠী। এরা শুধু নিজেদের স্বার্থে বিভোর। জান্নাতে ডাইরেক্ট প্রবেশের প্রলোভনে বেঁচে থাকা আত্মীয়-পরিজনকে নরক যন্ত্রণার মাঝে ফেলে দিল। নিজের জীবন তো জেলের চারদেয়ালে কাটবে কি ফাঁসি হবে তা অচিরেই জানা যাবে। কিন্তু যারা ওর আত্মীয় বন্ধু পরিজন তাদের জীবন ফেলে দিল সন্দেহের বিষাক্ত তীরের মুখে। পদে পদে হেনস্তা ও অসহযোগিতার মধ্যে পড়বে আকাইদের চৌদ্দগোষ্ঠী যারা বলছে এরকম ঘটনায় তারা বিব্রত।
অনেকে মনে করছেন, আকাইদের ঘটনায় বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী ভ্রমণকারীরা ঝামেলায় বাড়তে পারে। নাফিসের আটক হবার পরে সবাই ভয় পেয়েছিল বাংলাদেশ থেকে আর স্টুডেন্ট ভিসা কেউ পাবে না। কিন্তু এমন কিছুই হয়নি। আমরাও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক। আমাদের বাকি আমেরিকানদের মতো সমান অধিকার আছে। এক আকাইদকে নিয়ে জাত গেল ধর্ম গেল, সত্যি কি? সবাই ঠিক চিন্তা করুন। কমিউনিটিতে হাজার দল বিভক্ত না হয়ে একতাবদ্ধ হন।
দু’দিন ধরে দেখছি সবাই ছি ছি করছেন সোশ্যাল মিডিয়াতে, সংবাদে। আগে ভাগেই সবাই কেন বলছেন পুরো কমিউনিটিকে দায়ী করা যাবে না। কেউ কি দায়ী করেছে? কেউ কি গত তিনদিনে হেইট ক্রাইমের শিকার হয়েছেন? আমেরিকার প্রশাসন এদেশের বাংলাদেশি কমিউনিটিকে দায়ী করেনি। তাহলে আপনি কেন মুখ দেখাতে পারছেন না লজ্জায়! ঘুরে ফিরে সংবাদে বা সোশ্যাল মিডিয়াতে কয়েকজনকেই দেখছি তারা ভীত লজ্জিত। তা কি সঠিক?
আমার চারপাশে সবাই আমেরিকান নাগরিক। আমি একমাত্র বাংলাদেশি অরিজিন। আমার তো তাদের সাথে মাঝে বিব্রত লাগেনি। কেউ আমার দিকে আঙ্গুল তোলেনি বা আলোচনা বন্ধ করেনি বা তীর্যক ইংগিত করে কথা বলেনি। আমার পরিচিত বাঙ্গালীদেরও অসহায় লাগছে না। তবে কিছুটা অস্বস্তি লাগছে বটে। আমেরিকার নাগরিক হয়েও আমেরিকাকে ওউন করেন না, ফলে এ ধরনের লজ্জা, ভয় আপনাকে আঁকড়ে ধরছে।
লজ্জিত না হয়ে বরং ভাবেন, কিছুদিনের মধ্যে যে ছেলেটি এদেশের নাগরিক হতে যাচ্ছিল সে কেন আত্মঘাতী হতে গিয়েছিল? কে বা কারা তাকে এই কুপথে টেনে আনলো।
কী প্রাপ্তির আশায় নিজের সদ্য জন্ম হওয়া সন্তানের মুখ, দু বছর আগে বিয়ে করা বৌয়ের ভালবাসা, বাবা-মায়ের বাৎসল্য, ভাইবোনের মায়া, বেঁচে থাকার আনন্দ, পৃথিবীর সৌন্দর্য সব ছাপিয়ে তাকে হনতারক হন্তারক করে তুলল?
কারা কীভাবে এই যুবকদের মনজগত নিয়ে খেলছে জানা জরুরী।
অস্বীকার না করে সচেতন হন। পরিবারের সদস্যদের খবরাখবর রাখেন। কে কি করছে জানেন। কারো মধ্যে পরিবর্তন এলে তার কারণ অনুসন্ধান করুন, একে অপরকে সময় দেন। সব কিছু নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করুন। মানবিক হওয়া আর জিহাদী হওয়া এক না-সেটা পরিবারের সাথে আলাপ করুন। ধর্মের উগ্রতায় মত্ত হওয়া ও বাড়াবাড়ি করা ভয়ংকর তা আলোচনা করুন। ধর্মের কাজ মানবিক হওয়া শেখানো, ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়ানো না। আসুন সবাই সচেতন হই, যাতে আগামীতে আর কেউ আকাইদ উল্লাহ না তৈরি হয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)।