চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

অভ্যন্তরীণ জাতীয় নিরাপত্তা শঙ্কা

‘হলি আর্টিজান’ বেকারি আক্রমণ বাংলাদেশকে আবারো বিশ্বে পরিচিত করে তুললো নেগেটিভ আঙ্গিকে। যে মুহূর্তে দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবার উৎসব করার কথা, যে মুহূর্তে বহু বাধা-বিপত্তি পেড়িয়ে পদ্মাসেতু দেশীয় অর্থনীতির জিডিপিতে ১% প্রবৃদ্ধি দেবার কথা খোদ বিশ্বব্যাংকের তথ্য মোতাবেক, সেই মুহূর্তে আইএসআই বা জঙ্গি নামের যুথুর বুড়ি আতংক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে ব্ল্যাক স্পট কি দিয়ে গেল?

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য আমরা গর্ব করি। ‘নাসিরনগরে’ নিরাপত্তার মধ্যে আবার আগুন, ঢাকাস্থ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আনসার সদস্য ছুরিকাঘাত-এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা হতে পারে। তবে সাবধানের মার নাই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে আমরা পরোয়া করি নাই বিধায় ‘বাংলা’ ভাই গং বাংলাদেশের ৬৭ জেলাতে একসাথে বোমা হামলা করার সাহস পেয়েছিল।

হলি আর্টিজানের পরে নিরাপত্তা বিষয়ে জনসতেচনতা যেভাবে এসেছিল, তাতে কেনইবা ঝিমঝিমানি বা আত্মপ্রাসাদ চলে এলো। সেদিন ২০১৬ মেরিল আন্তর্জাতিক ফ্লোক ফেস্টিবাল-এ এক সহকর্মীর কথাটা শুনেই ইচ্ছে জাগলো আজকের বিষয়ে দু’কলম লেখার। শুনুন কি সেই কথা?

‘স্যার, নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করেন? আপনারা ঘরে কোটি কোটি টাকার সম্পদ রাখতে পারেন, আর পাঁচ হাজার টাকার বেশী মূল্যের নিরাপত্তারক্ষী রাখতে ঘ্যানঘ্যান করেন?’

কথাটা প্রথমে অনুধাবন করতে পারিনি। নিজেকে যখন প্রশ্ন করেছি, তখন লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। আসলে যদি নিজেকে প্রশ্ন করি, যেদেশে প্রতি ২৫০০ জনের জন্য ১ জন ডাক্তার, প্রতি ১০,০০০ জনের জন্য ১ জন পুলিশ সদস্য, যেদেশে প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানিগুলোর কোনো Compliance আমরা আজ অব্দি করতে পারিনি, যেদেশে নিরাপত্তা সচেতনতা আজো গড়ে উঠেনি, সেই দেশে নিরাপত্তাশংকা থাকবে না তো, কোন দেশে থাকবে?

বেয়াদবি মাফ করবেন পাঠককূল। নিজের সমালোচনা নিজে না করলে আত্মশুদ্ধি কিভাবে হবে? পেশায় একদা উর্দিপরা লোক ছিলাম বলেই এ বিষয়ে বেহুদা প্যাঁচাল মারার সাহস করছি। তবে হ্যাঁ, একজন করদাতা হিসাবে আমার মৌলিক অধিকার, তথা নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলতেই পারি বলেই আজ বলছি।

আমাদের বিচারবিভাগ শত বাধা-বিপত্তি তোয়াক্কা না করে যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারেন, তবে নাগরিক হিসাবে তাদের কাছে আবদার করতেই পারি নিরাপত্তা বিষয়ে তাদের অভিভাবকত্বের ভূমিকার। এদেশে গোয়েন্দা বাহিনীসমূহকে আমরা ফাঁসির কাষ্ঠে চড়িয়েছিলাম ‘হলি আর্টিজান’ আক্রমণের পরে। টিভি, টকশোতে কতো না কি বলেছি। মনে পড়ে?

ফ্রান্সের নিস্ শহরে যে ঘটনা ঘটে, কিংবা ৯/১১ তে যে ঘটনা ঘটে, কই সেদেশের ঈওঅ বা গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানসমূহকে তাহলে আজ ইধহ করা উচিত ছিল। যুক্তি দিয়ে কথা বলছি বলে ফাঁসির আদেশ দেবেন? দেন নারে ভাই!

