আগামী ২ এপ্রিল ১০ম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। প্রতি বছর সরকারের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়-এই দিনটিকে পালন করে আসছে। এবারে এ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- ‘স্বকীয়তা ও আত্মপ্রত্যয়ের পথে’।
এ বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনষ্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিজওর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা) দিনটিকে বিশেষভাবে পালন করছে। ১লা এপ্রিল থাকছে এই বিশেষ শিশুদের নিয়ে একটি চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা এবং ২ এপ্রিল রয়েছে নীল বাতি প্রজ্জ্বলন।
অটিজম শিশুর বিকাশজনিত একটি সমস্যা। ১৯৪৩ সালে আমেরিকার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ লিও ক্যানার সর্বপ্রথম মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে রোগটি শনাক্ত করে অটিজম শব্দটি ব্যবহার করেন। শিশুর জন্মের প্রথম তিন বছরের মধ্যে এর লক্ষণ প্রকাশ পায়। রবার্ট এল বার্কার উল্লেখ করেছেন, অটিজম এমন একটি বিকাশজনিত সমস্যা এতে ব্যক্তির মধ্যে বাইরের জগত সম্পর্কে সামান্য আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়।
অটিজম হচ্ছে এমন একটি বিকাশজনিত সমস্যা যেখানে শিশুদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ, সামাজিক আচরণ, সামাজিক কল্পনা ইত্যাদি ক্ষেত্রসমূহে বেশ সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। বিশেষজ্ঞরা একে অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডার বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। অটিস্টিক শিশুর বিকাশ মূলত তিনটি ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয়।
১। সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধাঃ অন্য কোন ব্যক্তির প্রতি আগ্রহ না থাকা, কে কি করছে তা নিয়ে কৌতুহল না থাকা, অন্যের আচরণ বুঝতে না পারা।
২। যোগাযোগ স্থাপনে বাধাঃ কথা বলতে না শেখা, কোনোমতে কথা বলা, কথা বলতে পারলেও অন্যের সাথে আলাপচারিতা করতে সমর্থ না হওয়া।
৩। আচরণের ভিন্নতাঃ পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ করা, একই কাজ বার বার করা।
অটিস্টিক শিশুর অন্যান্য বৈশিষ্ট্যঃ
অন্যের সাথে যোগাযোগ ও আচরণের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে অটিস্টিক শিশুর প্রধান বৈশিষ্ট্য। এছাড়া আরো কয়েকটি বৈশিষ্ট্য এখানে উল্লেখ করা হলো-
১. নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয় না।
২. কোন খেলনা বা আনন্দদায়ক বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হয় না।
৩. কারো আদরও পেতে চায় না।
৪. বিশেষ আচরণ বার বার করতে চায়।
৫. তারা রুটিন মেনে চলতে চায়।
অটিজমের কারণই বা কি?
অটিজমের সুনির্দিষ্ট কোন কারণ এখন পর্যন্ত নির্ণয় করা না গেলেও কোন কোন বিজ্ঞানী মনে করেন, অটিজমের পিছনে দু’টি কারণ রয়েছে-
১. জিনগত সমস্যা ২. পরিবেশগত সমস্যা। অটিজমে আক্রান্ত শিশুর DNA জিনে Copy number of variant (CNV) নামক ত্রুটি বহন করে। পরিবেশের বিষাক্ত উপকরণ জিনের উপর ভর করে স্নায়ুকোষ ধ্বংস করে। বিষাক্ত গর্ভের শিশু এবং শিশুর বৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ের ব্রেইনের স্নায়ুকোষকে ধ্বংস করে। যেসব রাসায়নিক দ্রব্য অটিজমের জন্য দায়ী তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, মার্কারী, লেড, Pesticides।
অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, এটি একটি নিউরোলজিক্যাল বা ব্রেনের সমস্যা। কারণ কখনও কখনও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মস্তিস্কের কিছু অসুবিধা লক্ষ্য করা যায়। যেমন-
১. মস্তিস্কের কোন রূপ গঠনগত ত্রুটি
২. মস্তিস্কের অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক ক্রিয়া
৩. মস্তিস্কের নিউরোকেমিকেলের অসামঞ্জস্যতা
৪. অন্তক্ষরা গ্রন্থির হরমোন নিঃসরণে অসামঞ্জস্যতা
অটিজম- বাংলাদেশের অবস্থা কি?
বিশেষজ্ঞের মতে, বাংলাদেশে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। সমাজ সেবা অধিদপ্তরের প্রতিবন্ধী সনাক্তকরণ জরিপে (২০১৩-২০১৬) বাংলাদেশে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা ৪১৩২৯ জন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অন্য একটি জরিপে বলা হয়েছে ঢাকা শহরে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা গ্রাম অঞ্চলের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে-বাংলাদেশে প্রায় ১% শিশু বা ব্যক্তি অটিজমের বৈশিষ্ট্য বহন করছে।
অটিজম শিশুকে কিভাবে চিকিৎসা করা যেতে পারে?
গবেষকদের গবেষণায় দেখা গেছে যে, শৈশবে হস্তক্ষেপ করা গেলে অটিজম নিয়ে জন্ম নেয়া শিশু প্রাপ্ত বয়সে অনেকটাই স্বাভাবিক হতে পারে। শৈশবে হস্তক্ষেপ বলতে বুঝায়, জন্মের ১৮ মাস থেকে ৩৬ মাস বয়সের মধ্যে অটিজম শনাক্তকরণ ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে শিক্ষা পরিকল্পনার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শিশুকে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া। অটিস্টিক শিশুর প্রধান চিকিৎসা নিওরোবিহেভিওরাল থেরাপি, অতিরিক্ত আচরণগত সমস্যা ও শারীরিক সমস্যার জন্যে মেডিকেল চিকিৎসা এবং বিশেষ স্কুলে শিক্ষা দেওয়া। দেখা গেছে স্বল্প ও মধ্যম মাত্রার অটিজম প্রাথমিক অবস্থায় ধরা গেলে এবং সঠিকভাবে পরিচর্যা ও শিক্ষা পেলে রোগের উপসর্গ অনেকাংশ কমানো যেতে পারে।
আমাদের করণীয়ঃ
কোন শিশুর যদি উপরোক্ত অটিজমের সমস্যাগুলো ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যেই তার বাবা-মা লক্ষ্য করে থাকেন, তাহলে প্রথমে অবশ্যই অতি দ্রুত শিশুকে একজন অটিস্টিক শিশু বিশেষজ্ঞকে দেখানো উচিত। জেনে রাখা ভালো যে- বেশিরভাগ অটিস্টিক শিশু অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হয়। প্রতি ১০ (দশ) জন অটিস্টিক শিশুর মধ্যে একজনের ছবি আঁকায়, গানে, গণিতে বা কম্পিউটারে প্রচণ্ড দক্ষতা থাকে। অটিস্টিক শিশুকে ঠিকমত পরিচর্যা করতে পারলে পরবর্তীতে সমাজে অনেক কিছু দিতে পারে। আসুন আমরা সবাই সরকারের পাশাপাশি অটিজম আক্রান্ত শিশুর প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেই। তাহলে অটিজম শিশুদের চলার পথ যেমন মসৃণ হবে তেমনি অভিভাবকদের কষ্টও অনেকাংশে লাঘব হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)