চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

অনন্ত অঙ্গনে ভ্রমণমগ্ন

পর্যটন, মানুষের আদি স্বভাব। পর্যটনের প্রভাব ছাড়া সভ্যতার সৃষ্টি হতো না।

অনাদিকাল হতে মানুষ স্বেচ্ছায় কিংবা বাধ্যগতভাবে যুক্ত হয়েছে Displacement এবং Migration প্রক্রিয়ায়; এখানে অভিজ্ঞতা অনন্য বিপন্নতা এবং তা পর্যটনের নামান্তর; কিন্তু পর্যটন বলতেই সেই রকম নিষ্ক্রান্ত হওয়া কিংবা বর্জিতের অঘটন বলে গ্রাহ্য করা হয় না।

পর্যটনের রয়েছে ভ্রমণযোগ। রয়েছে নতুন সব উন্মোচন। প্রকৃতির সঙ্গে সাক্ষাৎ রয়েছে। চোখ দিয়ে দেখে দেখে কখন যেন বন্ধ কপাট খুলে যাওয়া আছে- মনে, ভ্রমণে।

সম্যক হয় না প্রকৃতি কেবল; মানুষের প্রাণ স্পন্দিত না হলে প্রকৃতি জলরং কিংবা তেলরঙে কেবলই সৌন্দর্য ছড়াতো- কিন্তু যেহেতু মানুষ, প্রকৃতি তাই স্থির প্রতিকৃতি নয় বরং চঞ্চল, উজ্জ্বল ও বর্ণিল।
অপরদিকে, সহসা গুলির শব্দ। পালাচ্ছে মানুষ। এক দিগন্তরেখা থেকে নির্মূল হয়ে যায় পৌঁছে বক্ররেখায়– উড়ান থেকে পতোন্মুখ বাস্তবতায়।

আমরা মনে করতে পারব সেই আফগান কবিকে, ইরান থেকে যাকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল বিভীষিকাময় স্বদেশে, যে দেশ তার নিজেরই ভূ-প্রকৃতি, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি আর প্রতিবেশীদের নির্দয় ব্যবহারে ছিল সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত।

কবি তার অনুভূতিমালার কথা জানিয়েছিলেন একটা কবিতায় এবং তারপর হারিয়ে গেলেন কোথায় যেন

– এসেছিলেন পায়ে হেঁটে, আর ফিরেও যাচ্ছি সেভাবে।
আগন্তুক, টাকা জমানোর কোন জায়গা নেই যার, যেতে তো তাকে হবেই।
যে শিশুর কোন পুতুল নেই, যেতে হবে তাকেও।

এবার ফিরে তাকাব আরেকবার – এই জন্য যে, The world is a beautiful place।
নি:সন্দেহে আমরা উচ্চারণ করব Lawrence Ferlinghetti যেমনটি আওড়ে ছিলেন-
The world is a beautiful place
to be born into
If you don’t mind some people dying
all the time
or may be only starving
some of the time
which isn’t half so bad
If it isn’t you….

কিন্তু মানুষ জয় করবে বলে – ভালবাসবে বলে – ফুল ফুটবে বলে – পাখি গান গাইবে বলে
Yes the world is the best place of all
for a lot of such things as
….. and just generally
‘living it up’

মার্কিন গবেষক কিনটন সিলির লেখা জীবনানন্দের সাহিত্যিক জীবনীর অনবদ্য অনুবাদক ও উপস্থাপক ফারুক মঈনউদ্দীন পাঠকের কাছে অচেনা নন। জীবনানন্দের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও দেখে ফেলেছেন কীভাবে, কোথায় সাতটি তারার তিমির – বিনাশী অথবা বিপ্লবী হয়ে ওঠে; হয়ে ওঠে তিমির বিলাসী। তার সেই অনুবাদও হয়েছিল ক্রমে পরিণত এক জীবনানন্দ বিনির্মাণ এবং নিশ্চিত অনুভব করতে পেরেছিলেন জীবনানন্দের ইতিহাস চেতনা, সময়ের ইতিহাসের মধ্য দিয়ে সেই কাল পর্বে যুদ্ধকবলিত দাঙ্গা পীড়িত, অনাহারী মৃত্যুর শীতল তাপ; যখন অনুবাদ তখনই নির্মাণ – নিশ্চিত তিনি বোধ ও সত্তায় ধারণ করতে পেরেছিলেন জীবনানন্দের রাজনৈতিক অবস্থান ও আকাঙ্খা। জীবনানন্দকে অনুবাদ করতে করতে জেনে গিয়েছিলেন : আকাশ জুড়ে ধূসর পাণ্ডুলিপির রং …..

