সুযোগ এবং সহায়তা পেলে চরের বঞ্চিত অতিদরিদ্র নারীরাও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। তারাও তৈরি করতে পারে জীবন বদলে দেওয়ার নতুন নতুন গল্প। অভাবকে পরাস্ত করে তারাও এগিয়ে যেতে পারে। জীবনের শত বাধাবিপত্তি আর বিপন্নতা পেরিয়ে তাই মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন পাবনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, লালমনিরহাট জেলার বিভিন্ন দ্বীপচরের অতিদরিদ্র নারীরা। এসব জেলাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য দুর্গম দ্বীপচর। যেখানে সমস্যা অন্তহীন। দেশের ভেতরে থেকেও বাংলাদেশের এ সব চরে একটি ভিন্ন এবং দুরবর্তী সামাজিক অবস্থা বিরাজমান। নারীরা এখানে সবচেয়ে বঞ্চিত। কী ক্ষুধা নিবারণ বা চিকিৎসা-অভাব আর বিবিধ দুর্যোগের কারণে সব অধিকার থেকেই তারা বঞ্চিত। কিন্তু কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের ‘নদী ও জীবন-২ প্রকল্পের সহায়তায় এসব জেলার লক্ষিত চরের নারীরা জীবনের মোড় বদলে দিতে সক্ষম হয়েছেন। অভাবের চির দৈন্যতা কাটিয়ে তারা এখন সুখের ঠিকানা পেতে শুরু করেছেন। পেয়েছেন বেঁচে থাকার, এগিয়ে যাবার নতুন ভাবনা আর দৃঢ় আত্মবিশ্বাস। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে সামাজিক বোধ আর অধিকারের উপলব্ধিও তাদের মাঝে বেড়ে চলেছে। এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের চর পাকা, আলাতলি, দুর্লভপুর, রাজশাহীর চর আটরা পাড়া, বয়ারমারি, আষাড়িয়াদহ, লালমনিরহাটের চর সিন্দূর্ণা, গোবর্ধন, রাজপুর, ডাওয়াবাড়ি, পাবনার চর গংরাজানি, হাটুরিয়া-নাকালিয়া, মধ্যচরের অতিদরিদ্র নারীরা।
শোনা যাক অভাবকে পরাস্ত করে দুর্গম চরের নারীদের এগিয়ে যাওয়ার গল্প। দু’ বছর আগে স্বামীকে হারিয়ে দু’চোখে অন্ধকার দেখলেও পাবনা সদর উপজেলার মধ্যচরের চর মধুপুরের অতিদরিদ্র নারী, তিন সন্তানের জননী রুবি এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। নদী ও জীবন-২ প্রকল্প তার জীবনে এনে দিয়েছে এক নতুন পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনের ধারায় দারিদ্র্যকে জয় করে চলেছেন তিনি। শুধু এই-ই নয়, একজন যোগ্য সামাজিক নেত্রী হিসেবেও রুবি খ্যাত হয়ে উঠছেন। চরের অতিদরিদ্র মানুষের অধিকার রক্ষায় তিনি এখন অঙ্গীকারাবদ্ধ। মধ্যচরের ভূবন আলোকিত করে এগিয়ে চলেছেন তিনি। চর মধুপুর গ্রাম পাবনা শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ভাঁড়ারা ইউনিয়নে অবস্থিত দুর্গম ও দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থাসম্পন্ন একটি দ্বীপচর। বন্যা, খরা, নদী ভাঙ্গনে এই জনপদের মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। প্রকৃতি ও দারিদ্র্যের সাথে ক্রমাগত লড়াই করে টিকে থাকা এই গ্রামের বাসিন্দা রুবির জীবন আরও সংকটময় হয়ে ওঠে যখন দুই বছর আগে তিনি স্বামীকে হারান। স্বামী মারা যাওয়ার পর রুবি সত্যিই এক দুঃসময়ের মধ্যে পতিত হন। কিন্তু নদী ও জীবন-২ প্রকল্প তার জীবনে সহসাই এক নতুন পরিবর্তনের সূচনা করে। ২০১১ সালে স্থানীয় উন্নয়ন সংগঠন বাংলাদেশ অর্গানাইজেশন ফর সোশ্যাল সার্ভিস (বস) নদী ও জীবন- ২ প্রকল্পের আওতায় চরের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম শুরু করলে অতিদরিদ্র রুবি সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন এবং ময়না দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। দলে