সমালোচনা যখন গঠনমূলক হয়, তখন তা জাতির উন্নয়নের জন্য পরিপূরক হয়। তাই আজ মতভেদ ভুলে চলুন না এই বিষয়ে এক ছাতার নিচে দাঁড়াই?

আমাদের মানতেই হবে ১৬ কোটি জনতার জন্য সার্বক্ষণিক পাহারা কিংবা গোয়েন্দা নজরদারি বর্তমান অবস্থায় সম্ভবপর নয়। তবে আমাদের নিরাপত্তা সচেতনতা বৃদ্ধি করা গেলে এই শংকা কিছুটা হ্রাস পাবে। তৎসঙ্গে গোয়েন্দা বাহিনীসমূহের সাংগঠনিক জনবল বৃদ্ধি, উন্নত প্রশিক্ষণ, সরঞ্জামাদি প্রদান আজ যুগের দাবি। যেদেশের বাজেট লক্ষ হাজার কোটি টাকার উপরে, যেদেশের অর্থনৈতিক চাকাতে গতিবৃদ্ধি হচ্ছে দিনকে দিন, সেদেশের জন্যে উপরোক্ত প্রস্তাবনা কতটুকুন যৌক্তিক তা আপনাদের হাতেই ছেড়ে দিতে চাই।

জনসচেতনতা বৃদ্ধিকরণে সরকারের উপর বসে থাকার পক্ষপাতি নই আমি। স্বয়ং আমেরিকার মতন প্রথম সারির উন্নত বিশ্বেও ৯/১১ পরবর্তী বহুবিধ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ মার্কিন সরকার নেবার পরেও কি নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে? অথচ জাপানের দিকে যদি তাকাই, তবে খুব কমই বিশ্বমিডিয়ায় জাপানে জঙ্গি আতংকমূলক কর্মকাণ্ডের প্রমাণ পাই।

সুইজাল্যান্ডের উদাহরণ না দিলে অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে এই অধ্যায়। মূল কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে জনগণ নিরাপত্তা বিষয়ে এতই সচেতন যে তাদের দেশের সরকারের সহায়ক গোয়েন্দাশক্তি হিসেবে সেদেশের জনগণ কাজ করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের জনগণের আজ সে ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হলে সচেতন যেকোনো দেশপ্রেমিক নাগরিককেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের দায়িত্ব হবে এই জনসচেতনতার ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পেলে সমন্বয়সাধন করা। আমার বিশ্বাস, যেকোনো গণতান্ত্রিক জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারই স্বাগত জানাবে এই জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগকে।

ঘুরেফিরে ঢাকাস্থ ‘হলি আর্টিজান’ বেকারি আক্রমণের পর আর্চওয়ে মেটার ডিটেক্টর এবং হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টর বিক্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। কেউ কেউ উন্নতমানের সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেছেন। উন্নত প্রযুক্তির যতটুকুন ব্যবহার প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি আশানুরূপ। মূল কথা হলো, বিশ্বের সর্বোন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করলেও আমরা ঠিকই নিরাপত্তাশংকায় ভুগবো। জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেলে নিরাপত্তাশংকা কমবে কিন্তু আতংকিত হবার হাত থেকে কি রক্ষা পাবে এ জাতি?

আজ একতাবদ্ধ হবার বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কোনো সচেতন নাগরিকের দ্বিমত থাকা উচিত নয়। কারণ জঙ্গিচক্র বা কোনো দুষ্টুচক্র যখন আক্রমন করবে, তখনতো আর আওয়ামী লীগ, বিএনপি বেছে বেছে টার্গেট করবে না। আমাদের সন্তান-সন্তানাদিদের নিয়ে আজ আমরা আতংকিত কেন থাকবো? কেনইবা শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশে অশান্তির বন্যা বইবে?

সচেতন নাগরিক সমাজের একজন হিসাবে এই প্রশ্নগুলো যদি মনের দরজায় কড়া নাড়ে, তবে যদি হই অপরাধী, হলাম না হয় অপরাধী। পরিশেষে গৌতম বুদ্ধের শান্তির বাণী দিয়ে শেষ করছি-‘বুদ্ধাং শরনাং গচ্ছামি…

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)