বনলতা সেনের পাণ্ডুলিপি ধূসর হয়ে যাচ্ছে কীভাবে মৃত্যুর আগে আগে জীবনানন্দের চোখের সামনে। ধূসর পাণ্ডুলিপির রং আকাশ জোড়া ছড়িয়ে পড়েছিল – শিল্পীর তুলিতে নয়, – চোখ বুজবার আগে জীবনানন্দের চোখে তারায়।

ফারুক মঈনউদ্দীন তার বহুমুখী আগ্রহ ও রচনাকৃত কর্মের মধ্যে জীবনানন্দের সাহিত্যিক জীবনী ‘অ্যা পোয়েট অ্যাপার্ট’ – গ্রন্থ অনুবাদ করে ধন্যবাদার্হ এবং পুরস্কৃত হয়েছেন।

সদ্য একুশের বইমেলায় তিনি পাঠককে অভিনন্দন জানিয়েছেন তার ভ্রমণকথা ‘বিশ্বজোড়া অনন্ত অঙ্গনে’ গ্রন্থের চিত্রময় অর মালার সুভাষিত প্রকাশে; সূচিবদ্ধ হয়েছে, এই গ্রন্থে – আমেরিকার নাভেদার মরুভূমি থেকে মঙ্গোলিয়ার স্তেপভূমি, ভারতের কাহ্নেরী গুহাস্থিত ভূবিহার থেকে ওলন্দাজ রাজধানীর খালপাড়ের বারাঙ্গনা পল্লীপর্যন্ত। -এই ভ্রমণকথায় আগ্রহী পাঠক কেবল মনশ্চে ভ্রমণকারীর বোধকৃত দর্শনীয় বস্তু ও প্রাণী জগৎকে মন্ময় হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা অর্জন করে পিপাসা মেটাবে না, বর- আলোচিত হওয়ার মতো ইতিহাস-ভূগোল, সমাজ ও মানুষ নিয়ে নতুন উন্মোচন নতুন উপল হয়ে উঠেছে বলে আরেক মাত্রা খুঁজে পাবে।

অবলোকন-বর্ণন এই সীমানা ভাঙনের। ফারুক মঈনউদ্দীনের কলমের।

ফারুক মঈনউদ্দীন বিনয়ের সঙ্গে বলেন, তৃতীয় বিশ্বের পর্যটকদের ভ্রমণ কাক স্নানের মতো। অথচ বইটি পাঠ করলে, নি:সন্দেহে শিশির স্নানের অভিজ্ঞতা হবে পাঠকের।

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া… ধানের ওপর শিশির বিন্দু জমা করে তাতে গাঢ় স্নান – শিশির-সিক্ত পাঠক মানস সরোবরে আশ্চর্য প্রদেক্ষিণ খুঁজে পাবে করতলে অজানা দেশ-মহাদেশ।

তিনি ভ্রমণের অষ্টপ্রহর শেষে দেখলেন ফিরে পেছনে, – তুলে নিলেন কলম – ছবি আঁকার মতো রং তুলি না ধরে – অপরূপ কথা – মনে হয় সম্যক ও জীবন্ত। এখানে থাকে সৃজন – যে, দৃশ্যহীনও খুঁজে পায় চলচ্ছবি।