অর্ন্তভুক্ত হবার পর থেকে রুবি নিয়মিত দলীয় সভাতে অংশ নিতে থাকেন। এক পর্যায়ে রুবি প্রকল্পের আওতায় ছাগল পালনের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণের পরে তাকে ১টি ছাগল প্রদান করা হয়। ছাগল পালনের মধ্যে দিয়ে রুবির জীবনে এসেছে নতুন স্বাচ্ছন্দ। লালমনিরহাট সদর উপজেলার মারাইহাটি চরের মোমেনার গল্প আরো একটু ভিন্ন। প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে এক সময় ঘরে ও ঘরের বাইরে অবহেলিত হলেও ‘নদী ও জীবন-২’ প্রকল্পের কারণে মোমেনা তার সুপ্ত শক্তির প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন। মোমেনা এখন বাড়িতে বসে টুপি তৈরির কাজ করেন। এই কাজ করে মোমেনা প্রতিমাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকাও আয় করছেন যা তার জীবনে এখন নতুন স্বাচ্ছন্দ এনে দিয়েছে। মোমেনার বাবার বাড়ি ছিল লালমনিরহাট সদর উপজেলার রাজপুর ইউনিয়নের মারাইহাটিতে। তিস্তা নদীর করাল থাবা থেকে রক্ষার জন্য শেষ পর্যন্ত তার আশ্রয় হয় খলাইঘাট রাজপুরের ১ নং আবাসনে। বাবা ইসমাইল হোসেনের কোনো ছেলে সন্তান ছিল না। তিন মেয়ের মধ্যে মোমেনাই সবার বড়। দূর্ভাগা মোমেনা জন্ম থেকে কোনোভাবেই যেন বিধাতার করুণা পাচ্ছিল না। তার বিয়ে হয় আরেক হতভাগ্য হায়দার আলীর সাথে।
২০১১ সালে মোমেনা উত্তরা ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম সোসাইটি (ইউডিপিএস)-এর সহায়তায় কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড ও আইরিশ এইডের অর্থায়নে পরিচালিত ’নদী ও জীবন-২’ প্রকল্পের এর সদস্য পদ লাভ করেন। এরপর বিভিন্ন দলীয় সভায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করেন। এই ধারাবাহিকতায় একসময় ইউডিপিএস-এর উদ্যোগে টুপি সেলাই-এর উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর নিজে টুপি সেলাই-এর কাজ করতে থাকেন। বাড়িতে বসেই মোমেনার আয়ের পথ উন্মুক্ত হয়। টুপি তৈরির কাজ মোমেনার আয় রোজগারে এখন বড় এক অবলম্বন। বর্তমানে তিনি মাসে ৩টি করে টুপি সেলাই করে মজুরি বাবদ ১১৪০ টাকা আয় করছেন। এর মাধ্যমে জমানো টাকা দিয়েই মোমেনা এবং তার স্বামী দুজনে মিলে ইতিমধ্যে দেড়দোন জমি বর্গা নিয়ে আমন ধান চাষ করেছে। এদিকে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে কনসার্নের আয়োজনে এক্সেঞ্চার-এর সহায়তায় যে প্রশিক্ষণ কোর্স হয় তাতে সে ক্ষুদ্র ব্যবসার উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং ভবিষ্যতে বাড়িতে মুদির দোকান চালু করবেন বলে স্বপ্ন দেখছেন। প্রতিবন্ধী মোমেনা অভাবকে পেছনে ফেলে এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছেন।
চরের অন্যান্য মেয়েদের মতোই ৮ম শ্রেণীতে থাকা অবস্থাতেই অতিদরিদ্র ময়নার বিয়ে হয় দিনমজুর কামালের সাথে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার পাকা ইউনিয়নের আড়াই রশিয়া পদ্মা নদীর ওপাড়ে চরপাকা গ্রামে স্বামী ও দুই মেয়ে নিয়ে ময়না বেগমের সংসার। নদী ও জীবন-২ প্রকল্পের সদস্য হওয়ার পূর্বে ময়না বেগমের জীবনের ইতিহাস খুবই করুণ। সংসারের অভাব দিনমজুর স্বামীর একার রোজগার দিয়ে দূর করা সম্ভব হতো না। চাষের জন্য বর্গাকৃত ৬ কাঠা জমি থাকলেও সেই জমির বাৎসরিক টাকা পরিশোধে চলে যেত উপার্জনের বড় একটি অংশ। বড় মেয়েকে স্কুলে পাঠানো তো দুরের কথা, প্রতিদিন তিনবেলা খাবার পর্যন্ত জুটতো না। তার উপর ছিলো বর্গাকৃত জমির বাৎসরিক টাকা পরিশোধের দুশ্চিন্তা। এরকম অবস্থায় যখন ময়না বেগম দিশেহারা, তখন স্থানীয় উন্নয়ন সংগঠন গ্রামীণ বহুমুখী উন্নয়ন সংস্থা (জিবাস) ময়না বেগম সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। আত্মবিশ্বাসী ময়না বেগম মনে করেন নিজের চেষ্টা এবং কিছু সহায়তা থাকলে জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে নেয়া সম্ভব। তাহলে তার মতো অতিদরিদ্র অনেকেই অর্থনৈতিক ভাবে সচ্ছল হতে পারে।
