১৬ ডিসেম্বরের আত্মসমর্পণের দলিল সিগনেচার ভাস্কর্যের কাজ করেছিলেন মৃণাল হক। রমনার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণের জায়গায় বঙ্গবন্ধু না থাকলেও মৃণাল হকের ভাঙ্কর্যে বঙ্গবন্ধু ঠিকই আছেন। এমন শৈল্পিক প্রতারণার চাতুর্য ভাস্কর্য শিল্পের ইতিহাসে বিরল।
মৃণাল হক ছাত্রদলের সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক। পিতা ছিলেন বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য। বিএনপি জামানার সাবেক মন্ত্রী রাজশাহীর অামিনুল হক মৃণাল হকের বড় ভগ্নিপতি। সব সরকারের অামলে সুবিধা বাগাবার ক্ষমতা তার পুরনো অার সীমাহীন, তা বলাই বাহুল্য।
বিএনপি সরকারের অামলে কেন্দ্রীয় কারাগারে তারেক রহমানের পায়রা ওড়ানোর ম্যুরালটির নির্মাতা তিনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেটি ভেঙ্গে দিলেও তখন “মা হারানোর চেয়েও বেশি শোকে কাদেঁননি”- মৃণাল হক। কার তখন অাবেগ বা সাম্প্রদায়িকতার পালে জোয়ার-ভাটার খেলা খেলবার সুযোগ ছিল না।
অবশ্যই সুপ্রিমকোর্টের সামনে ভাস্কর্য তিনি নিজে প্রতিস্থাপন করেননি। সরকারই তখন করেছে বা সম্মতি দিয়েছে, পরিশোধ করেছে মৃণাল হকের মূর্তি তৈরী বাবদ অর্ধ কোটি টাকার বিল। মেয়র সাঈদ খোকনের অগোচরে কীভাবে কাজটি হল সেও বিরাট এক ভানুমতির খেল। ভাসুরের নাম নিলে অসুর সমাগত নোটিশ হাতে। সব সরকারের অামলেই দেশে যেতে সবুজ বাতির অপেক্ষা করতে হয় শুধু কলম-কলামের দোষে। অার মৃণালেরা বাজিকর সব বাঁকে, সব মধুচাকেই। অবশ্য, এটিও বিরাট যোগ্যতা। অনেক কিছুই বলা যায় না, পাছে যদি অাইনের প্রতি সন্মাননা কম হয়!
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সামনে ভাস্কর্যটি কতটা সঙ্গতিপূর্ণ, নির্মাণকাজ শুরুর অাগে চারুকলা বা সংশ্লিষ্ট কারো মতামত নেয়া যেতো। তখন মৃণাল হকের কানেকশনের জোরে তা করা হয়নি। স্ত্রী, সন্তানসহ অামেরিকার নাগরিকত্বধারী এই শিল্পীর সবশেষ প্রজেক্টটি গ্রীক দেবী থেমিস না বাঙ্গালী নারী তা নিয়ে তারই স্ববিরোধী বক্তব্য অাছে। এর অাগে এয়ারপোর্ট এলাকায় তার নির্মিত ‘লালন’ ভাস্কর্যটিও বিতর্কের কারণে সরিয়ে ফেলা হয়।
তার নির্মিত মূর্তিগুলো অাদৌ ভাস্কর্যের সৌকর্যে শিল্পসত্তায় উত্তীর্ণ কি-না সে অালোচনার যোগ্যতা অামার নেই। কিন্ত, সব মূর্তিই যে ভাস্কর্য নয়, এটুকু বুঝি।
যাহোক, কিছুক্ষণ অাগে, শনিবার রাতে এনেক্স ভবনের সামনে ভাস্কর্যটি পুনঃস্থাপিত করা হয়েছে। পুরো যজ্ঞ মৃণাল হকের তত্ত্বাবধানেই সুসম্পন্ন হয়। প্রশ্ন হলো, মৃণাল যদি জানতেনই, ভাস্কর্য পুনঃস্থাপন করা হবে, তাহলে এমন নাটকের কি দরকার ছিল? সামনে-পেছনে তামাশার কী সুচারু পরিকল্পিত মঞ্চায়ন! চোরকে চুরি করার কথা বলে গৃহস্থকে সজাগ থাকার অাহ্বান।
এটা অবশ্য সরকারের পুরনো খেলা। নির্বাচন সামনে রেখে চীন, ভারত অপেক্ষা মুসলিম বিশ্ব বিশেষতঃ সৌদির সঙ্গে সম্পর্কের চোখে পড়ার মত উন্নয়ন করেছে সরকার। বিএনপিকেও অার ইসলামী দলগুলোর ট্রাম্প কার্ড নিয়ে এককভাবে খেলতে দিতে চায় না অাওয়ামী লীগ।
অাবার, হুজুরনির্ভর দলগুলোকে শেষ অবধি কাছেও টানবে না তারা, পাছে যদি ‘চেতনাবাজদের’ সমর্থন কমে। অাসলে চলমান খেলাটি সরকারের লম্বা মেয়াদের বহুমুখী খেলার অংশ মাত্র।
এখন দেশের সব ভাস্কর্য সরানোর দাবি যে হেফাজত তুলেছে, তাহলে তো বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যগুলোও সরাতে হবে। অামরা কথায় কথায় ফরহাদ মজহার, অাসিফ নজরুলদের বিএনপিবাজ দালাল বুদ্ধিজীবি বলি। কিন্তু রামেন্দু মজুমদার, নির্মলেন্দু গুণ বা হাসান অারিফদের পরিচয়ও এ যাত্রায় কিছুটা পুনঃউন্মোচন হয়েছে। যদিও শেষ দৃশ্য বাংলা ছবির সমাপ্তির দৃশ্যকে হার মানিয়েছে সবকিছু।
অামাদের প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক ক্রীড়াশৈলীর কাছে প্রতিদ্বন্দ্বিরা যে এখনও নিতান্তই অপরিণত, তা অাবার প্রমাণ হলো। জয়তু; শেখ হাসিনার কৌশলী, কুশলী নৈপুণ্যের। তার নিপুণ দাবার চালে কুপোকাত ডান-বাম সবাই, অাবার। গতকাল ক্রেডিট কাড়াকাড়ি নিয়ে বিজয় মিছিল করা হুজুরেরা এখন পাল্টা মিছিল দিচ্ছেন। যদিও সেই জোশ নেই অাজ। তবুও, অাস্থা রাখুন সাম্প্রদায়িক বৈঠাযুক্ত শংকর প্রজাতির অসাম্প্রদায়িক নৌকায়!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)