অজানা স্থান-কাল-পাত্রের সঙ্গে ঘটে যায় বিস্তারিত পরিচয় – ভূ-প্রকৃতিসহ অর্থনীতি-রাজনীতি-সংস্কৃতি। অন্য সূত্র থেকেও জেনে নেয়া যেতে পারে তথ্যাকারে কিন্তু এভাবে জানা যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে। এখানে পাওয়া যায় না অনুভব বর্জিত কোনও তথ্যায়ন, বরং উপলব্ধির দৃশ্যলিপি। মঈনউদ্দীন ভ্রমণ লিপিতে মর্মে মর্মে গেঁথে দিয়েছেন রূপহীন অন্তরে রূপ আর রূপময় প্রান্তরে রূপান্তর।

যে বইটিকে উপজীব্য করে এত কথার বিস্তার – পাতায়-পাতায় খচিত রয়েছে ভ্রমণকারীর প্রতিভা; পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আবিষ্কার হবে হঠাৎ সেই এক টান, – চুম্বক আটকে নেবে পাঠককে; আকর্ষিত পাঠক পরিভ্রমণ শুরু করবে – পৌঁছাবে গিয়ে শেষ পাতায় এবং তখন দ্যূতি ও অনির্বচনীয় আনন্দ। পাঠ ভ্রমণ থেকে মানস ভ্রমণের যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করেছেন তিনি এই ভ্রমণ লিপির গ্রন্থনায়।
বিভিন্ন ঘটনার উৎসার ও মনোহর বিষয়াদিতে ভরপুর ভ্রমণ কথা ক্রমে ভ্রমণ সাহিত্যের নিজস্ব ভাষা তৈরি করে নিচ্ছে – সেই ইঙ্গিত ও ইশারা লক্ষ্য করা যায়। চেষ্টা রয়েছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে উল্লেখ, যখন অনুপুঙ্খ বর্ণনা অনিবার্য হয়ে ওঠে।

গ্রন্থ পাঠে নবোদয় এই যে, ভ্রমণ পাঠের অকুস্থল দ্বিতীয় আরেকজন সম্যক করলে, এই বিশদ ভ্রমণ হরফে-বাক্যে-দৃশ্যকল্পে স্পর্শিত হলে পরে সশরীরে নিজের পে – তখন অপরিচিত মনে হবে।

অবশ্যই, পাঠকের মনে ভ্রমণ তাড়না জেগে উঠতে বাধ্য বলেই নিজস্ব পর্যটনকালে রেমব্রাণ্টের ঘরে ঢুকে মনে হবে আরেকবার দেখছেন তিনি। রেমব্রাণ্ট হয়ে উঠবে তার কাছে ঝলমলে।

রেমব্রাণ্ট হাসছেন, শিল্পী হাসছেন-
আত্মা যেখানে প্রকাশ করা যায় – তিনি সেই সাধনা করতে চেয়েছিলেন। রেমব্রাণ্ট ছিলেন না বিনিময় – যোগ্য, তার হাসি, যে কোনও সময়কে চাবকাতে পারে।

রেমব্রাণ্টের হাসি থেমে গেলে দুনিয়াময় স্থবিরতা নেমে আসবে – এমনই সেই শিল্পী সত্তাকে ভাঁজ খুলে আমাদের দেখাতে, এই নিয়ে কথা বলতে এক চক্কর ঘুরে এসেছেন রেমব্রাণ্টের বাড়িময়।

আরেক শিল্পী ভ্যান গগ শিল্প ও কর্মে যে মায়া বিস্তার ও রক্ত সঞ্চালন করেছেন – ফারুক মঈনউদ্দীন, তার কলমে আমাদের নিয়ে যেতে পেরেছেন সেই কুহকের জগতে।

আমস্টারডাম, ভূ-পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে কেন পৌঁছে গেছে – সঠিক উপস্থাপনায় তা উপস্থাপনও করেছেন তিনি।

ভ্রমণকারী লেখকের কলমদারিতে যে প্রকাশ্যরূপ দেখা যায়, – সহনশীলতার অনাড়ম্বর পূর্ণ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য দলে দলে পর্যটকরা ছুটে আসছেন এই ভুবনে।

সহনশীলতা বলতে, সামষ্টিক মনোভঙ্গিকে ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সীমায়িত করার ভাবনাটা থাকে না।