এদিকে তিন বারের নদী ভাঙ্গনে দুলালী বেগমের জমি নদীর গর্ভে বিলীন হওয়ার জীবন বড় বিপন্ন হয়ে উঠলেও দুলালী ‘নদী ও জীবন’-২ প্রকল্পের সহায়তায় বেঁচে থাকার নতুন পথ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার পাকা ইউনিয়নের বিশরশিয়া নামো মসসিন পাড়ার বাসিন্দা দুলালী বেগম। নিজের বলতে কোন জমিই তার নেই। ছেলে মেয়ে নিয়ে অন্যের কাছ থেকে বন্দোবস্ত নেওয়া একখন্ড জমিতে বাস করেন। নদী ভাঙ্গনের কারণে দুলালী সব হািরয়ে সর্বশান্ত হলেও ‘নদী ও জীবন’-২ প্রকল্প তাকে বেঁচে থাকার নতুন পথ বাতলে দিয়েছে। প্রকল্পের সহায়তায় বিভিন্ন ধরনের আয়বৃদ্ধিমূলক কাজের মাধ্যমে দুলালী তার নিত্য অভাবের সংসারে সুখের পিদিম জ্বালাতে সক্ষম হয়েছেন। প্রকল্পের কর্মীদের পরামর্শ অনুযায়ী সে তার বাড়ির আশেপাশে পতিত অল্প জায়গাতে ঢেঁড়শ, পুইশাক, লালশাক, মিষ্টি কুমড়া রোপণ করে। বাড়ির পুষ্টি চাহিদা পূরণের পরও বাড়তি সব্জী বিক্রি করে সে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে।
নদী ও জীবন-২ প্রকল্পের আওতায় ক্ষুদ্র ব্যবসার প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের জীবনে পরিবর্তনের দ্বার উন্মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলার গড়গড়ী ইউনিয়নের চকরাজাপুর চরের শাহিনা বেগম। শাহীনার বয়স ৩৫ বছর। তার পরিবার অনেক বার পদ্মা নদী ভাঙ্গনের স্বীকার হয়ে সর্বশান্ত হতে হয়েছে। শাহিনা বেগমের তিন ছেলে এক মেয়ে। একমাত্র স্বামী দিনমজুরি করে কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে সংসার চালাত। ফলে প্রতিনিয়ত তাদের সংসারে অভাব লেগেই থাকত। ২০১১ সালে বাঘা উপজেলায় নদী ও জীবন-২ প্রকল্প শুরু হলে শাহিনা বেগম এই প্রকল্পের সহযোগী সংগঠন এসএনকেএস এর মহানন্দা মহিলা দলের সদস্য হিসাবে অন্তর্ভূক্ত হন। সদস্য হওয়ার পর অতিদরিদ্র শাহিনা বেগম দলে নিয়মিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যা উত্তরণ ও কিভাবে বাড়তি আয় রোজগার করে সংসারের অভাব দুর করা যায় সে সম্পর্কে আলোচনা ও প্রশিক্ষনের মাধ্যমে জ্ঞান লাভ করার সুযোগ পান। একপর্যায়ে শাহিনা বেগম ক্ষুদ্র ব্যবসার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। দলের সদস্যরা তাকে ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য মনোনীত করেন এবং এসএনকেএস এর কর্মীরা তাকে এক্সেচেঞ্জারের অর্থায়নে ক্ষুদ্র ব্যবসার প্রশিক্ষণ দেন। প্রশিক্ষণ লাভের পর তিনি পেয়াজু, বড়া এবং সিংগাড়া বিক্রির ব্যবসা নির্বাচন করেন এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনে তিনি তার ব্যবসা শুরু করেন।
এভাবেই দুর্গম চরের রুবি, মোমেনা, ময়না, দুলালী, কামরুন্নাহার, শাহীনার মতো অসংখ্য নারীই এখন অভাবকে পেছেনে ফেলে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। নিত্য অভাবকে জয় করে তারা দেখছেন নতুন দিনের স্বপ্ন। এগিয়ে যাচ্ছেন সামনের দিকে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)