পড়তে পড়তে একটা পুরানো গির্জা চত্বরের ঝলক পাওয়া গেল। সেখানে স্থাপিত আছে সংপ্তি পোশাকের এক বারাঙ্গনার ভাস্কর্য, অথচ শালীন পোশাক শরীরে না ধারণ করে গির্জায় কারো প্রবেশাধিকার থাকে না।

আরেক গির্জার পাশে দেখা গেছে, সমকামীদের স্মরণে অভিনব এক সমকামী স্তম্ভ বা হোমোমনুমেণ্ট।
এসব কীর্তি অয় করে রেখেছে তারা এবং তা হয়ে উঠেছে সহনশীলতার প্রতিরূপ।

জলে ভাসা বাড়ি, প্রকাশ্য রেড লাইট ডিস্ট্রিক্ট; কফি শপে গঞ্জিকা সেবনের বৈধতা, স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য, আনা ফ্রাঙ্কের বাড়ি, ভ্যান গগ – এরকম যাবতীয় দর্শনীয়ের মিলিত আকর্ষণ কোনও পর্যটকের জন্য বঞ্চিতের প্রো করতে পারে না।

বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ সুসম্পন্ন করতে হলে আমাদের পে এমত উদাহরণ কিংবা সমতুল্য পরিবেশ ও পরিস্থিতির এই প্যারাডাইম নিয়ে যথেষ্ট ভাবনার প্রেতি রয়েছে।

আরোপ করে নয়, বরং বাংলাদেশ সমাজে আবহমানকাল ধরে সহনশীলতার যে চর্চা গড়ে উঠেছে, সেটা নিজের মত বহাল রাখলে পর্যটন খাত নয়, বরং রাষ্ট্রের আর্থিক বিকাশ ও উন্নয়ন হোচট খাবে না, ঘুর পথে চলবে না।

গ্রন্থটিকে প্রয়োজনীয় চিত্রে শোভিত করা হয়েছে। ফলে পাঠ ভ্রমণকে আরেকটু এগিয়ে নিতে এখানে ভ্রমণকথার বিস্তারে কোনও ঘাটতিকেও সম্ভবপর সীমার মধ্যে গৃহীত হয়েছে।

ছবিতে দেখব, কোণের কালো বাড়িটার পরের বাড়ি আনা ফ্রাঙ্কের। ভ্রমণকারী সবিস্তারে সেই ডায়েরি – লেখকের জগতেও ঢুকে পড়েছেন এবং আমাদের জন্য তুলে এনেছেন অজানা তথ্যের সম্ভার।

আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি প্রকাশিত হয়েছিল মৃত্যুর পরে। প্রথম প্রকাশের সময় বাদ রাখা অংশ জুড়ে বের হয়েছে ১৯৯৫ সালের চূড়ান্ত সংস্করণটি।

বাদ দেয়া অংশগুলো জুড়ে দেয়ায় অজানা হয়ে ওঠে জানা। কারণ আনা ফ্র্যাঙ্কের ঋতুমতী হওয়ার কথা, জননেন্দ্রীয় নিয়ে ভাবনা ও বিস্ময়, সমকামী মনোভাব, মায়ের সঙ্গে আনার মনোমালিন্য – বাবা অটোফ্র্যাঙ্ক বইটির প্রথম প্রকাশে মুদ্রণ হতে তা বিরত রেখেছিলেন।

বিশ্ব জোড়া অনন্ত অঙ্গনে – ভ্রমণ নিয়ে কথকতা আমাদের মানসভ্রমণের পাশাপাশি অজস্র তথ্যস্নানে আমাদের জন্য নতুন একটি মোড়ক উন্মোচন করেছেন।

ফারুক মঈনউদ্দীন, সকলের ধন্যবাদ পাবেন নি:সন্দেহে।

বিশ্বজোড়া অনন্ত অঙ্গনে
ফারুক মঈনউদ্দীন
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
প্রকাশক : অন্যপ্রকাশ

সৌজন্যে বইনিউজ